৩ বিপদে রোহিঙ্গারা
৩ বিপদে রোহিঙ্গারা - ছবি : সংগৃহীত
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সঙ্কট বিপজ্জনকভাবে পেছন দিকে হঠছে। নাগরিক অকিার অস্বীকার, ব্যাপক মাত্রায় ভূমি দখল ও সশস্ত্র লড়াই হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার ফলে যেকোনো ধরনের পরিবর্তনের সত্যিকারের আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে।
কিছু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু মিয়ানমারে ফিরে গেছে বলে খবর প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও মনে হচ্ছে যে সরেজমিনে যে স্থান থেকে তারা পালিয়েছিল, সেখানে গিয়ে যা দেখেছি, তাতে করে ফেরার বদলে আরো লোক পালিয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। এসব রাষ্ট্রহীন লোকের সাথে আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশকারীদের উচিত হবে নতুন করে চিন্তা করা। তারা যদি কেবল সঙ্কট আরো ঘনীভূতই করতে থাকে, তবে আমরা কখনো এই সমস্যার সমাধান করতে পারব না।
বিশ্ব ২০১২ সালে সহিংসতার শিকার হয়ে রাখাইন রাজ্যে এক লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে উদ্বাস্তু জনাকীর্ণ, বন্যাপ্রবণ উদ্বাস্তু শিবিরে ঠেলে দেয়ার দৃশ্য দেখেছে। নিরাপত্তা বাহিনী তাদেরকে সবসময় ঘিরে থাকায় তারা তাদের বাড়ি ফেরার সুযোগ পায়নি। তারা এখনো সেখানেই করুণ জীবনযাপন করছে। এই অক্টোবরেও সেখানে তাদের করুণ অবস্থায় দেখেছি।
তারপর ২০১৭ সালে সহিংসতার ফলে বিপুল মাত্রায় বাস্তুচ্যুতি ঘটে। সশস্ত্র লোকজন নৃশংসভাবে লাখ লাখ লোকের ওপর হামলা চালায়। পরিণতিতে নজিরবিহীনভাবে সাত লাখ ৪০ হাজার লোক সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আগে থেকেই বাংলাদেশে ছিল দুই লাখ উদ্বাস্তু। রাতারাতি ছোট্ট মৎস্য কেন্দ্র কক্সবাজার পরিণত হয় বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু শিবিরে।
জাতিসঙ্ঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক হাই কমিশনার এই হামলাকে পাঠ্যপুস্তকে থাকা জাতি নির্মূল হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিশ্ব এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয়েছিল।
দুই বছর পর পরিবারগুলো বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে আটকা পড়ে আছে। তাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই সরকারের মধ্যে চুক্তি হলেও নানা ঘটনার কারণে তাদের প্রত্যাবাসন হচ্ছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে আরেকটি অসহায় ও অসমাপ্ত উদ্বাস্তু সঙ্কট অব্যাহত থাকবে।
তিনটি বিষয় বদলাতেই হবে।
প্রথমত, মিয়ানমারের দরিদ্রতম রাজ্যটিতে ব্যাপক মাত্রায় ভূমি দখল অব্যাহত রয়েছে। মিয়ানমার ব্যবসার দুয়ার খুলে দেয়ায় একসময় অগ্নিদগ্ধ গ্রামগুলো যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, ওই জায়গাগুলো দখল করার জন্য বিদেশী বিনিয়োগকারী, নির্মাণ কোম্পানি, স্থানীয় ও জাতীয় কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য বর্মি সম্প্রদায় ছুটে আসছে। রোহিঙ্গারা বুঝতেও পারছে না যে তাদের ও তাদের পূর্ব পুরুষদের জমি অন্যরা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে বিশ্বের বৃহত্তম ভূমি দখলের কার্যক্রম চলছে।
গত বছর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জায়গা প্রস্তুতের জন্য গ্রামের পর গ্রাম ও আশপাশের বন এলাকা পরিষ্কার করা হচ্ছে। এসব কাজ অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গাদের ফেরার জন্য কোনো জায়গাই থাকবে না। আমি নিজের চোখে নির্মাণ কোম্পানিগুলোর উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলোর আশপাশে জমি দখল করার চিত্র দেখেছি। এ ধরনের তৎপরতা থামাতেই হবে।
দ্বিতীয়ত, উত্তর রাখাইনে সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়ছে। সরকারি বাহিনী ও স্থানীয় আরাকান সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যকার সঙ্ঘাতের ফলে জানুয়ারি থেকে লাখ লাখ লোক তাদের বাড়িঘর থেকে সরে পড়তে বাধ্য হয়েছেন।
আবার সরকারি বিধিনিষেধের ফলে এনজিওগুলো উদ্বাস্তুদের জন্য তেমন কিছুই করতে পারছে না। ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন থাকায় পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে।
তৃতীয়ত, জাতিসঙ্ঘ সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০১৭ সালে উপস্থাপিত ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে ভূমি, সম্পত্তি ও নাগরিক অধিকার প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছিল। মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে আমি সরকারের মন্ত্রী ও সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে তারা ওইসব সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে তা নিছকই কথার কথা। সেগুলো এখনো কাজে বাস্তবায়ন করা হয়নি। নিরাপদে প্রত্যাবাসন, ভূমি ফিরিয়ে দেয়া ও নাগরিক অধিকার প্রদান করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন দ্রুততার সাথে।
সম্প্রতি সরকার বাস্তুচ্যুতি ক্যাম্পগুলোকে বন্ধ করে সেগুলোকে তথাকথিত গ্রামে পরিণত করার যে পরিকল্পনার কথা বলছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। উদ্বাস্তুদের মূল জায়গায় ফেরানোর বদলে নতুন স্থানে সরিয়ে নেয়া বা বন্ধ করা ক্যাম্পগুলোর পাশেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলে তাদের মধ্যে প্রান্তিক লোকে পরিণত হওয়ার ধারণা দানা বাঁধবে। পরিবারগুলোর অবাধে চলাচলের স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। তারা যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করছিল, সেখানেই ফেরানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
রোহিঙ্গা লোকদেরকে সুরক্ষা দেয়ার প্রধান দায়িত্ব মিয়ানমারের। তবে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততাও এতে ব্যাপকভাবে প্রয়োজন।
চীন, জাপান, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশীদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে এসব দেশের প্রভাব প্রয়োগ করা দরকার।
রোহিঙ্গাদের দুর্দশা অবসানের জন্য আমাদের এখনই কিছু করা প্রয়োজন।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট