রাজনীতি : ভেতর থেকে কলকাঠি নাড়েন যারা
মইন উদ্দিন আহমেদ - ছবি : নয়া দিগন্ত
রাজনীতি কতটা ‘জটিল ও কঠিন’, রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিমাত্রই তা উপলব্ধি করতে পারেন। এর কোনো সহজ সমীকরণ নেই। প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তন হতে পারে সিদ্ধান্ত। সময় ও অবস্থার প্রেক্ষটাপটে সিদ্ধান্ত নিতে পারাই রাজনীতির যুৎসই কৌশল। এ কৌশলে যারা বিজয়ী হন; চূড়ান্ত ফল তাদের পক্ষেই আসে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে সিদ্ধান্ত নেয়া ও তা বাস্তবায়নপ্রক্রিয়াটি যত সহজ মনে হয়, আদতে তা নয়। সাংগঠনিক প্রক্রিয়া যেমন নেতাকর্মীদের আকৃষ্ট করবে, তেমনি এর উদ্দেশ্যও হতে হবে জনগণকে পক্ষে রাখা। নেতৃত্বের জায়গাগুলো খুবই কঠিন। কারণ, এখানে শত্রু-মিত্রের ব্যাপার আছে। একটি রাজনৈতিক দলকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে হয় সবার আগে। শত্রু সব সময় বাইরে থাকে না, ভেতরেও থাকে। বাইরের শত্রুকে সহজে চিহ্নিত করা গেলেও ভেতরের শত্রুদের শনাক্ত করা খুবই কঠিন। কেননা এরা পরম বন্ধুবেশে দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। দলের নীতিনির্ধারকদের খুব কাছের লোক সেজে তারা কাজ করে, তাই কারো মনে সন্দেহ হলেও প্রভাবশালীর ভয়ে সে কথা কেউ বলতে সাহস পান না। সর্বোচ্চ নেতৃত্ব যদি তাদের চিহ্নিত করতে পারেন তাহলে রক্ষা; নতুবা প্রভাবশালী নেতাদের জামাই আদরে ছদ্মবেশী এসব শত্রু ঘুণপোকার মতো দলের শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। ফলে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে সব কিছু স্থবির হয়ে পড়ে। অনেক সময় ভেতরের শত্রুর পরামর্শে কাজ করতে গিয়ে দল অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, যা জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ প্রবাদটি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য খেটে যায়। একটি বড় রাজনৈতিক দল যখন হঠাৎ কোনো সমস্যায় নিপতিত হয়; তখনই ভেতরের শত্রু মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন শীর্ষ নেতৃত্ব ভেতরের শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে না পারার ব্যর্থতা দলের মধ্যে দুর্যোগ ডেকে আনে।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে যে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সুযোগে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উদ্দিন আহমেদ কৌশলে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। যদিও সামনে রেখেছিলেন ফখরুদ্দীনকে। সেদিন মইন উদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি, নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের আলটিমেটাম এবং বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান, বিশেষ করে নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের অবস্থান ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে পরোক্ষভাবে ক্ষমতা নিজের দখলে নিয়েছিলেন। অথচ মইন উদ্দিন আহমেদ ছিলেন বিএনপি আমলে নিয়োগ পাওয়া সেনাপ্রধান।
ব্রিটেনের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার বিভিন্ন বাধা উপেক্ষা করে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক সংস্কার এনেছিলেন। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে তিনি মনে করেছিলেন, ট্রেড ইউনিয়ন সংসদীয় গণতন্ত্রকে ব্যাহত করে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি করে। এই বিশ্বাস থেকে তিনি ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা প্রায় ধ্বংস করে ফেলেন। থ্যাচার নীতির কারণে যারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন, আশির দশকে তারা থ্যাচারের পতনে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এ সময় আবাসিক এলাকার রক্ষণাবেক্ষণে পোল-ট্যাক্স নামে তিনি এক নতুন করব্যবস্থা চালু করলে লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় সহিংসতা। তীব্র গণ-অসন্তোষের মুখে ১৯৯০ সালের ১ নভেম্বর ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার গফ্রি পদত্যাগ করলে তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা একে একে সবাই থ্যাচারকে পদত্যাগ করতে বলেন। যার ফলে তার রাজনৈতিক জীবনের যবনিকাপাত হয়। তার কাছে এটি ছিল মন্ত্রিসভার সদস্যদের দিক থেকে বিশ্বাসঘাতকতা, যা মেনে নেয়া তার জন্য কঠিন হয়েছিল। মার্গারেট থ্যাচার এ ঘটনার নাম দিয়েছিলেন ‘এনিমি উইদিন’ বা ভেতরের শত্রু। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাইরের শত্রুকে ভয় পাই না। কিন্তু ভেতরের শত্রুকে ভয় পাই।’ মার্গারেট থ্যাচারের এ কথার সহজবোধ্য অর্থ হলো- কোনো দল ধ্বংস করতে বাইরের শত্রুর পক্ষে সম্ভব না হলে বন্ধুবেশে ভেতরে প্রবেশ করে ক্ষতি করা সম্ভব।
ট্রোজান হর্স বা ট্রয়ের ঘোড়া নামক বিখ্যাত গ্রিক উপকথাটি এখনো ভেতরে লুকিয়ে থাকা শত্রুরা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তার উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ট্রয়ের ঘোড়া হচ্ছে ট্রয় বা ইলিয়ন নগর পতনের গ্রিক উপকথার সাথে জড়িত কাঠের ঘোড়া। কথিত আছে, গ্রিকরা একটি অতিকায় কাঠের ঘোড়া তৈরি করে ভেতরে সৈনিকদের লুকিয়ে রেখে সেটি ট্রয় নগরের কাছে এনে দাঁড় করায়। গ্রিকদেরই সাইনন নামে এক সৈনিক ট্রয়বাসীকে বুঝাতে সক্ষম হয়, ঘোড়াটি গ্রিকেরা রেখে গেছে দেবী এথিনার প্রতি অর্ঘ্যস্বরূপ। তবে এর পেছনে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে। তারা চায় এটিকে ট্রয়বাসীরা ধ্বংস করুক, যাতে দেবী এথিনা ট্রয়ের ওপর ক্রুদ্ধ হয়। আর তা ছাড়া নগরীর অভ্যন্তরে যে এথিনার মন্দির সেখানে ঘোড়াটি নিয়ে গেলে দেবী তো গ্রিকদের বদলে ট্রয়বাসীদের প্রতিই অনুগ্রহ দেখাবেন।
উৎফুল্ল ট্রয়বাসী কাঠের ঘোড়াটি টেনে নিয়ে গেল এথিনার মন্দির চত্বরে। মধ্যরাতে মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের ঘোড়ার পেটের দিকে খুলে গেল একটি দরজা। বেরিয়ে এলো ৫০ জন দুর্ধর্ষ গ্রিক যোদ্ধা, তাদের নেতা মহাবীর ওডিসিয়ুস। তারা পা টিপে টিপে নগরীর মূল ফটকের দ্বার খুলে দিলে বাইরে অপেক্ষমাণ গ্রিক বাহিনী ঢুকে পড়ল ঘুমন্ত নগরীতে। তারা বিভিন্ন ভবনে একসাথে আগুন লাগিয়ে দিলো, পরাজিত হলো ট্রয়বাসী। এক সময় ইউরোপ মহাদেশের সবচেয়ে সম্পদশালী ট্রয় নগরী এক রাতের মধ্যে পরিণত হলো ধ্বংসস্তূপে। দশ বছরের যুদ্ধে যা সম্ভব হয়নি, সেই দুঃসাধ্য সাধন হলো এক ধাপ্পায়।
ইতিহাস সাক্ষী, বহু শাসকের পতন ঘটেছে তাদেরই কাছে বন্ধুরূপে লুকিয়ে থাকা শত্রুর কারণে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কথা তো হরহামেশাই মানুষের মুখে শোনা যায়। এ ধরনের শত্রুরা হয় ক্ষমতাসীনদের নিয়োজিত এজেন্ট অথবা ক্ষমতাসীনদের সাথে আঁতাত করে নিজের ফায়দা হাসিল করতে গোপনে সংবাদ আদান-প্রদানের কাজে নিয়োজিত থাকে। এরা দলের নীতিনির্ধারকদের অতি আপনজন হয়ে খুব সহজে গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করে থাকে। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকার পরও অনেক সময় এসব শত্রুর কারণে দল নিজস্ব সিদ্ধান্তকে ফলপ্রসূ করতে পারে না।
কিছু নেতাকর্মী আছে, যাদের দুঃসময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না; অথচ দলের পদ-পদবি বা নীতিনির্ধারক হওয়ার জন্য সবার আগে তারাই নিজেদের যোগ্য মনে করে সামনের কাতারে থাকার চেষ্টা করে। না পাওয়ার মান-অভিমান তাদের অনেক বেশি। ঠুনকো কারণে তারা দল ত্যাগের হুমকি দিয়ে দলকে বিপর্যয়ে ফেলার ভয় দেখায়। অথচ তারা তাদের সেফ জোনে বা নিজেদের সম্পদ রক্ষায় ক্ষমতাসীনদের সাথে আঁতাত করে নিজ দলের সাথে এক ধরনের ব্লেইম গেম খেলে নিজেকে সাধু প্রমাণের চেষ্টা চালায়।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রয়োজন প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা। গভীর চিন্তা করে পরিকল্পনা তৈরি করা এবং তা যাতে সফল হয় সে পন্থা নিশ্চিত করতে বিশ্বস্ত নীতিনির্ধারক প্রয়োজন। সংখ্যায় বড় হওয়ার চেয়ে বুদ্ধিতে বড় হলে বেশি সাফল্য পাওয়া যায়। বন্ধুরূপে শত্রুর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দলীয় পর্যবেক্ষণ এবং তা সঠিক ধারায় মূল্যায়ন করতে হবে। তবে সিদ্ধান্তের জায়গায় শীর্ষ নেতৃত্বকে অবশ্যই অটুট থাকতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে সঙ্কট বিরাজমান তা নিরসন করতে এটি একটি উপযুক্ত ওষুধ হিসেবে কাজ করতে পারে।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আরেকটি বড় সঙ্কট হলো নেতা নির্বাচন করা। অনেক ক্ষেত্রেই চুজ অ্যান্ড পিকের ওপর নির্ভর করে নেতা নির্বাচিত করার কারণে যোগ্য ও ত্যাগী নেতারা আসতে পারেন না। ফলে দলও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভয়ঙ্করভাবে। অনেক ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়ায় শত্রুকেও দলের নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়, যারা দলের কর্মসূচি সফল করার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বেশি উদগ্রীব থাকে। এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের সহজ উপায় হলো, গোপন ব্যালটের মাধ্যমে দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচন। এই পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচন করলে এক দিকে যেমন সঠিক নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে; তেমনি চুজ অ্যান্ড পিকের আশঙ্কা থাকবে না। আলোচনার শেষ পর্যায়ে বলতে চাই, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার স্বাধীনতার সোনালি সূর্য পরাধীনতার আকাশে অস্তমিত হয়েছিল মীর জাফরের মতো একজন বিশ্বাসঘাতককে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বাস করার ভেতর দিয়ে। মীর জাফরের মতো বিশ্বাসঘাতকেরা এখনো মরে যায়নি; বরং সংখ্যায় অনেক বেড়েছে। অনেক বেশি কৌশলী হয়ে ক্ষতি করার চেষ্টায় রত আছে। তাই এ ধরনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা শত্রুর হাত থেকে দল ও দেশকে বাঁচাতে অনেক বেশি কৌশলী এবং দক্ষ না হলে চলবে না।
লেখক : সাবেক ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়