কাশ্মিরে ইসরাইলি নীতি : ফাঁদে পড়ছে ভারত
কাশ্মিরে ইসরাইলি নীতি : ফাঁদে পড়ছে ভারত - ফাইল ছবি
‘আমি বিশ্বাস করি (জম্মু ও কাশ্মিরের) পরিস্থিতির উন্নতি হবে, উদ্বাস্তুদের ফিরে যেতে দেয়া হবে, এবং আপনার জীবদ্দশাতেই আপনারা ফিরে যেতে পারবেন... এবং আপনারা নিরাপত্তা পাবে, কারণ আমাদের কাছে বিশ্বের একটি মডেল রয়েছে।‘
‘আমি বুঝতে পারছি না, কেন আমরা তা অনুসরণ করছিল না। এটি ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যে। ইসরাইলি লোকজন যদি তা করতে পারে, তবে আমরাও তা করতে পারি।‘
উল্লেখিত মন্তব্যটি করেছেন নিউ ইয়র্কে ভারতের কনস্যাল-জেনারেল সন্দীপ চক্রবর্তী। কাশ্মিরি পণ্ডিতদের সামনে করা তার এই মন্তব্য ভারতীয় মিডিয়ায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তবে তার চাকরি বা ক্যারিয়ার কোনো ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েনি। চক্রবর্তী অবশ্যই বুদ্ধিমান লোক এবং তিনি সম্ভবত বিচ্ছিন্ন লোকজনের বাস করা জমি জোর করে দখল করে তাতে উপনিবেশন স্থাপন করার ইসরাইলি নীতিকেই ট্র্যাক ১.৫ প্লাটফর্মের আলোকে মোদি সরকারের গোপন জম্মু ও কাশ্মির নীতির আলোকে সাজিয়ে নিয়েছেন।
এই নীতি প্রয়োগযোগ্য কিনা তা সময়েই বলে দেবে। তবে আমার মনে হয়, নৃশংস ইসরাইলি নীতি কাজ করবে কিনা তা বলার সময় এখনো আসেনি। তাছাড়া পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং কাশ্মিরে একই ধরনের অবস্থা বিরাজ করছে না।
প্রধান পার্থক্য হলো এই যে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরাইলের মতো করেই ভারত সরকার শক্তি প্রয়োগ করলেও কাশ্মিরে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে পরিস্থিতির অবনতিই ঘটেছে। কেউ দ্বিমত পোষণ করছে না যে অর্ধ লক্ষাধিক সৈন্য উপস্থিত হয়েও কাশ্মির উপত্যকায় টেকসই কোনো কিছু অর্জন করতে পারছে না।
উপত্যকায় বাস্তব পরিস্থিতির কারণেই নির্যাতন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে উগ্র পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। গত আগস্টে জম্মু ও কাশ্মিরের মর্যাদা পরিবর্তনের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাতে আসলে বিপুল জয়ের নয়, বরং ব্যর্থতাই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
কনস্যাল-জেনারেল চক্রবর্তী সম্ভবত জানেন না যে ইসরাইল কিভাবে পরিকল্পিতভাবে বাইরের পরিবেশ প্রস্তুত করেছে প্রথমে প্রতিবেশী ও সহানুভূতিসম্পন্ন ও ফিলিস্তিনি স্বার্থে সমর্থন দিতে ইচ্ছুক আরব দেশগুলোকে বশ করে। এই যুক্তি অনুযায়ী, ভারতেরও কি উচিত ছিল না প্রথমে পাকিস্তানকে বশ করা? কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ভারতের জন্য তা হয়নি।
তারপর ইসরাইলের প্রতি পাশ্চাত্যের সমর্থনের কথা বলা যায়। এটাই ইসরাইলকে তার কৌশল বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে। এখানে জটিল আর গভীর শেকর থাকা ইতিহাস কাজ করেছে। পাশ্চাত্য কয়েক শ’ বছর ধরে চলা সেমিটিকবিরোধী পাপ থেকে মুক্তির একটি উপায় হিসেবে ইসরাইলকে সমর্থন দিয়েছে। ফ্রান্সের ড্রেইফাস ঘটনা কিংবা হলুকাস্টে ইহুদিদের হত্যা করার ঘটনাগুলো স্মরণ করা যায়। এর ফলে এমনকি আজও ইসরাইলের কথা বলতে গেলে অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের পা কাঁপতে থাকে। ইসরাইল বেশ কার্যকরভাবে অ্যান্টি-সেমিটিক কার্ড খেলছে। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইল রাষ্ট্রের যেকোনো ধরনের লঙ্ঘনের সমালোচনা করা মাত্র অ্যান্টি-সেমিটিক ধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে। বর্তমানে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যা ইলহান ওমার ও রাশিদা তালেব ও ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন ইসরাইলি লবির কাছে চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন। নির্বাচিত হলে ইসরাইলের সাথে সামরিক সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলে করবিন পাপ করেছেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে শিক্ষিত ভারতীয়দের (ভারতীয় পররাষ্ট্র বিভাগের আমলাসহ) এই ধারণা বিদ্যমান রয়েছে যে ইসরাইলি সংস্থাগুলোর সাথে সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলি লবিতে সওয়ার হওয়া যাবে। এই ভ্রান্ত ধারণার উৎস ‘ইহুদি অর্থের’ প্রভাব নিয়ে অশুভ দাবি। আর এটি সাম্প্রতিক কোনো ধারণা নয়। সেই অটল বিহারি বাজপেয়ির আমলেই এনএসএ ব্রাজেশ মিশ্র যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল-ভারত জোটের কথা বলেননি?
আসল কথা হলো ভারত নয় ইসরাইল। হিন্দু ধর্ম ইহুদি ধর্মের মতো ইব্রাহিমি ধর্ম নয়, ফলে তারা খ্রিস্ট বিশ্বের সাথে যোগ দিতে পারবে না। এটা হলো একটি বিষয়।
দ্বিতীয়ত, হিন্দুদের বিপুল অংশও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নির্যাতিত হয়েছে। তবে তারা অন্যদের হাতে নয়, বরং নিজ ধর্মের সদস্যদের হাতেই। ফলে পাশ্চাত্যের এখানে অনুতাপের কিছু নেই। তৃতীয়ত, ভারতীয়-আমেরিকানরা তুলনামূলক সমৃদ্ধ সম্প্রদায় হলেও ওয়াল স্ট্রিটে তাদের অবস্থান ন্যূনতম পর্যায়ে। অথচ ইহুদি লবির অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে ফিলিস্তিনি আবাসভূমি বা ভূখন্ড দখল করা বা তাতে উপনিবেশ স্থাপন করাটা জম্মু ও কাশ্মিরের পরিস্থিতির মতো নয়। সারকথা হলো, কাশ্মির প্রশ্নে পাশ্চাত্যের মতামত ভারত বা পাকিস্তান কারো পক্ষে নয়। তারা সবসময়ই তৃতীয় মতামতে বিশ্বাসী। অর্থাৎ তারা স্বাধীন ও সার্বভৌম কাশ্মির চায়। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ভাষ্যে সবসময়ই বলা হচ্ছে, তারা কাশ্মিরি জনগণের ইচ্ছাকে আমলে নিতে চায়।
এশিয়ার বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্বাধীন কাশ্মির রাষ্ট্র হবে ওয়াশিংটনের জন্য কৌশলগত সম্পদ। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কাশ্মির উপত্যকায় অ-কাশ্মিরি লোকজনের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের উপনিবেশ স্থাপন মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে ইসরাইল হলো যুক্তরাষ্ট্রের নিজের গড়া কর্মসূচি। ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমা করে দেয়, দেশটির আগ্রাসী নীতিকে আঞ্চলিক কৌশল হিসেবে মনে করে।
কূটনীতিকের মর্যাদাসম্পন্ন এক ভারতীয় কূটনীতিকের জানা থাকা উচিত যে সাহসিকতার একটি বড় অংশ হলো বিচক্ষণতা। কিন্তু চক্রবর্তীর দিকভ্রান্ত অভিমত হিন্দুত্ববাদী প্লাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে করা মেঠো বক্তৃতার মতো। তার বোঝা উচিত ছিল যে এ ধরনের কথা আসলে জম্মু ও কাশ্মিরের মর্যাদা পরিবর্তনের পেছনে মোদি সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তানি অভিযোগও সত্য বলে নিশ্চিত করেছে। পররাষ্ট্র বিভাগের রাজনীতিকরণের ফলে ভালো কিছু কখনোই হয় না।
ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন