হংকং : যেভাবে উল্টে গেল হিসাব
হংকং : যেভাবে উল্টে গেল হিসাব - ছবি : সংগ্রহ
প্রায় ছয় মাস ধরে হংকংয়ে চলছে চরম অস্থিতিশীলতা। সহিংস বিক্ষোভ, ভাঙচুর, ধর্মঘট সব মিলিয়ে অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতির শিকার হয় এশিয়ার অন্যতম সেরা বাণিজ্যিক হাব হংকং। অটল বিক্ষোভকারী আর অনড় সরকারের মধ্যকার এ সঙ্ঘাতে দুই দফা জয় পেয়েছে আন্দোলনকারীরা। প্রথমত যে প্রত্যর্পণ বিলকে কেন্দ্র করে এ পরিস্থিতির সূত্রপাত, তা থেকে পিছু হটতে হটতে পুরো বিলটাই বাতিল করতে বাধ্য হয় চীনপন্থী হংকং প্রশাসন। দ্বিতীয়ত এ বিক্ষোভ আন্দোলনের মধ্যেই ডিস্ট্রিক কাউন্সিল বা জেলা পরিষদ নির্বাচনে বড় জয় লাভ করেছে সরকারবিরোধীরা। উন্নত দেশগুলোতে যেমন হয়, হংকংয়ের জনগণের কাছেও এ নির্বাচনের তেমন কোনো আলাদা কদর ছিল না। কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়া এ নির্বাচনকে তারা সরকারের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে ভুল করেনি।
এর আগে ২০১৫ সালের স্বাভাবিক সময়ে যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে ভোট পড়েছিল ৪৭ শতাংশ। কিন্তু ২৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এত আন্দোলন বিক্ষোভের মধ্যেও ভোট পড়েছে ৭১ শতাংশ। ভোটের প্রাথমিক ফল অনুযায়ী ৪৫২টি জেলা পরিষদ আসনের মধ্যে গণতন্ত্রপন্থী প্রার্থীরা ৩৮৮টিতে জয় পেয়েছেন। বেইজিংপন্থী প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ৫৯টিতে। বাকি ৫ আসনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ফল হিসেবে তুলে নিয়েছে বড় বিজয়, ১৮টি কাউন্সিলের মধ্যে ১৭টিতেই জয় পায় তারা। আর এ ফল উল্টে দেয় হংকংয়ের ক্ষমতাসীন সরকারের পাশাপাশি বেইজিংয়ের হিসাব-নিকাশ।
এ নির্বাচনের মাধ্যমে তারা নিজেদের সরকারসহ পুরো বিশ্বকে একটি পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে। আর তা হলো- হংকংয়ের জনগণ শক্তভাবেই তাদের বর্তমান সরকার এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক বেইজিংকে অপছন্দ করছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে বিক্ষোভকারীরা যে আন্দোলন গড়ে তুলেছে এ ছয় মাস ধরে নির্বাচনের ফলাফল তারই সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা। ভোটের ফলে হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী ক্যারি লামের নেতৃত্বের সমালোচনা এবং চলমান বিক্ষোভের প্রতি জনসমর্থনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। হংকং সরকার ও বেইজিংয়ের ধারণা ছিল, এ নির্বাচন তাদের প্রতি তথাকথিত ‘নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ’ ভোটারদের সমর্থনকে তুলে ধরবে, কিন্তু তা হয়নি।
ক্যারি লাম এ নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি এ নির্বাচনের ফলাফলকে মূল্যায়ন করবেন। বিক্ষোভকারীদের দাবি, তার দেয়া কথা তিনি রাখুন। অন্তত এতটুকু করুন যে, তিনি তার মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টা পরিষদকে নতুন করে সাজাবেন।
আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের সেখানে স্থান দেবেন। সেই সাথে প্রায় ছয় মাস ধরে চলে আসা সঙ্ঘাতে পুলিশ-জনতার সংঘর্ষের বিষয়ে একটি স্বাধীন বিচারক টিম দ্বারা তদন্ত করাবেন। তবে আশাহত হওয়ার মতো সংবাদ হচ্ছে, নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত ক্যারি লামের পক্ষ থেকে এ ধরনের আর কোনো আভাস পাওয়া যায়নি। এরপরও নির্বাচনের ফল এদিক দিয়ে আনন্দিত ও আশাবাদী যে, এখন তাদের যৌক্তিকতার প্রতি আরো অনেক বেশি লোক পাওয়া যাবে এবং আগামী নির্বাচনে আরো বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে তাদের সহায়তা করবে।
আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে তাদের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের (লেজকো) আরেকটি নির্বাচনের শিডিউল রয়েছে। এ কাউন্সিলে ৭০ জন সদস্য সরাসরি নির্বাচিত হয়ে থাকেন। এ আসনগুলোতে এখন কিছু কৌশল অবলম্বন করা হয়, যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই প্রার্থীরা জয়লাভ করতে পারে। আর কাউন্সিলের বাকি আসনগুলো সাংবিধানিক আনুষ্ঠানিকতার দ্বারা পূর্ণ করা হয়। সেখানে ভোটারদের আসলে তেমন কিছু করার নেই।
সরকারপন্থী প্রার্থীরাই সেখানেই জয়লাভ করে থাকেন। তবে ছয়টি আসন সংরক্ষিত থাকে জেলা কাউন্সিলদের জন্য। গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকারীরা অন্তত শেষ কোঠার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। এর ফলে সব মিলিয়ে তারা কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠাতাও পেয়ে যেতে পারে। কাউন্সিলে তারা এখন পর্যন্ত সংখ্যালঘুই রয়ে গেছে। তবে যদি তারা এখন থেকে আসন্ন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেয়, এবং নির্দিষ্ট কোনো প্রার্থী বা দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করে যায় তাহলে কাউন্সিলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পেয়ে যেতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে তারা দেশের ‘কিং মেকার’-এর ভূমিকায়ও নিজেদের পেয়ে যেতে পারে।
হংকংয়ের সাম্প্রতিক নির্বাচনী ফলে বেইজিং স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। হংকংয়ের এ নির্বাচন তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তারা এ নির্বাচনকে প্রায় এড়িয়ে গেছে। গণতন্ত্রপন্থী প্রার্থীরা এবারের নির্বাচনে ঠিকমতো প্রচারণাও চালাতে পারেনি বলে অভিযোগ করেছেন। তারপরও ফল বিপক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে চালাতে চেয়েছে বেইজিং। এমনকি এ নির্বাচনে তারা মার্কিন হস্তক্ষেপের কথাও বলেছে ইঙ্গিতে। ২৭ নভেম্বর হংকংয়ের গণতন্ত্রের পক্ষে ট্রাম্প যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে বেইজিং আরো চটেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। সেই সাথে তাদের উপলব্ধি, হংকংকে আরো শক্ত হাতে শাসন করা উচিত ছিল।
স্থানীয় নির্বাচনে ক্যারি লামের এ ভরাডুবি হলেও তিনি আপাতত নিরাপদেই আছেন। কারণ তার মেয়াদ ২০২২ সাল পর্যন্ত। তবে এ অবস্থায় তার সরকারের পক্ষ থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, তারা এর আগেই ক্যারি লামের চলে যাওয়া উচিত বলে মনে করে।
এ মুহূর্তে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী কিছু অংশ ২০১৪ সালে চীনা সরকারের দেয়া একটি প্রস্তাবের আলোচনা আবারো সামনে নিয়ে আসতে চান। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, নতুন এ পদ্ধতিতে জনগণ তাদের প্রধান নির্বাহী নির্বাচনে সরাসরি অংশ নিতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, প্রার্থীর চূড়ান্ত মনোনয়ন হবে নির্বাচন কমিটি থেকে। অনেকে সেই পুরনো প্রস্তাবকে আবার আলোচনার টেবিলে তুলে নিয়ে আসতে চান। তবে দেশটির একজন খ্যাতনামা আইনজীবী ও আন্দোলনকারী বেনি থাই বলেছেন, যদি এ প্রস্তাব আবারো ওঠানো হয়, তাহলে জনগণ তা মেনে নেবে না।
হংকং থেকে চীনের মূল ভূখণ্ডে বন্দি প্রত্যর্পণ নিয়ে প্রস্তাবিত যে বিল নিয়ে গত জুন থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ক্যারি লাম সরকার চাপের মুখে নত হয়ে শেষ পর্যন্ত ওই বিল বাতিল ঘোষণা করে। কিন্তু তাতেও আন্দোলনের বেগ বিন্দুমাত্র কমেনি। বিক্ষোভকারীরা চীনের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছে।
অন্যদিকে চীন গুরুত্বপূর্ণ এ বাণিজ্য নগরীর নিয়ন্ত্রণ কিছুতেই শিথিল করতে রাজি নয়। সব মিলিয়ে হংকংয়ে এক ধরনের অস্বাভাবিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হংকংয়ের আন্দোলন পরিস্থিতি এখন কিছুটা শান্ত। অবশ্য আন্দোলনকারীরা বলছেন, তাদের এ বিরতিটা সাময়িক। শিগগিরই যদি ক্যারি লাম তাদের দাবি পূরণে কোনো পদক্ষেপ না নেন, তাহলে আবারো তারা ফিরে আসবেন আরো শক্তিশালী হয়ে।