প্রেসিডেন্টের কাছে মর্মস্পর্শী এক চিঠি
কায়েস সাঈদ - ছবি : সংগ্রহ
কায়েস সাঈদ
মাননীয় প্রেসিডেন্ট তিউনিসিয়া
জনাব,
তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় প্রথমকেই আপনাকে অভিনন্দন জানাতে চাই। আপনার এই গৌরবোজ্জ্বল বিজয় শুধু আপনার দেয়া প্রতিশ্রুতির কারণেই নয় বরং তিউনিসীয় জনগণকে তাদের জাতীয় গন্তব্যে পৌঁছানোর যে প্রত্যয় আপনি ব্যক্ত করেছেন, বিজয়টি সে কারণেও এসেছে।
আপনি নির্বাচনপূর্ব সময়ে ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় দেয়া ভাষণ-বিবৃতিতে আপনি ফিলিস্তিনিদের সব ধরনের অধিকারের পক্ষে এবং ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিপক্ষে যে অবস্থান নিয়েছেন, তা তিউনিসিয়ার বেশির ভাগ মানুষ এমনকি আরবের সাধারণ মানুষেরাও পছন্দ করেছে। ফিলিস্তিনিদের সাথে এ সংহতি প্রকাশে তারা বিশেষভাবে সন্তুষ্ট হয়েছে।
বিডিএস তার মূলনীতিতে বৈশ্বিক মানবাধিকারের ঘোষণার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সব ধরনের বৈষম্য, বর্ণবাদ, ইসলামোফোবিয়া ও ইহুদিবিদ্বেষকে স্পষ্টভাষায় প্রত্যাখ্যান করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী মডেলের মতো করে ইসরাইলের বসতি-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের বিডিএস আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল, ইসরাইল সরকারের ওপর অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখা, যতক্ষণ না তারা ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়টি স্বীকার করে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনের ধারাগুলো মেনে চলে।
আমরা দীর্ঘ দিন ধরেই ফিলিস্তিনিদের জাতীয় সংগ্রামে সমর্থন জানিয়ে আসছি। ফিলিস্তিনি সুশীল সমাজের ডাকে ২০০৫ সালের জুলাই মাসে যাত্রা শুরু করা ফিলিস্তিনিদের অধিকারবিষয়ক আন্দোলন বিডিএসেও আমরা সক্রিয় অনেক দিন থেকেই।
বিডিএসের সাফল্য, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এর সফলতা ইসরাইলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এটিকে নিজের কৌশলের ব্যাপারে হুমকি হিসেবে দেখছে। এ অবস্থায় বিডিএসসহ ফিলিস্তিনের অন্য আন্দোলনের প্রতি তিউনিসিয়ার সমর্থনটি আরব বিশ্বের জন্য শক্তিশালী একটি বার্তা হিসেবে পৌঁছবে। সেই সাথে যেসব ফিলিস্তিনি দশকের পর দশক ধরে নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে আসছে, তারাও উৎসাহিত হবে।
এ অবস্থায় তিউনিসিয়ার জনগণের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের যে ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা আরো কার্যকর করা এবং ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে যে আইন লঙ্ঘন করছে, নিপীড়ন চালাচ্ছে, আন্তর্জাতিক ধারার মধ্যে থেকেই তার প্রতিকার করার জন্য আমরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এর মধ্যে থাকতে পারে ফিলিস্তিনিদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে প্রত্যাখ্যান, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধপরাধের প্রতিবাদস্বরূপ ইসরাইল রাষ্ট্রের নীতিগুলোতে সব ধরনের সহায়তা প্রত্যাহার এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের প্রতিবাদে জাতিসঙ্ঘের সনদ মেনে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ।
২০০৪ সালের জুলাইতে আন্তর্জাতিক আদালতের একটি উপদেষ্টা মতামতেই ইসরাইলের আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছিল। তখন ১৫ জন বিচারকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এক বিচারক ব্যতীত বাকি সবাই ইসরাইলের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের বিপক্ষে মতামত দিয়েছিল।
১৯৬৭ সাল থেকে দখল করে রাখা ফিলিস্তিনি এলাকাগুলোতে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত মাইকেল লিঙ্ক তার এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, ইসরাইল ৫২ বছর মেয়াদি দখলদারিত্বের পরিকল্পনার লাগাম টেনে ধরতে এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ওপর থেকে বাধা সরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব রয়েছে। তার ওই বিবৃতিটি ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ ঠেকাতে বা নিষিদ্ধ করতে আইন তৈরিতে তিউনিসিয়াকে পুনঃআহ্বান জানাচ্ছে।
এটি বহু আগেই প্রমাণিত যে, ইসরাইলের ওপর আরব লীগের বয়কটটি দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর বা যথেষ্ট বিবেচিত হয়নি। তবে বর্তমানে যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা ইসরাইলের এসব দখলদারিত্ব, নিপীড়নের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে, সে মুহূর্তে তিউনিশিয়ার এ বিষয়ে কিছু করার রয়েছে।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন থেকে নাম প্রকাশ করা ছাড়াই এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল, যাতে বলা হয়েছিল, ২০৬টি কোম্পানির কর্মকাণ্ড ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেম থেকে দখল ও চুরি করা ভূমিতে স্থাপনা নির্মাণে ইসরাইলকে সমর্থন করছে। তাদের এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ইসরাইল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ব্যাপারে ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করে। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনের দেয়া চাপের কারণে জাতিসঙ্ঘ ওই কোম্পানিগুলোর প্রকৃত নাম প্রকাশ করতে এখন অব্দি বাধা দিয়ে আসছে।
এ ক্ষেত্রে তিউনিশিয়ার আইনে এমন কিছু যুক্ত করা যেতে পারে, যার ফলে এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দ্বারা যেসব কোম্পানি বা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান লাভবান হতে পারে তাদের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন কাজের টেন্ডার বা ব্যবসায় থেকে বাদ দেয়া যাবে। এর ফলে যারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত তাদেরকে তিউনিশিয়ার ভূখণ্ডে প্রবেশ থেকেও বিরত রাখা যাবে, বাধা দেয়া যাবে। এ ধরনের একটি আইন করা হলে তা শুধু ফিলিস্তিনিদের পক্ষেই নয়, বরং চীনে নির্যাতিত মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন প্রদানের পাশাপাশি পরিবেশবিরোধী কাজের মাধ্যমে যারা বিশ্বের ক্ষতি সাধন করছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা যাবে।
তাই ফিলিস্তিনি জনগণের মৌলিক এই অধিকারগুলো রক্ষায় মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আমরা আপনার প্রতি দাবি জানাচ্ছি। আমরা অনুরোধ জানাচ্ছি যুদ্ধপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার রহিত করার বিরুদ্ধে একটি জাতীয় আইন তৈরি করতে। সেই সাথে এসব অপকর্ম দ্বারা যারা উপকৃত হয় তাদের ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে। ফিলিস্তিনিদের চলমান এ দুর্ভোগ মোকাবেলায় কার্যকরী যেকোনো কর্মসূচিই আপনি নেয়া উচিত বলে মনে করবে, তা কার্যকরে আমরা আপনাদের সাথে আছি।
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, অনুগ্রহ করে এ বার্তাটি আপনার পদ ও আপনার প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার প্রকাশ হিসেবে গ্রহণ করুন।
ইতি
আহমেদ আব্বাস ও রিচার্ড ফালক
তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদের প্রতি এ খোলা চিঠিটি লিখেছেন আহমেদ আব্বাস ও রিচার্ড ফালক। আহমদ আব্বাস একজন গণিতবিদ। প্যারিসের গবেষক আব্বাস তিউনিশিয়ান ক্যাম্পেইন ফর দ্য অ্যাকাডেমিক অ্যান্ড কালচারাল বয়কট অব ইসরাইলের (টিএসিবিআই) সমন্বয়ক এবং ফ্রেঞ্চ অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাকাডেমিকস ফর রেসপেক্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ল’জ ইন প্যালেস্টাইনের (এইউআরডিআইপি) সেক্রেটারি। অন্যদিকে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইনের ইমেরিটাস অধ্যাপক রিচার্ড ফালক জাতিসঙ্ঘের ‘১৯৬৭ সাল থেকে দখলকৃত ফিলিস্তিনি এলাকাগুলোতে মানবাধিকার পরিস্থিতি’ বিষয়ক বিশেষ দূত (২০০৮-২০১৪) এবং নিউক্লিয়ার এজ পিস ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব ডিরেক্টরের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট।
অনুবাদ : মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