কাশ্মির ইস্যুতে আফগানিস্তানে সমস্যায় ভারত
কাশ্মির ইস্যুতে আফগানিস্তানে সমস্যায় ভারত - ছবি : সংগৃহীত
সরকারের নীতি ও জনমতের মধ্যে বিভাজন কূটনৈতিক বিশ্বে স্বার্থের মতোই জটিল বিষয়। পশ্চিম এশিয়ার অভিজাতন্ত্রের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক রক্ষার মতো করে সমসাময়িক পরিস্থিতিতে আর কোথাও দৃষ্টিগোচর হয় না। এই রোমাঞ্চ এক দশক বা আরো আগে শুরু হলেও এখনো তা অবৈধ বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে।
ইসরাইল উন্মুক্ত সম্পর্ক রাখতেই চাইবে। এতে তার অনেক ফায়দা আছে। কিন্তু তা হবে না বলেই মনে করা হয়ে থাকে। এর কারণ হলো, মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কতান্ত্রিক শাসকেরা তথাকথিত ‘আরব রাজপথ’ নিয়ে খুবই সচেতন। বিষয়টি ধাঁধার মতো মনে হতে পারে যে এই অভিজাত চক্রেরও জনমতের তোয়াক্কা করে। তাদের কর্তৃত্ব নিয়ে সাধারণভাবে যতটা ধারণা করা হয়, বাস্তবে তারা ওই অবস্থায় নেই। শক্তিশালী নির্বাচিত নেতৃত্ব যে পরিমাণ জনমত পেয়ে থাকেন, তারা তা পান না।
তারা যখন জনমত অস্বীকার করেন, তখন আসলে তা করেন খুবই ভয়াবহ কারণে। বেশির ভাগ সময় তা করেন তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন সামনে এলে। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক রক্ষা না করলে আরব অভিজাতন্ত্রের পতন হবে, বিষয়টি তেমন নয়। আসলে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা হয় বাস্তবতার আলোকে। এই সম্পর্ক রক্ষার একটি সীমা আছে এবং তারা এর বাইরে যেতে চান না। আর এর ফলেই সম্পর্ক হয় খুবই সীমিত।
ভারতীয় নেতৃত্বেরও কূটনীতিতে বিচক্ষণ বৈদেশিক সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করতে হবে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারতের ‘সফট পাওয়ার’ শেষ হয়ে যাচ্ছে আতঙ্কজনক হারে। মোদি সরকারের সহযোগীরা মনে হচ্ছে, এসব ব্যাপারে ভ্রক্ষেপই করেন না এবং তাদের মধ্যে থাকা আরো শীর্ষ পর্যায়ের লোকজনও এর তাৎপর্য বুঝতে পারছেন না এবং আরো খারাপ ব্যাপার হলো, তারা সমালোচকে পরিণত হচ্ছে।
ভারত থেকে রাজকীয় ব্রিটেনের ৪৪ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে যাওয়া নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাম্প্রতিক মন্তব্যটি এ ধরনের একটি বিশেষ উদাহরণ। জম্মু ও কাশ্মির পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিটেনের তীব্র সমালোচনায় হতবুদ্ধ হয়ে জয়শঙ্কর ব্রিটেনকে কলঙ্কিত করতে ঘুরপথ বেছে নিয়েছেন। (তিনি কিভাবে হিসাব করলেন যে ভারত থেকে ব্রিটেন ৪৪ ট্রিলিয়ন ডলারই নিয়ে গেছে?)
