আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাশন : একটি বিশ্লেষণ
-
বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি হলো False equalization বা মিথ্যা সমতাকরণ। এটিকেই অনেকে ‘নিরপেক্ষতা’ হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক এই বিভ্রান্তির কারণেই আমরা বর্তমান করুণ অবস্থায় উপনীত হয়েছি। এর ফলে সত্য-মিথ্যা, ঠিক-বেঠিক নির্ণয়ের নিমিত্তে আমাদের যে সেন্সর, সেটি নষ্ট হয়ে পড়েছে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে সেটিকে নষ্ট করে রাখা হয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৫৫তম জন্মদিন উপলক্ষে আমার ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। এদেশের কথিত নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীকুল এই কাজ কস্মিনকালেও করবেন না। তারা যা করবেন না সে কাজগুলো নিজে একটু বেশি বেশি করি। বুদ্ধিবৃত্তিক এই ফ্যাশনের বাইরে গিয়ে আমার আগের আর্টিকেলটিতে বহুলালোচিত জামায়াতে ইসলামীর নবনির্বাচিত আমিরকেও অভিনন্দন জানিয়েছি। যেসব সংবাদপত্র এবং বুদ্ধিজীবী এমন একটি সুন্দর নমুনার প্রশংসা করতে পারেননি, তারাই আবার বিষয়টি নিয়ে স্বভাবসুলভ হলুদ সাংবাদিকতা করতে লজ্জা পাননি। বারবার বলি, আমাদের পচন ধরেছে মগজে। অথবা এই পচা মগজ নিয়েই আমাদের জন্ম।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের জন্মদিনে, আমার লেখাটিতে কোনোরূপ উচ্ছ্বাসের বাহুল্য ছিল না। কোনো বেহিসাবি প্রশংসাও ছিল না। তাকে নিয়ে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীর তাচ্ছিল্যভাব সম্পর্কে দু-একটি পর্যবেক্ষণ ছিল। তিনি নিজে এখন নানা হওয়ার বয়সে উপনীত হয়েছেন। এর পরও কেউ কেউ তাকে ‘বাচ্চা ছেলে’ হিসেবে দেখতেই পছন্দ করেন। তাদের দেখাদেখি কিংবা তাদের বাতাস পেয়ে এক শ্রেণীর সবজান্তা ও মাত্রাতিরিক্ত জ্ঞানীলোক স্কুলের পণ্ডিত মশাইয়ের স্টাইলে তারেক রহমানকে ‘গর্দভ’ বলে গালি দিতেও কসুর করেন না। এই জ্ঞানীরা আবার নিজেকে সাচ্চা বিএনপি প্রমাণের নিমিত্তে শহীদ জিয়া এবং বেগম জিয়ার প্রশংসা করে নেন। এগুলো ছিল নেহায়েত আমার পর্যবেক্ষণ যা তাৎক্ষণিক পোস্ট করেছি।
আমার সেই স্ট্যাটাসটি ছিল- ‘তারেকফোবিয়া বনাম তারেকবন্দনা এবং আত্মঘাতী তীর’ শিরোনামে। দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধানের জন্মদিনে তাকে নিয়ে এরকম বিচার-বিশ্লেষণ বা গবেষণামূলক রচনা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিষয়টি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাশনের একটু বাইরে পড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে তারেক রহমানের জন্মদিনে দু-একটা কথা বলা আমাদের এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক অস্বস্তির জন্ম দেয়। সংশ্লিষ্ট বক্তা বা লেখকের মতলব নিয়ে সৃষ্টি হয় প্রশ্নের।
সেই পোস্টটিতে যথারীতি অনেকেই মন্তব্য করেছেন। মন্তব্যকারীদের একজন ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় সিনিয়র ভাই। তার মূল বক্তব্য ‘ক্ষমতা বদল হলে লুট বদল ছাড়া আর কিছু হবে না’। অর্থাৎ লুটপাটের অবাধ সুযোগ এক হাত থেকে স্রেফ অন্য হাতে স্থানান্তরিত হবে।
প্রবাসী শিক্ষিত সমাজের বড় একটি অংশ দেশের ব্যাপারে পুরোপুরি নিস্পৃহ হয়ে পড়েছেন। দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলাকে তাদের এই নিস্পৃহতার পেছনে কারণ হিসেবে দাঁড় করান। প্রবাসে যারা চাকরি করে ভালো অবস্থানে আছেন, তারা ফেলে আসা দেশকে নিয়ে একটুও ভাবতে চান না। দেশটি গোল্লায় যাক- তাতে তাদের যেন কিছু যায় আসে না। তন্মধ্যে এই ‘সিনিয়র ভাইটি’ একটু ব্যতিক্রম বলেই মনে হয়েছে। দেশ ও সমাজ নিয়ে তিনি ভাবেন এবং একটা পরিবর্তন কামনা করেন।
একটি জাতিকে যখন অন্য কোনো জাতি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শাসন করতে চায়, তখন সেই শাসক জাতি বা আধিপত্যবাদী শক্তি শাসিত বা দুর্বল জাতির মাঝে নানা হীনম্মন্যতা ঢুকিয়ে দেয়, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’ গ্রহণ করে। এরা আক্রমণ করে জাতির মগজকে। বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাশনের আড়ালে এক ধরনের হীনম্মন্যতা ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে জটিল করতে এবং এক পক্ষকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে লাগাতে সম্ভাব্য সব কিছু করা হয়েছে। বেশ কিছু রাজনৈতিক হত্যা, জঙ্গি আক্রমণ করা হয়েছে; যার উদ্দেশ্য এবং পেছনের কারিগরদের নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে প্রশ্নের। একটি সরকার কখনোই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে চাইবে না। একটি দল কখনোই নিজেদের দলীয় প্রধানকে শেষ করে দিতে চাইবে না। তাহলে কাজটি কে করল? কেন করা হলো? এ রকম অনেক প্রশ্নই জনমনে। এসব প্রশ্নের জবাব যদি এখনো বের করতে না পারি, তবে জাতির কপালে আরো অনেক দুঃখ রয়েছে।
ভালোবাসা এবং ঘৃণা- উভয় দিকে আমরা প্রান্তিকতায় পৌঁছে গেছি। যাকে অপছন্দ করি, তার সম্পর্কে একটি ভালো কথাও শুনতে চাই না। আর যাকে পছন্দ করি, তার সম্পর্কে একটি মন্দ কথাও সহ্য করতে পারি না। সর্বক্ষেত্রে আমাদের এই প্রান্তিক বা এক্সট্রিম মানসিকতার সুযোগ নিচ্ছে ‘তৃতীয় পক্ষ’।
এই মিশন এবং ভিশনকে এগিয়ে নিতে ভালো প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছে। ওই মিশনে বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিনোদন জগতের কিছু সুপরিচিত ও সুন্দর মুখ ব্যবহার করা হয়েছে। তারা এ দেশে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাশন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। সেই ফ্যাশনের বাইরে যাওয়া কথিত শিক্ষিত সমাজের অনেকের পক্ষে কঠিন। এই বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাশন হাউজটি যাকে ঘৃণা করতে বলবে বা ভালোবাসতে বলবে, এই তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ কোনো প্রশ্ন ব্যতিরেকে সেটাই করবে। জাতি হিসেবেও আমরা হুজুগে এবং শর্ট টেম্পার্ড। ইদানীং মনে হচ্ছে, গোল্ডফিশ মেমরিও সম্পন্ন হয়ে গেছে।
‘চিলে কান নিয়ে গেছে’ বললে কানে হাত না দিয়ে প্রথমে চিলের পেছনে দৌড়াই। এমনকি কানে হাত দেয়ার পরও কিছুক্ষণ দৌড়াতে থাকি। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো, একটি বিশ্লেষণী মন তৈরি করা- আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেখানে পুরোপুরি ব্যর্থ। দ্বিতীয় শ্রেণীর একটা শিশুর যে ভূ-রাজনৈতিক জ্ঞান থাকার কথা, এ দেশের মাস্টার্স পাস অনেক লোকের সেই জ্ঞানটুকুও নেই। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকের সেই জ্ঞান ভয়াবহ রকমের স্বল্প। এই জ্ঞান নিয়েই তারা বিশাল নিরাপত্তা গবেষক সেজে বসেছেন এবং একেকজন জাতিকে অদ্ভুত নিরাপত্তার নোসখা দিচ্ছেন!
কিন্তু আমাদের সিনিয়র এ ভাইটি সম্ভবত কিছু ভুল মেসেজ বা ধারণা আমার সেই লেখা থেকে আহরণ করেছিলেন। আমিও কিছু জবাব দিয়েছি। এ ধরনের সামাজিক বিতর্ক বা ডিবেটের মাধ্যমে সমাজ উপকৃত হতে পারে। কাজেই বৃহত্তর পাঠকদের সাথে সেই ভাবনাগুলো শেয়ার করা দরকার মনে করছি।
তিনি বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার এই পালাবদলকে স্রেফ ‘লুটবদল’ বলে মনে করেন। এ ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণকেও খুব বেশি ভুল বলা যায় না। তবে তার এই ভাবনাগুলো False equalization বা মিথ্যা সমতাকরণ থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। এক পাত্রের তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রি, অন্য পাত্রের ৪০ ডিগ্রি। দুটোকেই একই সমান গরম বলে বর্ণনা করলে এ অর্ধসত্য বিষয়টিকে বলা হবে, মিথ্যা সমতাকরণ।
এগুলো খুবই দুর্বল বা ত্রুটিযুক্ত পর্যবেক্ষণ। এখন যদি মনে করেন, পাত্রের সঠিক তাপমাত্রা এবং তারতম্য বলে দিলে কেউ আপনাকে ‘রাজাকার’ বা এজাতীয় আনপ্লিজেন্ট বিশেষণে বিশেষিত করে, তাহলে আপনাকে দিয়ে এই দেশ ও সমাজের কোনো উপকার হবে কি? দেশকে নিয়ে আপনার এই আহাজারি তখন কোনো কাজে আসবে না। দাঁতের এক পাটিতে ব্যথা হলে সেই দাঁতটির চিকিৎসা করতে হবে। এক পাটিতে ব্যথার জন্য দুই পাটির সব দাঁত উপড়ে ফেলা চিকিৎসার সঠিক পদ্ধতি নয়।
ত্রুটিপূর্ণ ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থায় যে লুটপাট হতো এবং এখনকার একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যা হচ্ছে তা পরিমাণ এবং পরিমাপে এক নয়। ১৯৯৬-২০০১ এর লুটপাটের সাথে ২০০১-২০০৬ এর লুটপাটের তুলনা হতে পারে। এটা আমাদের সামগ্রিক নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে হয়ে থাকে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর সংগ্রাম হলো নৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রচেষ্টার যুগপৎ সংগ্রাম। এই চারটির একটিকে স্থগিত বা জব্দ রেখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়ী হওয়া সম্ভব হবে না। যে লোকটি স্ত্রীর চিকিৎসা বা শিশুর খাবারের দুধ সংগ্রহ করতে পারে না তার কাছে নৈতিক উপদেশ অর্থহীন। কাজেই তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা জরুরি মনে করা হয়। বেতন বাড়ালেও ঘুষের পরিমাণ কমেনি, বরং বেড়ে যাচ্ছে। এই স্বভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য সামাজিক বাধা ও জনগণের সচেতনতা জরুরি। আবার রাজনৈতিক দানবদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য একটি শক্তিশালী বিরোধী দল খুবই জরুরি।
কিন্তু ২০০৯-২০১৯ এর লুটপাটের সাথে আগের দু’টির তুলনা করা যায় না। এটি হয়েছে সিস্টেমের কারণে। দুই সিস্টেমে দুই ধরনের লুটেরা বা দানব তৈরি হয়। আগের দানবেরা মানে, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রে সৃষ্ট দানব বা লুটেরারা জানত- যেকোনো সময় জনগণের মুখোমুখি হতে পারে। বর্তমান সিস্টেমে সৃষ্ট দানবেরা সেই ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। এ পার্থক্যটি বোঝা মানে, লুটপাটকে মেনে নেয়া নয়; বরং সব লুটপাট চিরতরে বন্ধ করতে এই পার্থক্যটি উপলব্ধি করা জরুরি।
আমাদের দেশকে নিয়ে তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি আলোচনায় আনতে পারি। প্রথমটি হলো, একটি আইডিয়াল বা আদর্শ কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। নিজের দেশকে সবাই এই অবস্থানে দেখতে চান। এটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা; যেখানে সর্বক্ষেত্রে আইনের শাসন বজায় থাকবে। মানুষের পূর্ণ বাকস্বাধীনতা থাকবে। ক্ষুধা, বঞ্চনা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, মত প্রভৃতি নির্বিশেষে সব মানুষের মৌলিক অধিকার থাকবে সংরক্ষিত। এটি হবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। প্রতিটি মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের পাহারাদার হবে রাষ্ট্র। এটি কোনো কাল্পনিক কাঠামো নয়। অনেক দেশই এ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। তাই নিজেদের দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকত্ব ত্যাগ করে সেসব দেশে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হতেও অনেকে আগ্রহী।
দ্বিতীয় পরিস্থিতি হলো প্রথমটির ত্রুটিপূর্ণ অবস্থান। অর্থাৎ ওপরের কিছু আছে, কিছু নেই। এটিকে বলা হয় ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক’ দেশ। এই পর্যায়েই আমরা ছিলাম এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক একটা মেকানিজমের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটা সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনকালও এই ক্যাটাগরিতে পড়ে।
তৃতীয় পরিস্থিতি হলো, স্বৈরশাসককবলিত দেশ বা একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক দেশ। অনেকের অভিমত, বর্তমানে এ পরিস্থিতিতে দেশটি রয়েছে। বিভিন্ন গ্লোবাল ফোরামেও আমাদের অবস্থান ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ থেকে একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক দেশের পর্যায়ে নেমে এসেছে।
ওপরের এক নম্বরে উঠতে গেলে প্রথমে আমাদের অবশ্যই দুই নম্বরে ফিরে যেতে হবে। উদ্ধৃত ‘বড় ভাই’সহ দেশের বিরাটসংখ্যক জ্ঞানী মানুষ এই ভয়ঙ্কর জাম্প দেয়ার চিন্তাভাবনা করেন। এর ফলে এই তিন নম্বর দানবের স্থায়িত্ব অনেক দীর্ঘ হয়ে পড়ছে। তবে দুই নম্বর দানবকে অস্বস্তির সাথে গ্রহণ করা জরুরি, প্রথম অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য। এভাবে যারা চিন্তাভাবনা করেন, তারা সবাই লুটেরা বা তাদের সহযোগী নন। এটাই প্রাকটিক্যাল বা সহজাত পদ্ধতি। এই পদ্ধতি রেখে অন্য পদ্ধতিতে তিন থেকে এক নম্বরে জাম্প দেয়ার ভাবনা আত্মবিধ্বংসী ছাড়া অন্য কিছু নয়। তবে এর মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র টিকে থাকতে সহায়তা করা হচ্ছে। এ বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি বোঝা যাবে, ততই মঙ্গল।
বড় ভাই জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তার জাহাজের উদাহরণ দিয়েও বিষয়টি বোঝানো সম্ভব। জাহাজকে নিরাপদ চলাচলের জন্য অনেক মেরামত ও উন্নয়নের কাজ করতে হয়। চলার পথে জাহাজের কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রথমে একটি নিরাপদ জায়গা খুঁজে নেন। যেখানে স্রোতের তীব্রতা কম, বাতাসের বেগ কম এবং নেভিগেশনাল হ্যাজার্ড বা অন্যান্য বিপদও কম। অর্থাৎ মোটামুটি একটা কমফোর্ট জোনে রেখেই জাহাজকে অধিকতর নিরাপদ বানানোর রিপেয়ারগুলো করতে হয়।
তেমনি জাহাজরূপী রাষ্ট্রের আপগ্রেডেশন বা রিপেয়ারের জন্য নিরাপদ জায়গা হলো দুই নম্বর পরিস্থিতি। প্রথমে সেই জায়গায় নিতে হবে এবং পরে রিপেয়ার বা আপগ্রেডেশন করতে হবে। জাহাজকে বিপজ্জনক জায়গায় নোঙর করে আপগ্রেডেশন করার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে ভালো করে উপলব্ধি করবেন। তেমনিভাবে রাষ্ট্র নামক এত বড় জাহাজ যার যাত্রী সংখ্যা ১৭ কোটি, তাকে একটি ভয়ঙ্কর জায়গায় রেখে রিপেয়ারের ভাবনা কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ? যে রিপেয়ার বার্থটি আমরা সৃষ্টি করে ফেলেছিলাম, সেখান থেকে জাহাজটিকে বের করে ফেলা হয়েছে। এই দুই নম্বর জায়গা থেকে তিন নম্বর জায়গায় নেয়ার পেছনে যে বিচারক মূল ভূমিকা রেখেছেন, তাকে নিয়ে ‘জাতির বিবেক’রা আজ কোনো কথা বলছেন না কেন? অথচ জাতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর কাজটি এই ভদ্রলোক করে গেছেন।
সবারই স্মরণে রয়েছে যে, ২০০৬ সালে যে সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, সে সাধারণ নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে পারবে না- এই সন্দেহে বিচারপতি এম এ আজিজের বিরুদ্ধে সুশীলসমাজ এক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আর আজ গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে পুরো লুটতন্ত্র কায়েম করলেও সেই সুশীলরা ‘শীতনিদ্রা’য় চলে গেছেন।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে সব জঙ্গি হামলার জন্য তখনকার সরকার কিংবা একটি ভবনকে দায়ী করা হয়। একই যুক্তি অনুসারে আওয়ামী লীগের সময়ে সংঘটিত জঙ্গি হামলার জন্য কাকে দায়ী করা উচিত? কিন্তু এবার আগের যুক্তি পাল্টিয়ে ফের এই কাজে মদদ দানের জন্য সেই ‘বিএনপি-জামায়াত’ যুগলকেই দায়ী করা হয়!
এত দিন যারা নিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেছেন, এই ভেল্কিবাজি দেখে, সেই তারাও চুপ মেরে গেছেন। উচিত নয় মতলববাজ হওয়া। এরা দেশের ম্যুরাল ব্রিগেডের স্ট্যাম্পগুলো দখল করেছিল। মূলত তাদের ভূমিকার কারণেই দেশ বর্তমান পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক প্রতিরোধ সৃষ্টি না করায় পুরো দেশই আজ মহাসঙ্কটে। জাতি হিসেবে এটি চরম দুর্ভাগ্যের।
আধিপত্যবাদী শক্তি অত্যন্ত সুচতুরভাবে এই সিভিল সোসাইটি সৃষ্টি হতে দেয়নি; বরং এই সোসাইটির আদলে সে শক্তির স্বার্থরক্ষার্থে একটা শ্রেণী তৈরি করা হয়েছে। তারা জাতির নানা আবেগকে দখল করে সেগুলোর অপব্যবহার করেছেন। যেমন- ‘স্বাধীনতার চেতনা’র আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করা হচ্ছে। কোনো প্রজেক্টের উপযোগিতা থাকুক বা না থাকুক, সেটাকে কোনোভাবে ওই ‘চেতনা’র সাথে সম্পৃক্ত করতে পারলে যেন জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া যায়। ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি’ ক্ষমতায় চলে আসবে, এই ভয় দেখিয়ে গণতন্ত্রকে নির্বাসিত করে ফেলা হয়েছে, আমাদের সব বোধ ও বিবেককে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে।
জাতির একটা বিরাট অংশ ঘুমিয়ে আছে। যারা সজাগ আছেন, তাদের চিন্তাধারাকে একটু ঢেলে সাজাতে হবে। কিছু মতপার্থক্য থাকবেই। তবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে আজ এক হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
minarrashid@yahoo.com