কঠিন অবরোধের মুখে পড়বে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী!
কঠিন অবরোধের মুখে পড়বে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী! - ছবি : সংগৃহীত
আশাবাদের ওই বছরগুলো যখন শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসিকে সরকার গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করল, তখন সামরিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক যাত্রার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের আস্থা প্রকাশ করে মিয়ানমারের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কিন্তু এই পদক্ষেপ খুব দ্রুত নেয়া হয়ে গেছে বলে হুঁশিয়ারি ছিল।
সেনাবাহিনীর ২০০৮ সালের খসড়া অনুযায়ী সংবিধানের রক্ষক হিসেবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা অব্যাহত থাকে। অবরোধ প্রত্যাহারের ফলে সামরিক বাহিনীর ওপর চাপ প্রয়োগের গুরুত্ব হ্রাস পায়। আর সামরিক-মিত্র এলিটরা অনেক বছর ধরে সতর্কভাবে অর্থনৈতিক উদারিকরণের প্রধান সুবিধাভোগী হতে ও বিশ্ববাজারের সাথে আবার মিয়ানমারের সম্পৃক্ততায় লাভবান হওয়ার জন্য নিজের অবস্থান সৃষ্টি করেছে।
মিয়ানমার আবার নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। ২০২০ সালে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হবে। কিন্তু ইতোমধ্যেই আশাবাদ একেবারেই মিলিয়ে গেছে। আং সান সু চির সরকারের আমলে সংস্কার স্থবির হয়ে পড়েছে, মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে দেশজুড়েই।
গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে, সশস্ত্র সঙ্ঘাত লাখ লাখ লোকের জীবনে রেখাপাত করেছে, প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠন বিরামহীনভাবেই চলছে। ঔদ্ধত্যপূর্ণ হওয়া সামরিক নেতৃত্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠোর করেছে। আর সরকার এখন পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।
সামরিক বাহিনী ও সরকারের মধ্যে এই সম্পর্ক যারা মিয়ানমারের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াই করতেন, তারা হতাশ হয়েছেন। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর ভয়াবহ নৃশংসতার কথা আং সান সু চি অস্বীকার করেছেন। তার এই অস্বীকৃতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ব্যথিত করেছে।
তথাকথিত সন্ত্রাসদমন অভিযানের সময় পরিচালিত ‘শুদ্ধি অভিযানে’ চরম মাত্রায় সহিংসতা চালানো হয়। নজিরবিহীন মাত্রায় এই নৃশংসতায় ব্যাপক মাত্রায় দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে। এতে করে বাংলাদেশ সীমান্তে বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু শিবিরের সৃষ্টি হয়।
সিনিয়র সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে এখন গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এছাড়া ২০১১ সাল থেকে কচিন ও শান রাজ্যের বিভিন্ন সংখ্যালঘু গ্রুপের বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত ওঠছে।
রাখাইন রাজ্যে চলমান সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের খবর ব্যাপকভাবে উত্থাপিত হচ্ছে রাখাইন রাজ্যে জাতিগত রাখাইন আরাকান আর্মির সাথে সঙ্ঘাতের কারণে। আর আগস্ট থেকে শান রাজ্যে মারাত্মক লড়াই শুরু হয়েছে।
রাখাইনে রাজ্যে এখনো বসবাস করছে, এমন রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকারগুলো অস্বীকার করা হচ্ছে, তাদেরকে কড়া পাহারায় ক্যাম্পে বা প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের ওপর যে ধরনের নির্যাতন চালানো হতো, তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তারা আবারো গণহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এসব সহিংসতার জন্য দায়ীরা দায়মুক্তি পেয়ে নির্যাতনের বিপর্যয়কর চক্র সৃষ্টি করছে। মিয়ানমারে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে রাষ্ট্রের পক্ষে জবাবদিহিতা সৃষ্টি করা অসম্ভব। ফলে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যা লঙ্ঘনের জন্য মামলা দায়ের করেছে গাম্বিয়া। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের তদন্ত পরিচালনা করার অনুমতি দিয়েছে।
আং সান সু চির সমর্থনপুষ্ট সামরিক বাহিনী ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে আরো নৃশংসতা চালানোর হুমকি দিয়েছে। ফলে আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা এড়ানোর জন্য এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। নানা বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে সরকারি তদারকি ছাড়াই সেনাবাহিনী তাদের অভিযান পরিচালনার অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দুটি প্রধান বাণিজ্যিক গ্রুপ মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেড (এমইএইচএল) ও মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন (এমইসি)-এর মালিক। এছাড়া ব্যাংক, পর্যটন, পরিবহন, কারখানা, টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন সহায়ক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ২০১৬ পর্যন্ত অবরোধের মুখে ছিল।
পারিবারিক বা ব্যবসায়িক সম্পর্কের মাধ্যমে মিয়ানমারের অনেক বেসরকারি কোম্পানির সাথে জোরালো সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে সেনাবাহিনী। রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও তারা সহায়তা পেয়ে থাকে। তারা কার্যত স্বচ্ছতাবিহীনভাবেই কাজ করে থাকে।
এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই সেনাবাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত ও সেনাবাহিনীর মালিনাধীন সব কোম্পানির ওপর অবরোধ আরোপ করতে হবে। সেনাবাহিনীর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেলে তাদের সহিংসতা চালানোর ক্ষমতাও হ্রাস পাবে। আর অবরোধ সফল করার জন্য সামরিক-মিত্র এলিটদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তারা যাতে অর্থনীতি থেকে ফায়দা হাসিল করতে না পারে, তাও নিশ্চিত করতে হবে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে নিঃসঙ্গ করার জন্য পরিকল্পিতভাবেই অবরোধ আরোপ করতে হবে। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মিয়ানমারে নিম্নগামী অবস্থার সুযোগটি গ্রহণ করতে হবে। আগে কখনো পদক্ষেপ যদি নাও নেয়া হয়, এখন তা গ্রহণ করতেই হবে।
ইয়াঙহি লি মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ও ইসাবেল টড মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারের গবেষণা সহকারী।
আল জাজিরা