বিজেপির পতন যেভাবে
বিজেপির পতন যেভাবে - ছবি : সংগ্রহ
ভারতের রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির ঔদ্ধত্য ও বাড়াবাড়ির নেতিবাচক ফল আসতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। মহারাষ্ট্রে রাজনৈতিক ড্রামা, ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র শিবসেনার সাথে বিরোধ, মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেয়ার পর বিজেপি নেতার পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া এবং বিরোধী জোট তথা শিবসেনা নেতৃত্বাধীন জোটের কাছে ক্ষমতা হারানো। এ ছাড়া প্রায় একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি উপনির্বাচনে হেরে যাওয়া সত্যিই বিজেপির জন্য একটি অশনিসঙ্কেত বলে মনে করে পর্যবেক্ষক মহল। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভরাডুবিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, এই ফলাফল বিজেপির উদ্ধত্য ও অহঙ্কারের ফল। তিনি বলেন, তৃণমূলের এই জয় মানুষের জয়।
ভারতের বাণিজ্যিক নগরী মুম্বাই সিনেমা শিল্প বলিউডের জন্যও বিখ্যাত। এ নগরীটি দেশটির মহারাষ্ট্র রাজ্যে অবস্থিত। মহারাষ্ট্র ভারতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজ্য। এই রাজ্যে ১১২ মিলিয়ন জনসংখ্যার বসবাস। গত অক্টোবরে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাজ্যের ২৮৮ আসনের বিধানসভায় দীর্ঘ দিন বিজেপি-শিবসেনা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং দীর্ঘ দিন তারা রাজ্যটি শাসন করে এসেছে। এবারের নির্বাচনে বিজেপি ১০৫, শিবসেনা ৫৬, শারদ পাওয়ারের ন্যাশনাল কংগ্রেস (এনসিপি) ৫৪ এবং কংগ্রেস পেয়েছে ৪৪ আসন। এনসিপি গতবারের চেয়ে ১৩টি আসন বেশি পেলেও বিজেপি ও শিবসেনার আসন সংখ্যা কমেছে।
বিজেপি ১৪২ থেকে ১০৫, শিবসেনার আসন ৭৫ থেকে ৫৬ আসনে এসে ঠেকেছে। নির্বাচনের আগে বিজেপি ও শিবসেনার মধ্যে চুক্তি হয়েছিল সরকার পরিচালনার পাঁচ বছর মেয়াদের প্রথম আড়াই বছর বিজেপি থেকে মুখ্যমন্ত্রী এবং অবশিষ্ট সময়ের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবে শিবসেনা থেকে। কিন্তু নির্বাচনের পর বিজেপি এই চুক্তি মানতে অস্বীকার করলে দুই দলের দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে।
এ পরিস্থিতিতে শিবসেনার উদ্ধার কর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন মহারাষ্ট্রের দীর্ঘ দিনের মুখ্যমন্ত্রী শারদ পাওয়ার। একেবারে পিবরীত রাজনৈতিক আদর্শের দুই রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও শিবসেনাকে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করে অসম্ভবকে সম্ভব করেন তিনি। ভাইপো অজিত চাচার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিজেপির সাথে হাত মেলানোর কারণে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পাওয়ার বললেন, এনসিপির বিধায়করা তার সাথেই আছেন। শারদ পাওয়ার বিজেপির ঘুম হারাম করার জন্য দফায় দফায় কংগ্রেস শিবসেনার সাথে বৈঠক করেন। একপর্যায়ে কংগ্রেস শিবসেনার হাত ধরে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। মামলার রায় হওয়ার আগেই শারদ পাওয়ার সব কিছু গুছিয়ে নেন। এরপর কংগ্রেস শিবসেনা নেতৃত্বকে দু’পাশে নিয়ে ১৬২ বিধায়ককে সাথে করে শারদ পাওয়ার মিডিয়ার সামনে আসেন। যেন ওস্তাদের মার শেষ রাতে- এই প্রবাদবাক্যটিকে নতুন করে প্রমাণ করলেন। ২৬ নভেম্বর বিজেপির দেবেন্দ্র ফডনবিস মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করলে মহারাষ্ট্রে শিবসেনা এনসিপি এবং কংগ্রেস জোট সরকারের ক্ষমতায় আসার পথ পরিষ্কার হয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ওইদিন এক রায়ে ফডনবিসকে ২৭ নভেম্বরের মধ্যে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের নির্দেশ দেন। পরিস্থিতি স্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় আস্থা ভোটের আগেই বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ফডনবিস-অজিত মুখ্যমন্ত্রী ও উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। কংগ্রেস-এনসিপি-শিবসেনা জোট এর বিরুদ্ধে আদালতে গেলে শপথ গ্রহণের চার দিনের মাথায় মহারাষ্ট্র বিজেপি সরকারের পতন হয়।
নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে মহারাষ্ট্রে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন বালঠাকরের ছেলে শিবসেনা নেতা উদ্ধব ঠাকরে। উদ্ধব ঠাকরেই ঠাকরে পরিবারের প্রথম সদস্য, যিনি মুখ্যমন্ত্রী হলেন। উদ্ধব ঠাকরে কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ৫৯ বছর বয়সী উদ্ধব বিধানসভায় সহজেই আস্থা ভোটে জয়ী হয়েছেন। ২৮৮ সদস্যের বিধানসভায় ১৬৯ জন সদস্য তার সমর্থনে ভোট দেন। বিধানসভায় তিন দলের জোটের আসন সংখ্যা ১৫৪টি হলেও জোটের বাইরের সদস্যরাও তাদেরকে ভোট দিয়েছেন।
মহারাষ্ট্র বিধানসভার ম্যাজিক ফিগার ১৪৫। সহজেই শিবসেনা-কংগ্রেস-এনসিপি জোট ম্যাজিক ফিগার পার করে গেছে। উদ্ধবের হাত ধরেই মহারাষ্ট্রে ২০ বছর পর শিবসেনার কেউ মুখ্যমন্ত্রী হলেন। তবে মহারাষ্ট্রের বহুবার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী শারদ পাওয়ারই এই রাজনৈতিক কৌশলের গুরু। ৭৮ বছর বয়সী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শারদ পাওয়ার, যিনি ‘মারাঠা স্ট্রং ম্যান’ হিসেবে পরিচিত- তিনি ওই বয়সেও যে ভারতের রাজনীতিতে একটা ফ্যাক্টর তা নতুন করে প্রমাণ করলেন। তিনি মহারাষ্ট্রের তিনবার মুখ্যমন্ত্রী ও ১৯৯১ সালে কংগ্রেসের নরসিমা রাও সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
মহরাষ্ট্রে বিজেপি সরকারের পতনের পর প্রায় একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে তিন আসনের উপনির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে তৃণমূলের জয়লাভের খবর পাওয়ার পর পশ্চিম মেদেনীপুরের খড়গপুর ও নদীয়া জেলার করিমপুরে তৃণমূল জয়লাভ করেছে। তৃণমূলের এই বিজয়ের পর দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বললেন, উদ্ধত্য আর অহঙ্কারের ফল পেয়েছে বিজেপি। মমতা বলেন, ১, ২, ৩ বিজেপিকে বিদায় দিন। তিনি বলেন, লোকসভা ভোটের পর থেকে বিজেপির দম্ভ বেড়ে গিয়েছিল। এনআরসি করে দাও, একে নাগরিকত্ব দাও, ওকে বের করে দাও। যেন জমিদারি ওদের।
নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সরকার কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে গোটা রাজ্যকে অবরুদ্ধ করে রেখে সামরিক শাসন জারি করে এবং নির্যাতন, নিপীড়ন ও নির্বিচারে কাশ্মিরিদের হত্যা করে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে; তাতে হয়তো সাময়িকভাবে মোদি গায়ের জোরে জিতেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ও তার বিজেপি সরকারের পতন যাত্রা শুরু হয়েছে কাশ্মিরকে ঘিরে। এরপর মহারাষ্ট্রে বিজেপির ভারাডুবি এবং পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিপর্যয় ঘটেছে। ভারতের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এখন অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে নিচে নেমে গেছে। কৃষকরা দিশেহারা। তাই মনে হচ্ছে, হিন্দুত্ববাদের ধুয়া তুলে বিজেপি যতই চিৎকার করুক না কেন তাদের রাজনীতি যে অন্তঃসারশূন্য, জনগণ উপলব্ধি করতে শুরু করেছে।