ভারতের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসন!

জি. মুনীর | Nov 24, 2019 04:47 pm
ভারতের প্রেসিডেন্ট

ভারতের প্রেসিডেন্ট - ছবি : সংগ্রহ

 

সাধারণভাবে কাশ্মির ইস্যুটি ভারতের মূলধারার সব রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার। বিশেষ করে বিজেপির জন্য ভোটব্যাংক সৃষ্টির অপকৌশলে এই ইস্যুটি বরাবর ছিল একটি অপহাতিয়ার। এর ফলে কাশ্মির নিয়ে ভারতীয় সরকারগুলোর ভ্রান্তির শেষ নেই। কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নির্ধারণের প্রতিশ্রুত গণভোট আয়োজনের কথা ভুলে, ভারতের প্রতিটি সরকার নানা কূটচাল চেলেছে কাশ্মিরকে কব্জা করার জন্য। ১৯৫৩ সালে শেখ আবদুল্লাহর সরকারকে সরিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে ১৯৮৭ সালের ভোট কারচুপি পর্যন্ত করা হয়েছে অসংখ্য ভুল। আর অতি সম্প্রতি কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদাসংশ্লিষ্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা বিলোপ সাধন হচ্ছে নতুন দিল্লির নিজের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকারই নামান্তর।

মোদি সরকার গত ৫ আগস্টের এক নির্বাহী পদক্ষেপের মাধ্যমে শুধু কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদাই বাতিল করেনি, একই সাথে পুরনো এই জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যটিকে দুই ভাগে ভাগ করে পরিণত করেছে ইউনিয়ন টেরিটরিতে। দুর্ভাগ্যের বিষয় জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যে এই বিশেষ মর্যাদা বাতিলের নির্বাহী আদেশের একই দিনে অর্থাৎ ৫ আগস্টেই এ সম্পর্কিত বিলটি রাজ্যসভায় পাস করা হয়। আর এর পরদিন ৬ আগস্টে তা পাস করা হয় লোকসভায়। এই বিল প্রেসিডেন্টের সম্মতি লাভ করে ৯ আগস্ট।

এই ৩৭০ নম্বর ধারা বাতিলের বিষয়টি নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে : মুদ্রণ, সম্প্রচার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কিন্তু যাদের নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, তাদের রাখা হয় এক ধরনের কমিউনিকেশন ব্ল্যাকআউট পরিবেশে। শুধু বলা হলো, এই ৩৭০ নম্বর ধারা কাশ্মিরে সন্ত্রাসকেই বাড়িয়ে তুলেছে, একই সাথে বাধাগ্রস্ত করছে কাশ্মিরের উন্নয়নকেও।

তাই এই ধারা বাতিল জরুরি ছিল। সত্যিকার অর্থে সরকারের এ বিবৃতি ছিল দু’টি কারণে অসত্য। প্রথমত, সন্ত্রাসবিরোধী কাজে এই রাজ্যে ভারত সরকার ব্যবহার করে আসছে বিতর্কিত ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট’ (এএফএসপিএ)। এই আইন প্রয়োগ করে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মিরে অসংখ্য তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী প্রশ্নবোধক অভিযান চালিয়েছে। আর উন্নয়ন প্রশ্নে বলা যায়, সব ধরনের উন্নয়নসূচকে কাশ্মির অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে এগিয়ে। আসলে ভারতের ডানপন্থী সব রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন-খায়েশ, এই ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ সরিয়ে জম্মু ও কাশ্মিরের জনসংখ্যাচিত্র পাল্টে দেয়া, যাতে সেখানে মুসলমানদের একচ্ছত্র সরকার গঠনের অবসান ঘটে।

সে যা-ই হোক, ৩৭০ নম্বর ধারা বাতিল করার পর সেখানে কাশ্মিরিদের সব ধরনের মৌলিক অধিকারই বলতে গেলে হরণ করা হয়েছে। সেখানে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের আটকে রাখা হয়েছে। সাধারণ নাগরিকদের ওপর চলছে নির্বিচারে ধরপাকড়। অনেককে করা হয়েছে গুম। এমনি পরিস্থিতিতে কাশ্মিরিরা অসংখ্য রিট পিটিশন নিয়ে হাজির হচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টে। কিছু পিটিশনে আবেদন করা হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মিরের বিভক্তিকরণের বিরুদ্ধে। কমপক্ষে দু’টি রিট পিটিশন করা হয়েছে প্রেসিডেন্টের আদেশের অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতের জন্য। কাশ্মির টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক অনুরাধা বাসিন তার পিটিশনে আবেদন জানিয়েছেন, কাশ্মিরে অনতিবিলম্বে জম্মু ও কাশ্মিরজুড়ে সব ধরনের যোগাযোগ- মোবাইল, ইন্টারনেট ও ল্যান্ডলাইন সার্ভিস চালুর জন্য, যাতে গণমাধ্যমের পেশাজীবীরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারে। একটি পিটিশনে কংগ্রেস আইডিওলগ তাহসিন পোনাওয়ালা সব রাজনৈতিক নেতার মুক্তি দাবি করেছেন, সেই সাথে দাবি জানিয়েছেন কারফিউ প্রত্যাহার ও সব ধরনের যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের।

