বিশেষ মিশনে ৫ মুসলিম দেশ

বিশেষ মিশনে ৫ মুসলিম দেশ - ছবি : সংগৃহীত
ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ডা: মাহাথির মোহাম্মদ ৫ জাতি মুসলিম ঐক্যের কনভেনশন ডেকেছেন। এতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট উইদোদো ও কাতারের আমির শেখ তামিম আল থানি অংশ নেবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন শতায়ুর কাছাকাছি পৌঁছা প্রবীণ এই মালয়েশীয় সরকার প্রধান।
মাহাথির জানিয়েছেন, এই সম্মেলনে ইসলামী নেতৃবৃন্দ, আলেম ও পণ্ডিতদের নিয়ে নতুন শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করা হবে। এতে ক্রমবর্ধমান ইসলামোফোবিয়াসহ বিশ্বের ১৭০ কোটি মুসলমানের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের কর্মপন্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে। অন্যদের মধ্যে মালয়েশিয়ার অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী আজমিন আলী এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশিও ১৮ থেকে ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য এ সম্মেলনে অংশ নেবেন।
এ সম্মেলনের ব্যাপারে একটি খসড়া কর্মসূচি প্রকাশিত হয়েছে, যাতে উল্লেখ করা হয়, সম্মেলনে আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে থাকবে উন্নয়ন ও প্রবৃব্ধি, খাদ্য সুরক্ষা, জাতীয় পরিচয় সংরক্ষণ এবং সম্পদের সুষম বণ্টনে রাজনীতির ভূমিকা।
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংহতির প্রবক্তা, ৯৪ বছরের মাহাথির জানান, সম্মেলনটি ইসলাম সম্পর্কে এবং মুসলমানেরা যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, সে সম্পর্কে অভিন্ন ধারণা তৈরির একটি সভা হবে। এ ব্যাপারে চিহ্নিত সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান হলো মুসলমানেরা নিজ জন্মভূমি থেকে বহিষ্কৃত হওয়া এবং ‘সন্ত্রাসবাদের ধর্ম’ হিসেবে ইসলামকে অভিযুক্ত করা।
মাহাথির উল্লেখ করেন, কোনো মুসলিম দেশই সম্ভাবনা অনুযায়ী পুরোপুরি বিকশিত হয়নি এবং কিছু ইসলামী দেশ অনেকটা ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ পরিণত হওয়ার অবস্থায় রয়েছে। এর পেছনে অবশ্যই কারণ আছে। আমরা যদি চিন্তাবিদ, পণ্ডিত এবং নেতাদের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারি; তবে আমরা এর কারণ জানতে পারব।
মালয়েশিয়ার বার্নামা বার্তা সংস্থার তথ্য অনুসারে, গত বছর নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে ডা: মাহাথির, পাকিস্তানের ইমরান খান এবং তুরস্কের এরদোগানের সাথে দেখা করার পরে এই শীর্ষ সম্মেলনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন আবদুল্লাহ এবং তার উপসহকারী মারজুকি ইয়াহিয়া শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগতভাবে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাতে ইরান ও ওমানের মতো দেশগুলোতেও গেছেন।
ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন এবং আসিয়ানের মতো প্ল্যাটফর্ম থাকার পরও কেন মালয়েশিয়া একটি নতুন ফোরামের আয়োজন করছে, এমন প্রশ্নের জবাবে মাহাথির বলেছেন, তিনি ‘ছোট্ট সূচনা’তে বিশ্বাসী। এটিকে কার্যকর করার ব্যাপারেও তার দৃঢ়তা রয়েছে। মাহাথিরের মতে, ‘অনেক মুসলিম দেশ নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে এবং তাদের সমস্যার সমাধানে মালয়েশিয়া, তুরস্ক এবং পাকিস্তান, আর একই সাথে কাতার ও ইন্দোনেশিয়ার কিছু বাড়তি উদ্যোগ নেয়ার মতো অবকাশ রয়েছে।
‘সন্ত্রাসবিরোধী’ লড়াইয়ের নামে ইসলাম ও মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘সন্ত্রাসের পরিপূরক’ হিসেবে চিহ্নিত করে ঘৃণা ছড়ানো, মুসলিম দেশগুলোতে নানামুখী সঙ্ঘাত ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা, বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রে বিরোধ নিষ্পত্তি, জ্ঞানবিজ্ঞান প্রযুক্তিতে পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া-সর্বোপরি ফিলিস্তিন, সিরিয়া, কাশ্মির ও রোহিঙ্গার মতো ইস্যুগুলোর শান্তিপূর্ণ উপায় অন্বেষণে এই ঐক্য কাজ করবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হচ্ছে।
