তাদের হাতে আলাদিনের চেরাগ

আলাদিনের চেরাগ - ছবি : সংগ্রহ
রাজনৈতিক দলগুলো কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয় যে, তাদের কোনো প্রাপ্তিযোগের আকাঙ্ক্ষা থাকবে না, অর্থাৎ চাওয়া পাওয়া বলে কিছু থাকবে না। সব দলের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নীতি দর্শন রয়েছে। সেসব আদর্শ নিয়েই দলগুলো নিজ নিজ রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ সাধন করাই উদ্দেশ্য। আর তার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করা অপরিহার্য। তবে এই ক্ষেত্রে অবশ্যই বৈধ পথ-পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনগণের সমর্থন পাওয়াটা এ জন্য অপরিহার্য শর্ত।
আর এই নীতির অনুশীলনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে প্রতিটি রাজনৈতিক সংগঠনকে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকতে হবে। এটা গণতান্ত্রিক চেতনার মূল বিষয়। ক্ষমতার জন্য অবশ্যই জনসমর্থনের পাশাপাশি ব্যক্তিকে সততা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক দলের কর্মনীতি এটাই হওয়া উচিত। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়েই সব দেশের রাজনীতিকেরা তাদের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এখানে যা কিছু বলা হয়েছে তা একটি আদর্শিক অবস্থানের কথা। যদি এ অবস্থান থেকে সরে আসা হয় তবে রাজনীতিতে আর কোনো শুদ্ধতা থাকতে পারে না। এমন অবস্থায় যদি কোনো দল ক্ষমতায় গিয়ে বসে, তার ক্ষমতাচর্চা বৈধতা পেতে পারে না। আর জবরদস্তি শাসন শুধু অনৈতিকতাই নয়, তাতে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকতে পারে না। এমন শাসন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত। তখন শাসকদের জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয়। জনবিচ্ছিন্ন কোনো প্রশাসন কখনোই দেশ ও জাতির জনকল্যাণ করতে পারে না। পরিশেষে এমন প্রশাসনকে অনিবার্যভাবে গণরোষে পড়ে একসময় ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। এমন বিদায়ে সব ক্ষেত্রেই থাকে লাঞ্ছনা।
রাজনীতির এই ‘ব্যাকরণ’কে সামনে রেখে যদি বাংলাদেশের প্রশাসনের অবস্থানটা কোথায়, তা নির্ণয়ের চেষ্টা চলে, তবে অবশ্যই কারো পক্ষে হতাশ বা ক্ষুব্ধ না হয়ে উপায় থাকবে না। রাজনীতি যেমন কোনো দাতব্য বিষয় নয়, তেমনি আসলে এটা কোনো পেশাও নয়। কিন্তু এখন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা ক্ষমতা এবং প্রভাব প্রতিপত্তির দ্বারা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন। এই সম্পদ গড়তে তাদের আর কোনো শ্রম-সাধনার প্রয়োজন পড়ছে না। ক্ষমতাসীন দলের টিকিটেই তাদের ‘আলাদিনের চেরাগের দৈত্য’ সব সম্পদের পাহাড় কাঁধে করে যেন নিয়ে আসে। আর এমন চেরাগের অধিকারী মানুষের সংখ্যা এ দেশে কম নয়। দেশে দুর্নীতির যে হিসাব কষা হচ্ছে, তা যেন কোনোক্রমেই নিছক লোক দেখানো ব্যাপার হয়ে না দাঁড়ায়। এমন সন্দেহের কারণ হলো, যে গতিতে সম্প্রতি দুর্নীতির অনুসন্ধান করা শুরু হয়েছিল তা অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। কোন অদৃশ্য কারণে এমন ঘটছে, তা নিয়েও নানা জল্পনা-কল্পনা। সব মিলিয়ে এমন অস্বচ্ছতা আসলে কোনো সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থার পরিচায়ক নয়। তা দেশের মানুষকে পীড়িত করে তুলছে। আর এটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। যাই হোক, দুর্নীতির অনুসন্ধানে যেসব বরপুত্রের চেহারা প্রকাশ পেয়েছে, তাদের প্রকাশ্য ও বৈধ কোনো পেশা নেই। তাদের অর্থ উপার্জনের একমাত্র উৎস রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টতা। এমন দুরাচার প্রমাণ করে বস্তুত দেশে এখন সুশাসন নেই। সুশাসনের যেসব বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ন্যায়নীতি ও সবক্ষেত্রে জবাবদিহিতা । যে কেউ নীতিবোধ থেকে বিচ্যুত হলে অনিয়ম অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়তে পারে। আর সুশাসন এই বিপথগামিতা বোধ করতে সক্ষম হয় জবাবদিহিতার মাধ্যমেই। প্রতিটি ব্যক্তি এমন জবাবদিহিতার আওতায় এলে তার ভালো-মন্দের সব তৎপরতা এক ধরনের আর্শিতে ভেসে ওঠে। আর তখন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে সমাজে শুদ্ধতা ফিরে আসতে পারে। আজ দেশে সুশাসন নেই, তাই শুদ্ধতার নজিরের অনুসন্ধান করা বৃথা। এ দিকে, নিত্য সব তিক্ত অভিজ্ঞতা মানুষ অর্জন করছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই রাষ্ট্র ও সমাজ এগিয়ে যেতে সক্ষম হয় না।
সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে বিশ্ব একটি বৃহত্তর গ্রামে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি দেশ অন্য যেকোনো দেশের ‘হাঁড়ির খবর’টাও এখন রাখতে সক্ষম। সেজন্য আমাদের হাঁড়ির সব খবরও বিভিন্ন দেশ পুরোপুরি জানে, বিশেষ করে মন্দ খবরই রাষ্ট্র হয়ে থাকে বেশি। আর তাই আমাদের দেশের ব্যাপক দুর্নীতির বিষয় গোটা বিশ্বে ‘মশহুর’। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বিশ্বের আনাচে কানাচে কোথায় কতটুকু দুর্নীতি হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করে থাকে। তারা সময়ে সময়ে এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে। এমন সব প্রতিবেদনের তালিকায় বাংলাদেশের নাম শুধু থাকছেই না, বরং তালিকার শীর্ষেই দেশের নামটি স্থান পেয়ে আসছে। আর দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশের নাম এই তালিকায় সংযোজিত হয়ে আসছে। সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বসভায় আমাদের মানমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়ে এসেছে এবং হতে থাকবে। এমন দেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশীদের গ্লানি বোধ করতে হচ্ছে। আমাদের সমাজে বিশেষ করে যারা রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে জড়িত, তাদের দায়দায়িত্ব পালন করা নিয়ে কোনো জবাবদিহিতা নেই। তারা কতটা সততা ও নিষ্ঠার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করছেন, সে খবর নেয়ার কোনো গরজ কেউ অনুভব করেন না। এসব কারণে সমাজ রাষ্ট্রে যথেচ্ছ দুর্নীতি-অনিয়ম বাধাহীনভাবে প্রসারিত হচ্ছে। দেশে অর্থকড়ি নিয়ে চলছে আত্মসাৎ ও পাচারের মহালীলা। প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে এসব কাহিনী প্রচার প্রকাশ করা হচ্ছে। মনে হয়, বাঁধ ভেঙে পানির স্রোত যেমন সবকিছু সয়লাব করে দেয়, তেমনি দুর্নীতি সব প্রতিবন্ধকতা ভেঙেচুরে ইতোমধ্যেই সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। প্রতিকারহীন এক সমাজে যেন মানুষকে বসবাস করতে হচ্ছে । এখন দেশের প্রতিটি নাগরিক এমন অব্যবস্থার কবলে পড়ে দিশেহারা। সমাজের দুষ্টচক্র জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
এই পরিস্থিতিতেও দেশের উন্নয়ন নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা যখন কোরাস গাইতে থাকেন, তখন সেটা মনে হয় সমস্যাক্লিষ্ট মানুষকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা। উন্নতি হচ্ছে বটে; তবে ভাগ্যবান তারাই যারা বর্তমান সমাজের বল্গাহীন এলোমেলো দশার সুযোগ নিয়ে সব লুটেপুটে নিতে পারছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান এসে কথাই বলে। এসব বিষয়ে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, দেশের মানুষের মধ্যে চরম আয়বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। একশ্রেণীর মানুষ বিত্তবৈভবে ফুলে ফেঁপে উঠছে; আর এর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, তাদের হাল দিনদিন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু করা হয়েছে সেখানে বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য যে, ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পাহাড় সমান অর্থবিত্তের অধিকারী। এসব অর্থ উপার্জনের কোনো বৈধ পন্থা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ক্ষমতার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের এমন অন্যায় অনিয়মের ধারা বহু দিন চলে আসছে। তাই এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, প্রশাসন এতকাল এ নিয়ে নীরব ছিল কেন? এর অর্থ এসব নিয়ে তাদের মৌন সম্মতি ছিল! এসব সমাজবিরোধীকে এভাবেই নিদারুণ আশকারা দেয়া হয়েছে। এখন এর পরিণতি হিসাবে দেখা দিয়েছে নানা ভয়াবহ উপসর্গ। তা ছাড়া ‘উন্নয়ন’ বলতে শুধু বৈষয়িক কিছু অগ্রগতিকেই বোঝায় না। সমাজে বসবাসকারী মানুষের জীবনে শান্তি ও স্বস্তি কতটা বিরাজ করছে সেটাও উন্নয়নের ধারণার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সেদিকে যদি দৃষ্টি দেয়া হয়, তবে এই চিত্র পরিষ্কার হবে যে, দেশের মানুষ আইনশৃঙ্খলার অবনতিজনিত কারণে চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে প্রহর গুনছে। সমাজে নারীরা কেমন রয়েছে, তা বর্তমান সময়ের একটি খুব বড় প্রশ্ন। নারীরা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছেন। তাদের ওপর যৌন নির্যাতনের বহু চাঞ্চল্যকর কাহিনী প্রতিদিন পাওয়া যায়। সমাজে নৈতিকতায় যে দৈন্যদশা এখন, তার পরিণতিই এসব। অথচ বর্তমান প্রশাসন নারীর ‘ক্ষমতায়ন’ নিয়ে সগর্বে বক্তব্য দিয়ে চলেছে। নারীরা এ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। তাই তাদের সব বিষয়েই গুরুত্ব দেয়া দরকার, তাদের নিরাপত্তার সাথে সাথে সব নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
উন্নয়নের সাথে আরো একটি বিষয় সম্পৃক্ত, সেটা ন্যায়পরায়ণতা। ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। কিন্তু আজ জনগণ অনুভব করছে, বিচারহীনতা বিরাজ করছে এবং বিচারের ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ ঘটছে। এমন দীর্ঘসূত্রতার অপসংস্কৃতি সমাজের অপরাধীদের মারাত্মক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে মদদ জোগায়। আর সেই সাথে এমন পরিস্থিতি সমাজে বার্তাই পৌঁছে দেয় যে, প্রশাসন শান্তিশৃঙ্খলা নিয়ে তেমন কিছু ভাবছে না। অথচ এটি সাধারণ কথা, যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা ভিন্ন উন্নয়নের কথা ভাবাই যায় না। অপরাধীদের অপরাধপ্রবণতা এখন যেন প্রতিযোগিতার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাত্রাকে বহুগুণে পেছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে যদি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত পন্থায় এগিয়ে যাওয়া না হয়, উন্নয়নের সব বচন হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। উন্নতি কতটা হচ্ছে সে সম্পর্কে কিছু বলা না হলেও এতটুকু বুঝতে হবে যে, উন্নয়নের একটি শর্ত, দেশের মানুষ অভুক্ত থাকবে না এবং বস্ত্রের সংস্থান হবে। রাষ্ট্রীয় নীতি যা সংবিধানে সন্নিবেশিত রয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিটি মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এসব প্রয়োজন যথার্থভাবে পূরণ হওয়ার পরই উন্নত জীবনের কথা আসতে পারে। নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণে আজো এ রাষ্ট্র সক্ষম হতে পারেনি, এটাই কঠিন বাস্তবতা।
তাই উন্নত জীবন সবাই আকাঙ্ক্ষা করে বটে কিন্তু তার আগে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হবে। উন্নত জীবনের কথা বলে যদি বৈষম্য করা হয়, যেমন কেউ অট্টালিকায় বাস করবে আর কেউ বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করবে, সেটা হতে পারে না কিছুতেই। এ কথা সবার স্মরণ রাখা উচিত যে, এমন বৈষম্য নীতিবোধেরই শুধু পরিপন্থী নয়; আমাদের সংবিধান সুস্পষ্টভাবে এই নির্দেশ দিয়েছে যে, রাষ্ট্র কোনোভাবেই কোনোরূপ বৈষম্যের প্রশ্রয় দেবে না। তাই এমন কিছু ঘটার অর্থ হচ্ছে সংবিধানের বরখেলাপ ভূমিকা রাখা।
রাজনীতির যেসব সংকট তথা অব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিকার জরুরি হলেও দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তার সমাধান আদৌ সহজ নয়। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে শুদ্ধতার চেতনাকে তীক্ষ্ম করা না পর্যন্ত চলমান অবক্ষয় থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন। কেননা এখন যেখানে ক্লেদ ও পঙ্কিলতার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে; সেখানেই আসল ক্ষমতা বিরাজ করছে। তাই নিজেদের এসব ক্লেদ পঙ্কিলতা ঝেড়ে ফেলার পরই কেবল এসব সমাজপতির পক্ষে শুদ্ধ বচন উচ্চারিত হতে পারে। তা না হলে তাদের কথায় কোনো প্রভাব পড়বে না। পরিশেষে বলা যায়, দেশে সুনীতির চর্চা হলেই কেবল অপশাসন দূর হয়ে সুশাসন কায়েম হতে পারে।
ndigantababor@gmail.com