দেশী সমস্যার বিদেশী সমাধান! সমস্যায় গোতাবায়া
গোতাবায়া রাজাপাকসা - ছবি : নয়া দিগন্ত
শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা অন্য যেকোনো নেতার মতোই প্রবল ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। কিন্তু উল্লেখ করার মতো একটি বিষয় হলো এই যে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক যেটাই হোক না কেন তার ঘরোয়া সমস্যাগুলোর বিদেশী মাত্রাও রয়েছে।
সেই ১৯৮০-এর দশক থেকে শ্রীলঙ্কার রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হলো ঘরোয়া ইস্যুগুলোর আন্তর্জাতিককরণ। আর তা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রবৃদ্ধি বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এটা সঙ্ঘাতের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এটি দেশের, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর অর্থনৈতিক অবরোধকে ডেকে আনে।
সিরিসেনা-বিক্রমাসিঙ্গে অকার্যকর সরকার গোতাবায়ার ওপর স্থবির একটি অর্থনীতি চাপিয়ে দিয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.২ ভাগ। সরকারি ও বেসরকারি- উভয় খাতেই বিনিয়োগের অভাব রয়েছে। ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স সবসময়ই নাজুক এবং মাত্র ৩ ভাগ লোক সরাসরি কর দিয়ে থাকে। মোট ৫৫.৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের বোঝা রয়েছে। দেশের রফতানি ঝুড়ি সীমিত। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারও সীমিত। আবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে পাশ্চাত্যের অবরোধের হুমকি রয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইতোমধ্যেই জিএসপি-প্লাস ছাড় স্থগিত করেছে।
মহিন্দা রাজাপাকসার আমলে (২০০৫-২০১৪) গোতাবায়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী হিসেবে সফল প্রশাসক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ওই সময় শ্রীলঙ্কা অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখেছিল। গোতাবায়ার সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা রয়েছে। এটি তার অভ্যাসগত বিরামহীনতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করবেন। তবে তাকে তামিল-সিংহলার পাশাপাশি সিংহলা-মুসলিম ইস্যুগুলোও মোকাবিলা করতে হবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এসব ইস্যু সামনে এসেছে। সিংহলাদের ভোট ব্যাপকভাবে পেয়েছেন গোতাবায়া। আর তামিল ও মুসলিম ভোট পেয়েছেন বেশি তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমাদাসা। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা জাতিগত কার্ড যেভাবে খেলেছেন, তা গোতাবায়ার জন্য অস্বস্তির কারণ হয়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে তিনি যে চাপের মুখে পড়বেন,তা মোকাবিলা করা সহজ হবে না। এর জের ধরে চাপের মুখেই পড়বেন বলে মনে করা হচ্ছে।
আবার শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক নেতাদের অভ্যাস আছে দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে বিদেশী দূতাবাসগুলোতে ধর্না দেয়ার। অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ অনেক দিনের ঐতিহ্র। তবে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য শ্বেতাঙ্গা জাতিগুলোর (পর্তুগাল, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও এখন যুক্তরাষ্ট্র) হস্তক্ষেপ সবচেয়ে ক্ষতিকর।
সংখ্যালঘু তামিলরা প্রথমে তাদের ইস্যুটিকে আন্তর্জাতিকীকরণ করে আঞ্চলিক স্বায়াত্তশাসন বা স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য। সিংহলিদের বিদেশে কোনো মদতদাতা নেই। ফলে তারা ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়। তারা হয়তো বিদেশী চাপের কারণে কোনো চুক্তি করে, কিন্তু নানা অজুহাতে তা বাস্তবায়ন করতে চায় না।
তবে এর ফলে সার্বিক পরিস্থিতি সুখকর হয় না। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক উভয় স্থানেই শ্রীলঙ্কা বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা খুইয়েছে। কোনো চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া মানে সমস্যার নিরসন হয়নি। ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া তামিল ইস্যুটি নিয়ে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (টিএনএ)। এ কাজে তারা ভারত ও পাশ্চাত্যের সমর্থন পেতে চাইছে।