দৃশ্যমান বিষয় হলো, মুসলিম রাষ্ট্রকে এই ঐক্যের মধ্যে নিয়ে আসা হয়নি। এ প্রসঙ্গে মাহাথির বলেছেন, সুনির্দিষ্ট ও কার্যকরভাবে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে স্বল্পসংখ্যক সদস্যের উদ্যোগ ও পরিকল্পনা অধিক ফলপ্রসূ হয়। তবে তিনি এর সদস্য সংখ্যা ‘আরো বাড়বে’ বলেও উল্লেখ করেন।
বেশ কিছুদিন ধরে মুসলিম বিশ্বের মধ্যপন্থী দেশগুলোর একটি জোট গঠনের উদ্যোগ আয়োজনের কথা শোনা যাচ্ছিল। প্রাথমিকভাবে তুরস্ক, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়া এই উদ্যোগে সামনের কাতারে ছিল। পরে এর সাথে ইন্দোনেশিয়া ও কাতারকে সংযুক্ত করা হয়েছে। মুসলিম দেশগুলোতে সার্বিক ও আঞ্চলিকভাবে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি জোট। এর মধ্যে বৃহত্তম জোটটি হলো ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)। এর বাইরে সৌদি আরবের নেতৃত্বে মূলত সুন্নি দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি মুসলিম প্রতিরক্ষা জোট রয়েছে। এর বাইরে অনেকটা নিষ্ক্রিয় দু’টি জোট রয়েছে, যার একটি হলো আরব লিগ আর অপরটি উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থা (জিসিসি)। ছয় দেশের সমন্বিত জিসিসি এখন ‘সৌদি-আমিরাত-বাহরাইন’ জোটে পরিণত হয়েছে। এ তিন দেশ মিসরের সাথে মিলে জোটের অন্যতম সদস্য কাতারকে বয়কট করেছে। আর কুয়েত-ওমান তিন দেশের পদক্ষেপগুলোর সাথে একাত্ম না হয়ে অনেকটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে।
অন্য দিকে ওআইসিতে বৃহত্তম মুসলিম দেশগুলোর প্রভাব রয়েছে বিশেষভাবে। এর মধ্যে সৌদি আরবের প্রভাব এখনো অনেক বেশি। তবে এক সময় সৌদি সিদ্ধান্ত ওআইসির সিদ্ধান্ত হতে দেখা গেলেও তেমনটি আর নেই। জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন স্বীকৃতির ইস্যুতে সৌদি ও আমিরাতের নমনীয় ধরনের সিদ্ধান্ত না হয়ে এ ব্যাপারে বেশ সোচ্চার সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়েছে। কাশ্মির ইস্যুতে আরব আমিরাত প্রথম দিকে সরাসরি ভারতীয় অবস্থানকে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু ওআইসির সিদ্ধান্ত এ ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থানের প্রতি সমর্থনসূচক। পরবর্তী সময়ে আমিরাতের প্রকাশ্য বক্তব্য ওআইসির ধারায় চলে আসে। তবে দেশটির গোপন অবস্থান দিল্লির পক্ষে বলেই অনেকে মনে করেন।
প্রায় সব স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র ওআইসির সদস্য হলেও, সংস্থাটি ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কার্যকর ভূমিকা তেমন রাখতে পারেনি। এর অনেকগুলোর কারণের একটি হলো, সংস্থাটির মূল উদ্যোক্তা সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও এর সহযোগী পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর বেশখানিকটা নির্ভরশীল ছিল। ফলে তাদের দেয়া শর্ত ও অ্যাজেন্ডার বাইরে যাওয়া এসব দেশের জন্য হয়ে পড়ে বেশ কঠিন। এই অবস্থার অধিক অবনতি ঘটে ’৮০-এর দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এক মেরুর বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য সৃষ্টির পর। আর মুসলিম দেশগুলোর সার্বিক অবস্থা আরো দুর্বল হয়ে পড়ে ওয়ান-ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে মুসলিমদেরকেই কার্যত প্রধান টার্গেটে পরিণত করার পর। রহস্যজনকভাবে এই সময়টাতে আলকায়েদা ও আইসিসের মতো উগ্রবাদী সংগঠনের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে। এ ধরনের উগ্রবাদী সংগঠন মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে তেমন কোনো গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও বিশ্বব্যাপী গোপন প্রপাগান্ডা চালানো হয় সামগ্রিক মুসলিম জনগোষ্ঠী ও ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে।
মুসলিম দেশের ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো ইসলামোফোবিয়া এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর এই তৎপরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব ফোরামগুলোতে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং তারা ঠিক করে দেয়া অ্যাজেন্ডা কার্যকর করার ক্ষেত্রে বেশি তৎপর। ফলে উম্মাহর স্বার্থ গৌণ হয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, শাসকদের নিরাপত্তা ও ক্ষমতায় থাকা মুখ্য হয়ে ওঠে। এতে ওআইসি এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলোর তৎপরতা একেবারেই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্দ্বন্দ্বে মুসলিম রক্তক্ষয় ও দেশ ধ্বংসকারী কার্যক্রম প্রবল হয়ে ওঠে।
এ ধরনের প্রেক্ষাপটে ডা: মাহাথিরের আহ্বানে পাঁচ জাতির ঐক্যযাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে। মাহাথির মোহাম্মদ এই ফোরামের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছেন; সেই ইস্যুগুলোকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জাতিসঙ্ঘের বিগত সাধারণ অধিবেশনের বক্তৃতায় প্রবলভাবে তুলে ধরেছিলেন। এ সময় তিনি পাকিস্তান, তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার উদ্যোগে ইসলামোফোবিয়া দূর করে উন্নয়ন ও সহযোগিতার স্বার্থে মুসলিম দেশগুলোকে এগিয়ে নিতে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠারও ঘোষণা দেন।
যে কয়েকটি নেতৃস্থানীয় মুসলিম দেশ এ উদ্যোগটি গ্রহণ করেছে, তাদের ইতিবাচক অনেক দিক যেমন রয়েছে, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা শক্তিমত্তা অনেক বেশি। কিন্তু দেশটি অর্থনৈতিক সঙ্কট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি পর্ব অতিক্রম করছে। এ দুই সঙ্কট উত্তরণে রাজনৈতিক সরকার ও প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে বলে মনে হয়। অতীতে নওয়াজ শরিফ ও আসিফ জারদারির শাসনকালে এ দুই পক্ষের মধ্যে লক্ষ্য ও কৌশলের বৈপরীত্যের বিষয় মাঝে মধ্যে প্রকাশ হয়ে পড়ত। ইমরানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সততা বৈশ্বিক ক্ষেত্রেও দেশটির কার্যকর ভূমিকা পালনে সহায়ক হচ্ছে। করাচি উপকূলের অদূরে তেল-গ্যাস ক্ষেত্র প্রাপ্তির কথা জানিয়েছেন ইমরান। সেটি বাস্তবে পাওয়া গেলে পাকিস্তানের অর্থনীতি ঘুরে আবারো দাঁড়াতে পারে।
মাহাথির আগে প্রায় দুই দশক ধরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মুসলিম ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলতেন। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ মালয়েশিয়া এবং এর প্রধান নায়কই হলেন তিনি। পাকিস্তান ও তুরস্কের মতো দেশগুলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দুর্দশা, বিতর্কিত জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে মুসলিম জনগণের সাথে ভারতের আচরণ এবং দীর্ঘকালীন সমস্যা ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব নিয়ে সোচ্চার হওয়ায় মাহাথিরের প্রশংসা করেছে।
গত সেপ্টেম্বরে তিনি জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে ভারত ‘কাশ্মির আক্রমণ ও দখল করেছে’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এতে দিল্লি মালয়েশিয়ার ব্যাপারে বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেছে। কিন্তু এ নিয়ে তিনি চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি। সর্বশেষ নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে, মাহাথির ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করার কারণে ইসরাইলের তীব্র সমালোচনা করে আসছেন। মাহাথির মালয়েশিয়ার ‘হার্ডলাইন’ নীতির স্থপতি, যা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। গত সপ্তাহে ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরাইলি জনবসতিকে অবৈধ হিসেবে দেখার নীতিকে উল্টে দেয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছিলেন তিনি। মাহাথির ২০২০ সালের প্রথমার্ধে আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পারেন। তবুও দেশটির চলমান নীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য আগামী নির্বাচনে শাসক জোট পাকাতান ক্ষমতায় আসতে পারে কি না, নিশ্চিত নয়।