দুই ভাইয়ের শাসনে কী হতে পারে
দুই ভাইয়ের শাসনে কী হতে পারে - ছবি : সংগ্রহ
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় চলতি মাসেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনে শ্রীলঙ্কা পিপলস ফ্রন্টের (এসএলপিপি) গোতাবায়া রাজাপাকসে ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে দেশটির সপ্তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসের ছোট ভাই। গোতাবায়ার প্রতিদ্বন্দ্বী ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) প্রধান সাজিথ প্রেমাদাসা ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। সাজিথ প্রেমাদাসা শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট রানা সিংগে প্রেমাদাসার পুত্র। নতুন প্রেসিডেন্ট দেশটিতে ইতোমধ্যেই পাকাপোক্ত পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। তাই শ্রীলঙ্কায় মনে হয় দৃষ্টিকটু পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তবে দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট পরিবারতন্ত্রের আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে নিজের পরিবারের ক্ষমতাকে সুসংহত ও নিরঙ্কুশ করার জন্য বড় ভাই ও সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজা পাকসেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ- প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, আরেক ভাই চামাল রাজা পাকসেকে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মাহিন্দ রাজাপাকসে পরপর দুই মেয়াদে দেশ শাসন করার সময় তার তিন ভাইকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং সংসদের স্পিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগের কারণেই দেশের জনগণ ২০১৫ সালের নির্বাচনে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু দেশটির জনগণই আবার তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। রাজাপাকসে পরিবার আবার ক্ষমতায় আসার কারণ কী? শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতায় পালাবদলের কারণে দেশটির ভেতরে এবং উপমহাদেশের রাজনীতিতে কি প্রভাব পড়বে? এদিকে গোতাবায়া রাজা পাকসে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর শ্রীলঙ্কায় ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। সংখ্যালঘু মুসলমানরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। তাহলে কি এখন সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যাবে?
শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ এবং ভোটার হলো এক কোটি ৬০ লাখ। শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত হওয়ার জন্য ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হয়। গোতাবায়া ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়ায় দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের প্রয়োজন হয়নি। গোতাবায়া রাজা পাকসের দল শ্রীলঙ্কা পোদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) হচ্ছে সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী দল। গোতাবায়ার নির্বাচনী হাতিয়ার ছিল বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ। দেশটির জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হচ্ছে- সিংহলি বৌদ্ধ গোতাবায়ার মূল শক্তি ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থন। সংখ্যালঘু জনসংখ্যার মধ্যে গোতাবায়ার জনপ্রিয়তা তুলনামূলকভাবে কম। এ কারণে সিংহলিদের শতভাগ সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন গোতাবায়া। এ ক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সফল হয়েছেন বলা যায়।
গত ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কার তিনটি গির্জা ও হোটেলে যে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছিল সেটা গোতাবায়ার সাফল্যের ক্ষেত্রে কাজ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গির্জায় হামলার ঘটনার পর সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক ঐক্য লক্ষ করা যায়। গোতাবায়া রাজা পাকসে পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বৌদ্ধদের মধ্যে ঐক্যের ডাক দেন এবং সরকার জনগণকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে সমালোচনা করেন। তিনি মোদির মতো উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে নির্বাচনে ফায়দা হাসিল করেন। এছাড়া তামিলদের সাথে দীর্ঘ ২৬ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ অবসানে সাফল্যের জন্যও সিংহলিরা রাজাপাকসে পরিবারের ওপর সন্তুষ্ট। এবারের নির্বাচনে বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভোটদানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই হচ্ছে সিংহলি বৌদ্ধ। এরপর ১২ শতাংশ হিন্দু ১০ শতাংশ মুসলিম এবং ৭ শতাংশ হচ্ছে খ্রিষ্টান। ১২ শতাংশ হিন্দুর মধ্যে জাতিগতভাবে বেশির ভাগই হচ্ছে তামিল সম্প্রদায়ের। শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘুদের বেশির ভাগের মধ্যে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি তথা সাজিথ প্রেমাদাসার সমর্থক রয়েছে। তাই গোতাবায়ার জয়ে সংখ্যালঘু মুসলিম ও তামিলরা ভীত। ইস্টার সানডের ঘটনার পর মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে দমনাভিযান শুরু করা হয়েছিল তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। গোতাবায়া নিজে এবং মাহিন্দ দুজনেই কট্টর সিংহলি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তারা কঠোরভাবে তামিলদের দমন করেছেন। তারা বিরুদ্ধমতের বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক আচরণের নীতিতে বিশ্বাসী। গোতাবায়া ৫২ শতাংশের বেশি ভোটে নির্বাচিত হলেও সংখ্যালঘুদের ভোট পেয়েছেন কি না, সন্দেহ রয়েছে। ইস্টার সানডের ঘটনায় খুবই স্বল্প পরিচিত একটি মুসলিম গ্রুপ জড়িত থাকলেও সিংহলিরা মুসলমানদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে।
তারা ৩০টিরও বেশি মসজিদ-মাদরাসা, মুসলমানদের মালিকানাধীন ৫০টির বেশি দোকান ও শতাধিক বাড়িঘরে হামলা চালায়। কিছু উগ্র বৌদ্ধভিক্ষু মুসলমানদের বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দিচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় আগে সবসময় মুসলমানদের ‘কিং মেকার’ হিসেবে দেখা হয়েছে। তাদের সমর্থনের ওপর প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফল নির্ভর করত। কিন্তু এবার সে চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলা হয়েছে।
আর পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি আমরা এশিয়ায় দেখলেও রাজা পাকসের পরিবারের মতো এত নির্লজ্জ পরিবারতন্ত্র কোনো দেশে দৃষ্টিগোচর হয়েছে বলে জানা নেই। মাহিন্দ ২০০৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ১০ বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওই সময় তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন গোতাবায়া। ওই সময় পরিবারটির বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছিল। দুই ভাইয়ের মধ্যে মাহিন্দ ক্যারিশমেটিক ও জনপ্রিয় নেতা। গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হলেও সরকারে মূলত প্রাধান্য থাকবে মাহিন্দর। তিনিই সম্ভবত দেশ চালাবেন।
ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীনের মধ্যে টানাপড়েন রয়েছে। ভারত ও চীন দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়াস চালাচ্ছে। তবে গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হওয়ায় চীনই বেশি সুবিধা পাবে। চীন সমর্থক গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হওয়া ভারতের জন্য অস্বস্তিকরও বটে। শ্রীলঙ্কার কিছু নেতা ও রাজনৈতিক দল ভারতের বলয়ে থাকতে চাইলেও দেশটির মানুষ ভারতবিরোধী বেশি। তবে সংখ্যালঘু মুসলিমও তামিলদের কোণঠাসা করে রাখলে শ্রীলঙ্কায় শান্তি আসবে না। আর উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতির চর্চা ও পরিবার তন্ত্রের মাধ্যমে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হলে শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবারকে জনগণ আগের মতো আবারো যে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?