আর সেখানে শ্রীলঙ্কাকে অপদস্থ করার জন্য পাশ্চাত্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। ২০০৯ সাল থেকে পাশ্চাত্য সেটা করেও যাচ্ছে। বিশেষ করে গৃহযুদ্ধ সময়কার কথিত যুদ্ধাপরাধ অভিযোগগুলো নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য দেশটির ওপর বেশ চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আবার অপরাধীদের বিচার করার জন্য বিদেশী বিচারক ও আইনজীবী নিয়োগের চাপও রয়েছে। তাছাড়া সন্ত্রাস দমন আইন পিটিএ বিলোপের দাবিও আছে।
চীনের প্রবেশ
মহিন্দা রাজাপাকসার আমলে ওয়েস্ট-ইস্ট সি লেনের পাশে থাকা হাম্বানতোতা বন্দরটি নির্মাণের দায়িত্ব চীনকে দেয়ার ফলেও পাশ্চাত্যের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, হাম্বানতোতা বন্দরটি হলো চীনের মুক্ত বিশ্বকে ঘিরে ফেলার মুক্তার মালা পরিকল্পনার অংশবিশেষ। পাশ্চাত্য দাবি করছে, ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নিয়ে আজ হোক, কাল হোক এই বন্দরটিকে চীন তার নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে পরিণত করবে। আর এর মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের পশ্চিম অংশে চীনা প্রাধান্যের সৃষ্টি হবে।
চীনকে সংযত রাখার জন্য বিক্রমাসিঙ্গে সরকারের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে আশা করেছিল শ্রীলঙ্কা স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট (সোফা) চুক্তি করবে। এই চুক্তির মানে হলো, মার্কিন সামরিক বাহিনী শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোতে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে পারবে এবং শ্রীলঙ্কায় কোনো অপরাধ করলে তাকে এই দেশে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না। এটি শ্রীলঙ্কার সংবিধানের সুস্পষ্ট পরিপন্থী।
এখন গোতাবায়া ক্ষমতায় আসার ফলে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত যুদ্ধাংদেহী অবস্থান গ্রহণ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইও জানিয়েছেন, শ্রীলঙ্কায় সুশাসন, ন্যায়বিচার বিকাশ, সমন্বয় সাধন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতির জন্য সহযোগিতা করতে চায়।
ভয়েজ অব আমেরিকার মতে, পম্পেইও চান, গোতাবায়া তার নিরাপত্তা বাহিনী সংস্কার করুন। এর মানে হলো, কথিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের আওতায় আনা। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের মধ্যে এটি গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, তিনি গ্রেফতারকৃত সৈন্যদের মুক্তি দেবেন। সৈনিকদের গ্রেফতার বাহিনীর মনোবল ভয়াবহভাবে ভেঙে দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভারতের সাথে সম্পর্কই হবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গোতাবায়া অবশ্য প্রকাশ্যেই বলেছেন, তার সরকার ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, এমন কিছুই করবে না। তিনি শিক্ষা খাতসহ বিভিন্ন খাতে ভারতীয় বিনিয়োগকে স্বাগত জানান। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও চায় জাতিগত সমন্বয় সাধন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সে ইউএনএইচআরসিতে বা অন্য কোথাও চাপ সৃষ্টি করবে না।
তবে শ্রীলঙ্কা সরকার তামিলদেরকে গ্রহণযোগ্য পথে খাপ খাইয়ে নেয় কিনা তা নিয়ে চিন্তায় আছে ভারত। ভারতের প্রধান উদ্বেগের বিষয় হবে চীনের অবস্থঅন ও শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগের সুযোগ। ভারত সম্ভবত বন্ধুত্বপূর্ণ পথেই তার স্বার্থ আদায় করার চেষ্টা করবে। চীন সম্ভবত শ্রীলঙ্কার একক বৃহত্তম বিনিয়োগকারী ও অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে তহবিল প্রদানকারী হিসেবে বহাল থাকবে। অবশ্য হাম্বানতোতা বন্দর ইজারার মেয়াদ ৯৯ বছর থেকে কমানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই চীনের কাছে।
গোতাবায়া ভারতের ভারত শক্তি পত্রিকাকে বলেছেন, আমাদের জনগণ এই চুক্তি পছন্দ করছে না। বন্দরের মতো স্ট্র্যাটেজিক জাতীয় সম্পদ শ্রীলঙ্কার হাতেই থাকা উচিত। গোতাবায়া জয়ের পরপরই চীন তাকে স্বাগত জানায়নি, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাকে শ্রীলঙ্কা যে বিআরআইয়ের অংশ, তা মনে করিয়ে দিতে একটু বিলম্ব করেন। শি আশা করেন, চীন-লঙ্কা সম্পর্ক ‘পারস্পরিক আস্থার’ ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। তিনি আরো বলেন, চীন-শ্রীলঙ্কা কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব একটি নতুন অধ্যায়।