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান মুসলিম বিশ্বের আলোচিত নেতাদের একজন। ২০০২ সালে ক্ষমতায় আসার পর একটানা ১৬ বছর ধরে তিনি ওসমানীয় খেলাফতের উত্তরাধিকার বহন করা দেশটির ক্ষমতায় রয়েছেন। তিনি তুর্কি শাসন পদ্ধতিকে উগ্র সেকুলারিজমের ধারা থেকে রক্ষণশীল উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদী ধারায় নিয়ে এসেছেন। প্যান ইসলামিজম পটভূমি থেকে উত্থান হওয়া, এই নেতা মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো রাজনৈতিক ইসলাম ধারার দলগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন। তবে তার নীতির ক্ষেত্রে উগ্রতা বা আপসকামিতা, দুইয়ের কোনোটাই দেখা যায় না। তিনি শক্তিমান মধ্যপন্থী ইসলামিক দেশগুলোর মধ্যে কার্যকর ঐক্যের জন্য অনেক দিন ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। ন্যাটোর সদস্য দেশ হওয়ার পরও এরদোগান রাশিয়ার সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক বজায় রেখে তুরস্কের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিমুখী বিকল্প উন্মুক্ত রেখেছেন। ইরান ও সৌদি আরব, দুই দেশের সাথে তুরস্ক ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। এরদোগানের আরব বসন্তের সমর্থনসূচক পররাষ্ট্র কৌশল ব্যর্থ হয়েছে বলে অনেকে উল্লেখ করে থাকেন। তবে বিষয়টি মূল্যায়নের জন্য আরো কিছু সময় অপেক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
আরব দেশগুলোর মধ্যে কাতার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি সৌদি আরবের ক্ষুদ্র প্রতিবেশী হলেও চার পাশের প্রতিবেশীদের সর্বাত্মক বয়কটের মুখে নিজস্ব কৌশলের ওপর ভিত্তি করে শক্তিমানভাবেই টিকে আছে। দেশটিতে আমেরিকান বিমান ঘাঁটি রয়েছে। তবে রাশিয়ার সাথেও ভালো সম্পর্ক রয়েছে দোহার। ইরানের সাথে রয়েছে অভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র। দেশটির অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্র কৌশলকে বেশ পরিণত বলে ধারণা করা হয়। আরব বসন্তের ব্যাপারে তুরস্কের সাথে কাতার ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। বিনিয়োগযোগ্য বড় অঙ্কের তহবিলের অধিকারী কাতার।
ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ। উইদোদো দ্বিতীয়বারের মতো দেশটির প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। মুসলিম বিশ্বে দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশ ইন্দোনেশিয়া। সৌদি আরবের সাথে রয়েছে জাকার্তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পাঁচ জাতি জোটের অংশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়া অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে।
পাঁচ জাতি জোটের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কার্যকর জোট হিসেবে কাজ করা। এই জোটে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশ ইয়েমেন যুদ্ধের অবসানের জন্য দুই পক্ষের সাথে আলোচনা চালাচ্ছে। সিরিয়া সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের ক্ষেত্রেও তাদের উদ্যোগ রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের তিনটি দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট ফিলিস্তিন, কাশ্মির ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কার্যকর কিছু করতে পারলে জোটভুক্ত দেশগুলো জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে। এই জোটকে সম্প্রসারণের ইঙ্গিত দিয়েছেন মাহাথির। সৌদি আরব বা ইরান এই জোটে আসবে কি না, বলা কঠিন। তবে এ দুই আঞ্চলিক শক্তির সাথে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। জোটভুক্ত দেশগুলো মুসলিম দেশগুলোর মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জটিলতায় না জড়িয়ে সমাধানের আয়োজক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তা অধিক কার্যকর হবে। এর বাইরে সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বাহিনী, কার্যকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহযোগিতা এবং অভিন্ন বাজার ও অর্থনৈতিক এলাকা গঠন করা গেলে, এটি অচিরেই একটি শক্তিমান পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
mrkmmb@gmail.com