অমিত শাহ : পোস্টার-কর্মী থেকে যেভাবে সেকেন্ড ম্যান
অমিত শাহ -
নির্বাচনে আবারো জয়ের পর উল্লসিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের উপনিবেশ আমলের পার্লামেন্টে গিয়ে অন্যান্য আইনপ্রণেতার সাথে মিলে তার ডানে থাকা লোকটিকে অভিনন্দিত করেন।
সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন অমিত শাহ। তিন দশক ধরে তিনি মোদির সেনাপতি হিসেবে কাজ করছেন। ওই সময়ই তিনি আগ বাড়িয়ে সমসাময়িক ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ঘোষণাটি দেন : সরকার শিগগিরই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল কাশ্মিরের প্রায় সাত দশকের স্বায়াত্তশাসনের অবসান ঘটাবে।
শাহ ঘোষণা করেছিলেন, আমাদের ৫ বছর সময় দিন, আমরা দেশকে সবচেয়ে উন্নত দেশে পরিণত করব। আগস্টের প্রথম দিকে ঐতিহাসিক বক্তৃতাটি যেভাবেই হোক না কেন, তা অমিত শাহের জন্য বিপুল সমারোহে আত্মপ্রকাশের মুহূর্ত হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি পর্দার অন্তরালে ভারতের সবচেয়ে সফল রাজনৈতিক কৌশলবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এবার তিনি হিন্দুদের স্বার্থ এগিয়ে নেয়ার মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির দীর্ঘ দিনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আরো উচ্চ পদে সমাসীন হলেন।
একক হিন্দু পরিচিতি সৃষ্টির মাধ্যমে আরো কয়েক দশক বিজেপিকে ক্ষমতায় রাখার লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ। তবে এতে ভারতের সেক্যুলার গণতন্ত্রের চরিত্র মৌলিকভাবে বদলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সফল হলে একদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির (৬৯) স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন অমিত শাহ (৫৫)।
ওয়াশিংটনের উইড্রো উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র এসোসিয়েট মাইকেল ক্লুগম্যান বলেন, শেষে মোদি যখন পদত্যাগ করতে প্রস্তুত হবেন, তখন অমিত শাহ হবেন তার উত্তরসূরি হিসেবে শীর্ষ প্রার্থী। প্রায় এক যুগ ধরে ভারতের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করে আসা ক্লুগম্যান বলেন, তিনি দলের প্রতি গভীরভাবে অনুগত, দলের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিটির ঘনিষ্ঠ।
একেবারে নিম্ন পর্যায় থেকে অমিত শাহের উত্থান। তিনি দলের সামান্য কর্মী হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর (ভারতে এই পদটিকে দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাকরি বলে মনে করা হয়ে থাকে) নির্বাচনী পোস্টার লাগাতেন। মোদির শীর্ষ পদে উঠতে থাকার সময় তিনি তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ফেলেন। ১৯৮০-এর দশকে বিজেপির মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) সদস্য হিসেবে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাতে তাদের সাক্ষাত হয়। উভয়ে ছিলেন আরএসএসের সদস্য।
২০০১ সালে মোদি গুজরাটের নেতা হলে অমিত শাহ পান রাজ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের এক তদন্তে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও তিনটি খুনের নির্দেশ দানের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
অমিত শাহ অভিযোগগুলো অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কারাগারে থাকেন, গুজরাটে নিষিদ্ধ হন। মোদি এখনো মনে করেন, ২০১৪ সালে নির্বাচনে জয়ের জন্য মোদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাকে ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারনার দায়িত্ব দেন।
দলটি রাজ্যের ৮০টির মধ্যে রেকর্ড ৭১টিতে জয়ী হয়। এই জয় রাজনৈতিক মাস্টারমাইন্ড হিসেবে অমিত শাহের অবস্থান মজবুত করে, তাকে অল্প সময়ের মধ্যেই বিজেপির সভাপতি করা হয়। বিজেপি নির্বাচনে জয়ের পর তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে অভিহিত করে খারিজ করে দেয় একটি আদালত। পুরো বিষয়টি তার অবস্থান আরো শক্তিশালী করে।
তবে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস অভিযোগ করে আসছে, অমিত শাহ শাহ ও মোদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছেন, ঘৃণা ছড়াচ্ছেন, পরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করছেন, মানবাধিকারে অবমাননা করছেন।