বর্তমানে ভারতের কূটনৈতিক হাতিয়ারগুলোতে ‘সফট পাওয়ার’ আর প্রচলিত নেই। প্রবল পেশীশক্তি প্রদর্শন খুব বেশি প্রয়োগ হয়ে গেছে। মোদি সরকারের আমলে ‘সফট পাওয়ারের’ ঘ্রান ২০১৪ সালে শুরু হয় এবং ৫ বছর শেষ হওয়ার পর তা উবে গেছে।
গত ৫ বছর মেয়াদে করা অনেক ভুলের কারণে ভারতের সফট পাওয়ারে ক্ষয় নেমেছে। তবে কাশ্মির উপত্যকার পরিস্থিতিই ভারতের ভাবমূর্তিতে সবচেয়ে বড় আঘাতটি হেনেছে।
ভারতের নিকট প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে এই ধারণা দানা বাঁধছে যে মোদি সরকার যে নীতি গ্রহণ করছে, তা পুরোপুরি ‘মুসলিমবিরোধী।‘ এমনকি বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা তুরস্কের মতো বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর এলিটরা পর্যন্ত কোনোভাবেই কাশ্মিরের ঘটনাবলীকে ‘মুসলিম ইস্যু’ হিসেবে দেখছে না।
সম্প্রতি প্রভাবশালী মার্কিন ম্যাগাজিন ফরেন পলিসিতে প্রকাশিত এক মতামত কলামে বলা হয়েছে যে কাশ্মিরের কারণে আফগানদের মধ্যে ভারতের সুনাম হানি হতে পারে। এটি একটি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। তবে কোনোভাবেই ‘ভারতবিরোধী’ নয়। কিন্তু কাশ্মিরি মুসলিমদের ওপর ভারতের নির্যাতনের ফলে আফগানদের যে মোহমুক্তি ঘটছে, তা সাদা চোখেই দেখা যায়।
এটি একটি হতাশাজনক বিষয়। কারণ ভারত-আফগান সম্পর্কের ভিত্তি ছিল ঐতিহাসিকভাবেই ‘সফট পাওয়ার’। ১৯৪৭ সাল থেকে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, দুই দেশের মধ্যকার জনগণ পর্যায়ের সম্পর্কের ওপর বিপুল গুরুত্ব দিয়ে আসছিল।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আফগানরা যদি আমাদেরকে পাকিস্তানের সাথে (তাদের দেশের স্বার্থ হাসিলে শীতল, নির্মম ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনই একমাত্র লক্ষ্য) কোনো ধরনের পার্থক্যে না রাখে তবে আমাদের কূটনীতি নিস্প্রভ হয়ে যাবে। ভারতকে আফগানিস্তান ‘স্থিতিশীলতাকারী উপাদান’ হিসেবে বিবেচনা করে যাবে, এতেই সান্ত্বনা পেতে পারি।
হরি প্রাসাদ ওই প্রতিবেদনে লিখেছেন যে আফগান সরকারের সাথে ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সাধারণ আফগান ও সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তারা কাশ্মিরি মুসলিমদের সাথে সংহতি করছে বলে দেখা গেছে।
এতে বলা হয়, আফগানরা কাশ্মির ও এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের কার্যক্রম তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। নয়া দিল্লির বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত। আফগানিস্তানে সমর্থন সৃষ্টি ও জনমত গঠনের মতো অর্থ ও শক্তি ভারতের আছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস দূর করতে অনেক সময় লাগবে।
আফগানিস্তানের মতো দেশেই যদি ধারণা বদলে যেতে থাকে, তবে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে কি পরিস্থিতি ভিন্ন হবে? মনে রাখতে হবে যে ইসলামের সোনালি যুগেই ইসলামি সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও পরিচিতি এই অঞ্চলে পরিব্যপ্ত হয়েছিল।
উদাহরণ হিসেবে উজবেকদের কথাই বলা যায়। তারা ফারগানার বাবরের জন্য বিপুল গর্ব অনুভব করে। তার নামে একটি জাদুঘর উৎসর্গ করা হয়েছে। কাবুলের অন্যতম স্মৃতিজাগানিয়া ঐতিহাসিক মনুমেন্ট হলো বাগ-ই-বাবর (বাবর উদ্যান)। আগ্রাতে নয়, এখানেই চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
দিল্লি যদি কাবুলে অর্ধ ডজন পার্লামেন্ট ভবনও নির্মাণ করে তবুও আফগানরা বাব-ই-বাবরকেই ভারতের সাথে তাদের স্থায়ী সম্পর্কের জীবন্ত স্মারক হিসেবে বিবেচনা করা অব্যাহত রাখবে।
ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন