ছোট্ট মেয়ের মৃত্যু যেভাবে বদলে দিয়েছিল সাইদ আনোয়ারকে
ছোট্ট মেয়ের মৃত্যু যেভাবে বদলে দিয়েছিল সাইদ আনোয়ারকে - ফাইল ছবি
পারিবারিক বিপর্যয়ে সম্পূর্ণ পাল্টে যায় তার জীবনের গতিপথ। বিদায় জানাতে হয় ক্রিকেটকেও। বিক্ষিপ্ত ক্যারিয়ার সত্ত্বেও সাইদ আনোয়ারকে বলা হয় পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ ওপেনার।
১৯৬৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, পাকিস্তানের করাচিতে তার জন্ম । বাবা ক্লাবস্তরের ক্রিকেটার ছিলেন। তবে তিনি ক্রিকেটকে পরে পেশা হিসেবে নেননি। তিনি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার।
বাবার কাজের জন্য আনোয়ারের শৈশব কেটেছে বিভিন্ন দেশে। ভাগ্যের সন্ধানে তার বাবা পাকিস্তান থেকে সপরিবারে ইরানের তেহরানে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সৌদি আরব। তখন আনোয়ারকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল করাচিতে, দাদুর কাছে।
করাচিতেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি আনোয়ারের। তবে তার ক্রিকেটার হওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
করাচির এনইডি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে কম্পিউটার সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক পাশ করেন সাইদ আনোয়ার। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা যাবেন বলে ভেবেছিলেন তিনি।
পড়াশোনা এবং ঘরোয়া ক্রিকেট চলছিল একসঙ্গে। শেষ অবধি পাল্লা ভারী হল ক্রিকেটেরই। আমেরিকা আর গেলেন না। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে জাতীয় দলে ডাক পেলেন সইদ আনোয়ার। ব্যাটিং-এর পাশাপাশি তিনি পার্ট টাইম বাঁহাতি স্পিনারও ছিলেন। পরে তিনি মিডল অর্ডার থেকে ওপেনিংয়ে যান।
ও ১৯৮৯-র জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক। প্রায় দু’বছর পরে ১৯৯০-এর নভেম্বরে টেস্ট অভিষেক।
মোট ৫৫ টেস্টে সইদ আনোয়ারের রান ৪০৫২। ৪৫.৫২ গড় নিয়ে সর্বোচ্চ রান অপরাজিত ১৮৮। ২৪৭টি ওয়ান ডে ম্যাচে মোট সংগ্রহ ৮৮২৪ রান। ৩৯.২১ গড় সমেত সর্বোচ্চ রান ১৯৪। উইকেট পেয়েছেন ৬টি।
অসুস্থতার কারণে বারবার তার কেরিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতার জেরে তিনি ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান দলে থাকতে পারেননি। ১৯৯০-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৩-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি মাত্র পাঁচটি ওয়ানডে খেলেছিলেন। তার মধ্যে একবারও দুই অঙ্কের রানে পৌঁছতে পারেননি।
১৯৯৬ সালে বিয়ে করেন সইদ আনোয়ার। স্ত্রী লুবনা একজন চিকিৎসক। সে বছরও অসুস্থতায় ব্যাহত হয় তার পারফরম্যান্স। আনোয়ারের চিকিৎসা করেছিলেন তার স্ত্রী। কী অসুস্থতায় ভুগছিলেন তা জানা যায়নি। সুস্থ হয়ে অবশ্য দুরন্ত ফর্মে বাইশ গজে ফিরে আসেন সইদ আনোয়ার।
পেপসি ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপে ১৯৯৭ সালের ২১ মে ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৪ রান করেন সইদ আনোয়ার। প্রচণ্ড গরমে তাঁর পায়ে ক্র্যাম্প ধরে গিয়েছিল। তিনি রানার নিয়ে ইনিংস শেষ করেন। ওই ম্যাচে পাকিস্তানের আর কোনো ব্যাটসম্যান সেভাবে রান করতে পারেননি। পাকিস্তানের মোট রান ছিল ৩২৭। জবাবে, রাহুল দ্রাবিড়ের লড়াকু ১০৭ রান সত্ত্বেও ওই ম্যাচে ভারত ৩৫ রানে পরাজিত হয়।
১৩ বছর ধরে সইদ আনোয়ারের ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড অক্ষত ছিল। জিম্বাবুয়ের চার্লস কভেন্ট্রি-ও এই স্কোর করেন। তাদের যুগ্মরেকর্ড ভেঙে যায় শচীন টেন্ডুকরের ব্যাটে। ২০১০-এ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০০ রানে অপরাজিত থাকেন শচীন।
ভারত-বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সইদ আনোয়ারের পারফরম্যান্স বরাবর অসাধারণ। সব ধরনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তার গড় ৬৪.৩৩, ভারতের বিরুদ্ধে ৪৪.৯২ এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪৭.৯৫। তার ৩১টি আন্তর্জাতিক শতরানের মধ্যে ১৫টি এসেছে এই তিন দেশের বিরুদ্ধে খেলে। ১৯৯৭ সালে তিনি উইজডেন পত্রিকার বিচারে বর্ষসেরা ক্রিকেটার হয়েছিলেন।
২০০১ সালে মুলতানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক টেস্ট জয়। এই টেস্টের শেষ দিনে এক পারিবারিক বিপর্যয়ে এলোমেলো হয়ে যায় সইদ আনোয়ারের জীবন। দীর্ঘ অসুখের পরে মারা যায় তার তিন বছরের শিশুকন্যা, বিসমাহ। এরপর থেকে সইদ আনোয়ারের কাছে জীবনের অর্থই পাল্টে যায়।
ক্রিকেট ছেড়ে সইদ আনোয়ার মন দেন ধর্মপ্রচারে। তাঁর একমাত্র সঙ্গী হয় ধর্মপুস্তক। সন্তানশোক ভুলতে ধর্মের বাণীতেই সান্ত্বনার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি।
২০০৩ সালে আবার ক্রিকেটে ফিরেছিলেন সইদ আনোয়ার। খেলেছিলেন বিশ্বকাপ। তার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজের বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে সইদ আনোয়ারের স্কোর ছিল ৪০ রান। তার আগের ম্যাচ ছিল ভারতের বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচে পাকিস্তান ৬ উইকেটে হারলেও শতক করেছিলেন সাইদ আনোয়ার। সেই রান তিনি উৎসর্গ করেছিলেন মেয়ে বিসমাহর স্মৃতিতে।
১৯৯৬, ১৯৯৯ এবং ২০০৩। তিনটি বিশ্বকাপেই সইদ আনোয়ারের দু্র্দান্ত পারফরম্যান্স ছিল। বিশ্বকাপের ২১টি ম্যাচে তার সংগ্রহ ছিল ৯১৫ রান। গড় ৫৩.৮২।
সাতটি টেস্ট এবং এগারোটি ওয়ানডেতে অধিনায়কত্বও করেছেন সইদ আনোয়ার। তবে অধিনায়ক হিসেবে তিনি সেভাবে সাফল্য পাননি। এখনও অবশ্য সাফল্য-ব্যর্থতা-পরিসংখ্যান থেকে বহু দূরে ধর্মপ্রচারক হিসেবে দিন কাটাচ্ছেন অতীতের এই বিধ্বংসী ওপেনার।