অমিত শাহকে কারাগারে পাঠানোতে ভূমিকা পালনকারী কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা পালানিপ্পন চিদাম্বরমকে আগস্টে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তিনি এরপর থেকে কারাগারেই আছেন। গান্ধিনগরের কংগ্রেস নেতা নিশিত বিয়াস বলেন, তারা আইনের কোনো তোয়াক্কা করে না। গণতন্ত্রের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই তাদের, এমনকি তারা ঈশ্বরকেও ভয় পায় না। তারা তাই যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এসব কিছুর অবয়ব হলেন মোদি, তবে পেছনে থাকা মস্তিষ্ক হলেন অমিত শাহ।
বিজেপির অভ্যন্তরে অমিত শাহকে শ্রদ্ধা করা হয়, ভয়ও করা হয়। তাকে খুব কমই সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে দেখা যায়। তার অফিস সাক্ষাতকারের জন্য করা লিখিত অনুরোধের জবাব দেয় না। তিনি নির্বাবনে কখনো হারেননি। গত মে মাসে বিজেপির সর্বশেষ জয়ে তিনিই ছিল মূল অবলম্বন। তিনি নিজস্ব স্বাধীন রাজনৈতিক গবেষণা পরিচালনা করেন বলে জানা যায়। এর ফলে স্থানীয় নেতাদের চেয়ে তিনিই পরিস্থিতি বেশি জানেন বলে দেখা যায়।
গত এপ্রিলে একটি রাজ্যের নির্বাচনের সময় বিজেপির কর্মীরা আবিষ্কার করে যে দলের ক্রমপরম্পরার বাইরেও একটি বেসরকারি দল কাজ করছে, তথ্য সংগ্রহ করছে, কৌশল প্রণয়ন করছে, গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী শনাক্ত করছে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের দুই নেতা বলেন, পরে দেখা গেল যে তারা আগের চেয়ে বেশি আসন পেয়েছেন।
অমিত শাহের জীবনী রচয়িতা ও তার সাথে অনেক সময় অতিবাহিতকারী বিজেপির সদস্য অনির্বান গাঙ্গুলি বরেন, তিনি চরমভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পটু। তিনি দ্রু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন, পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে পারেন। তিনি কখনো অনিশ্চয়তাপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখেন না।
কাশ্মিরের স্বায়াত্তশাসন বাতিলের সিদ্ধান্তে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, অন্তত জানুয়ারি থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। অমিত শাহ ১ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাযিত্ব গ্রহণের পর প্রস্তুতি জোরদার হয়।
এই পরিকল্পনাতেই সেখানে আরো সৈন্য পাঠানো হয়, স্থানীয় রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করা হয়, ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, চলাচল সীমিত করা হয়। তিন মাস পরও বিধিনিষেধগুলো পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়নি। অমিত শাহ জ্বালাময়ী ভাষা প্রয়োগ করেও হিন্দুদের সন্তুষ্ট করে থাকেন। তিনি সেপ্টেম্বরে এক নির্বাচনী সমাবেশে ভারতে বসবাসকারী মুসলিম অভিবাসীদেরকে ‘আমাদের চাকরি খেয়ে ফেলা উইপোকা’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি চলতি মাসের প্রথম দিকে পার্লামেন্টে বলেন যে বিজেপি দেশব্যাপী এনআরসি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে অবৈধ মুসলিম অভিবাসীদের নির্মূল করার জন্য। প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অমুসলিম অভিবাসীদের নাগরিকত্ব মঞ্জুর করার জন্য সংবিধানের সংশোধনেও তিনি সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। অমিত শাহের মুসলিমবিরোধী বাগড়ম্বড়তা আঞ্চলিক দেশগুলো ও বৃহত্তর বিশ্বে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে মনে করেন প্যালানক্স অ্যাসিন্টের ভূরাজনৈতিক গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক আলেক্সান্ডার সেহমার। তিনি বলেন, পাশ্চাত্যে অমিত শাহ তেমন বড় রাজনৈতিক ব্যক্তি নন। তবে তার কুখ্যাতি সরকারে তাকে আরো বড় ভূমিকার দিকে ঠেলে দেবে।
অমিত শাহের পরবর্তী এজেন্ডা সম্ভবত অযোধ্যায় হিন্দু দেবতার জন্য রাম মন্দির নির্মাণ ও সব ধর্মের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি আইন প্রণয়ন। অমিত শাহই সম্ভবত হিন্দু জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত আরো পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করবেন, আর নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত অর্থনৈতিক সংস্কার ও বিশ্বপর্যায়ে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিরাজ করবেন। তবে বিজেপির মধ্যেই সংশয়হীনভাবেই বলা যঅয়, তারা এক সুরে কথা বলে।
বিজেপির আইনপ্রণেতা ও মোদি সরকারের সাবেক মন্ত্রী সত্য পাল সিং বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পর তিনিই শেষ কথা। অমিত শাহের কাছ থেকে কিছু এলে সেটা বাস্তবায়ন করতে হয়। আমরা সবাই তা জানি।
ব্লূমবার্গ