‘বেগুনের মণ দুই পয়সা হইয়া গেল। মানুষ বাঁচিবে কী খাইয়া?’

বেগুন - ছবি : সংগ্রহ
‘বেগুনের মণ দুই পয়সা হইয়া গেল। মানুষ বাঁচিবে কী খাইয়া?’ এ উক্তিটি বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। উপমহাদেশের স্বাধীনতার আগে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে একটি দৈনিকে লেখা নিবন্ধে তিনি এই মন্তব্য করেন। মন্তব্যটি পড়েছিলাম সেই সদ্য যৌবনে পা রাখার সময়ে। তখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকে একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধের শুরু ছিল এই উদ্ধৃতি দিয়ে। সেটি কে লিখেছিলেন মনে নেই। তবে কথাগুলো মনে গেঁথে আছে। আর খুলে গেছে চোখের পর্দা। অর্থাৎ একটি ঘটনার বিচারে এর সাথে সংশ্লিষ্ট স্থান-কাল-পাত্রের পরিপ্রেক্ষিত মনে রাখতে হবে সেই বোধটি তৈরি হয়েছিল।
বিভূতিভূষণ যে সময় লিখছেন তখন এক মণ বেগুনের দাম দুই পয়সার কম ছিল। এখন বাংলাদেশে মণ তো দূরের কথা, প্রতি কেজির দামই শত টাকা ছুঁই ছুঁই। বিভূতিভূষণের সময় থেকে কতগুণ বেড়েছে হিসাব করতেও ক্যালকুলেটর লাগবে। কিন্তু এটিই বাস্তবতা। সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে, এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের ছেলেবেলায় গ্রামের সাধারণ নারীর ঘরে পরার শাড়ির দাম ছিল সাত থেকে আট টাকা। এখন সেই মানের একটি শাড়ি কিনতে হলে গুনতে হবে ৫০০-৬০০ টাকা।
এটিকে কেউ অস্বাভাবিক বলবে না। অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তখনই সৃষ্টি হয় যখন স্থানীয় সরবরাহ বা জোগান ঠিক থাকার পরও জিনিসের দাম বাড়ে। যখন মুক্তবাজারের নিয়মবিধি যথাযথভাবে কাজ করে না।
ঠিক এই পরিস্থিতিই এখন দেখা যাচ্ছে পেঁয়াজের দামে। প্রায় তিন মাস হয়ে গেল ৩৫ টাকার পেঁয়াজের দাম ২০০ টাকার ওপরে উঠেছে। একই দরের লবণের দামও সম্প্রতি লাফিয়ে উঠেছিল। তবে স্বস্তি, সেটা স্থায়ী হয়নি। কিন্তু এই ফাঁকে অর্থাৎ পেঁয়াজ-লবণের ডামাডোলে অন্য আরো সব পণ্যের দাম একইভাবে হাইজাম্প দিতে শুরু করেছে। এই প্রবণতা শঙ্কার।
বেড়েছে চাল, তেল, ডিম, আদা, রসুন, ময়দা, মরিচ, হলুদ, মসলা, চিনিসহ বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম। গত সপ্তাহেই এক সংবাদ সম্মেলনে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চাল, ডাল, আটা, তেল, ডিম, পেঁয়াজ, লবণ, শীতকালীন সবজিসহ মোট ২০টি নিত্যপণ্যের মূল্য ‘অসহনীয়’ উল্লেখ করে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে তাগিদ দিয়েছে। পাশাপাশি ভোক্তাস্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় পৃথক মন্ত্রণালয় অথবা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে ক্যাব।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে সামান্য হেরফেরসহ এখন মিনিকেট চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকা, নাজিরশাইল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, আটাশ ৪০ টাকা, ঊনত্রিশ ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, স্বর্ণা চাল ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগেও মিনিকেট ৪১ থেকে ৪২ টাকা, নাজির ৫০ থেকে ৫২ টাকা, আটাশ ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা, ঊনত্রিশ ৩২ থেকে ৩৩ টাকা, স্বর্ণা ২৬ থেকে ২৭ টাকা ছিল। এই সময়ের মধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলা পণ্য যেমন শুকনা মরিচের দাম কেজিতে গড়ে ৫৫ টাকা এবং হলুদের দাম গড়ে ৩৫ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি শুকনা মরিচ মানভেদে ২২০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা দুই সপ্তাহ আগে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা ছিল। এখন হলুদ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকায়, যা আগে ১৬০ থেকে ২০০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি চীনা রসুন ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা ও দেশী রসুন ১৭০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশী পুরনো আদা ২০০ থেকে ২২০ টাকা ও নতুন আদা ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা এবং আমদানি করা আদায় ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা গুনতে হচ্ছে।
সরকারের তরফে দেশের উন্নয়নের নানা ঢাকঢোল জোরেশোরে পেটানো হলেও মনে রাখতে হবে আমাদের কমপক্ষে দুই কোটি মানুষ এখনো অতিশয় গরিব। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ হতদরিদ্র, নিম্ন আয় ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে তাদের জীবনযাত্রায় মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ কঠিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। অনেকে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন যে, সংসার চালাতে না পেরে বউ-বাচ্চা গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার চিন্তা করছেন। অনেকে খাবারের খাতে ব্যয় সঙ্কোচনে বাধ্য হচ্ছেন। তারা সবাই হতাশ ও ক্ষুব্ধ। কিন্তু বোধগম্য কারণেই কেউ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না।
যেসব জিনিসের দাম বেড়েছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে এক শ্রেণীর মুনাফালোভী ব্যবসায়ী অবৈধভাবে লাভবান হচ্ছে। তারা মানুষের পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা স্রেফ জালিয়াতি করে লুটে নিচ্ছে। এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী।
এই পরিস্থিতিতে সরকার কী করছে আমরা জানি না। এটুকু জানি, তারা ভর্তুকি দিয়ে, শুল্ক কমিয়ে, বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে বিদেশ থেকে বিমানে করে পেঁয়াজ আমদানি করিয়েছেন।
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বেশ কয়েকজন আমদানিকারককে ঢাকায় ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বিশেষ বাহিনী। অনেক ব্যবসায়ীর আড়তে বা গুদামে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু পেঁয়াজের দাম কমেনি। এ ছাড়া অন্য যে ২০টি পণ্যের দাম বাড়ছে বলে ক্যাব সতর্ক করেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কী উদ্যোগ নিয়েছে কেউ জানেন না। অথচ মানুষের দম ফুরিয়ে আসছে, নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর দরকার পড়ছে না। দেশের প্রতিটি মানুষ হাড়ে হাড়ে তা অনুভব করছে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, দু-একটি ছাড়া অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এ ক্ষেত্রে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা দেখে অতি মুনাফার সুযোগ নিচ্ছে অন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা। এক কথায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এটি কঠোরভাবে সরকারের দমন করা উচিত। এখন কঠোর পদক্ষেপ না নেয়া হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল আছে। তাই দেশের বাজারে মূল্য স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে সরকারের নজরদারি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রমও দৃশ্যমান হওয়া দরকার।
বছরের শেষ প্রান্তিকে স্কুলে সন্তানদের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শেষে শুরু হবে নতুন সেশনে ভর্তির চিন্তা। ভর্তি ফি, ড্রেস বানানো, বইপত্র কেনাসহ সম্ভাব্য খরচ কোত্থেকে জোগাড় করবেন সে বিষয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। এই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া তাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ঘরে ঘরে বেকারত্ব, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে খরা, শেয়ারবাজারের দুরবস্থা, পরিবহন, বাসাভাড়া ও শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যয়বৃদ্ধিসহ সামগ্রিকভাবে একটি চরম দুরবস্থার কবলে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
সার্বিক পরিস্থিতি দেখে অনেকে এমনও মন্তব্য করেন যে, অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের পেছনে সরকারেরই একটি মহলের বিশেষ মদদ আছে। যেমনটি দেখা গেছে শেয়ারবাজার লুটপাটকারীদের ক্ষেত্রে, ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ক্ষেত্রে, ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির পেছনে। সেক্ষেত্রে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, টাকা বানানো একটি রোগ। কিন্তু এই রোগের প্রতিষেধক না দিয়ে চুপ করে বসে থাকলে কি রোগ ছেড়ে কথা বলবে? নিকট অতীতে ডেঙ্গুর অভিজ্ঞতাও আমাদের তিক্ত। বহু হাঁকডাক, বহু মিটিং-সিটিং, ঝাড়– নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়া, অনেক গবেষণা ইত্যাদির কেবল মহড়াই দেখেছে জনগণ। ডেঙ্গু কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
রাজনৈতিক বিরোধীরা রাস্তায় নেমে স্লোগান দিলে সরকারের অস্তিত্ব খুব ভালো করে টের পাওয়া যায়। টের পাই পুলিশের এবং পেটোয়া বাহিনীর অ্যাকশনে, টিয়ারে, গুলিতে, লাঠিতে, ভুয়া এমনকি আজগুবি মামলায়। জনগণের সঙ্কটে, সমস্যায় সরকারের অস্তিত্ব যেন টের সেভাবে পাওয়া যায় না। দেশবাসীর অনেক দুর্ভাগ্যের মধ্যে সম্ভবত এটিও একটি।