শোয়ায়েব কুরেশির পিটিশনে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে প্রেসিডেন্টের আদেশের ও ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বরে জারি করা নোটিশের বৈধতাকে, যাতে জম্বু ও কাশ্মিরে প্রেসিডেন্টের শাসন আরোপ করা হয়। শাহ ফয়সলের পিটিশনে বিশেষ করে চ্যালেঞ্জ করা হয় প্রেসিডেন্টের আদেশের একটি অনুচ্ছেদ। এমনি আরো অনেক পিটিশন এখন দাখিল করা হচ্ছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে। এগুলো এখন শোনার পালা। তবে ৩৭০ নম্বর বাতিল-উত্তর এই সময়ে আরো বড় ধরনের একটি ঘটনা ঘটে যেতে পারে ভারতের ইতিহাসে। হতে পারে কাশ্মিরের এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে এই প্রথমবারের মতো ভারতের প্রেসিডেন্ট অভিশংসনের মুখোমুখি হতে পারেন।

ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, ভারতের সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে রাজ্যসভার বিরোধী দলীয় এমপিরা প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসনের পদক্ষেপ নিতে পারেন। পার্লামেন্টের আগামী শীতকালীন অধিবেশনেই এই অভিশংসন উদ্যোগ নেয়া হতে পারে। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসনের পদ্ধতি-প্রক্রিয়া সম্পর্কে। ভারতীয় সংবিধানের ৬১ নম্বর ধারায় বিস্তারিত বলা আছে। রাজ্যসভার এক-চতুর্থাংশ এমপি এ সম্পর্কিত প্রস্তাবে স্বাক্ষর করে অভিশংসন পদক্ষেপ নিতে পারেন। গত ৫ আগস্ট, ২০১৯ জম্মু ও কাশ্মির পুনর্গঠনের ব্যাপারে যে বিল রাজ্যসভায় পাস হলো, তাতে ৬১ জন সদস্য এর বিরুদ্ধে ভোট দেন। এই বিলের লক্ষ্য ছিল জম্মু ও কাশ্মিরকে দুই ভাগে ভাগ করে দু’টি আলাদা ইউনিয়ন টেরিটরিতে পরিণত করা। অপর দিকে, ১২৫ ভোট পড়ে বিলের পক্ষে। কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়। রাজ্যসভার ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, বর্তমানে রাজ্যসভার মোট সদস্য সংখ্যা ২৩৮, কারণ মোট ২৪৫ আসনের মধ্যে সাতটি আসন এখন খালি আছে (এ তথ্য ২০ নভেম্বরে নেয়া)। আপাতত ৬০ জন পার্লামেন্ট সদস্য এই অভিশংসন উদ্যোগ নেয়ার পক্ষে রয়েছেন বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম। তা সত্ত্বেও যেকোনো কারণে কিংবা পর্যাপ্ত নোটিশ ছাড়াই হঠাৎ করে পার্লামেন্টে বিলটি ওঠার কারণে যে বিপুলসংখ্যক সদস্য ভোটদানে বিরত ছিলেন অথবা যারা বিলটি সমর্থন করেছিলেন তাদের অনেকেই এখন এই অভিশংসন উদ্যোগের পক্ষ নিতে পারেন। এর কারণ ভারত সরকার অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক পন্থায় অভাবনীয় তাড়াহুড়ো করে এই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। তাছাড়া কাশ্মিরি জনগণ অথবা বিরোধী দলগুলোর সাথে কোনো আলাপ-আলোচনা না করেই অতিমাত্রায় গোপনীয়তা অবলম্বন করে এ কাজটি সম্পন্ন করা হয়।

এদিকে যথাযথ নোটিশ না করেই পার্লামেন্টে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত বিলে যারা ভোট দিতে পারেননি, তারা ৫ আগস্ট, ২০১৯ থেকে কার্যকর কয়েক মাস ধরে ল্যান্ডলাইন ফোন, ইন্টারনেটসহ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে পুরো কাশ্মিরকে একটি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত করার বিষয়টি অনুমোদন করেন না। তারা মনে করছেন সরকারের এ কাজটি অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক। এ কারণে অনেক বিরোধীদলীয় এমপি, যারা সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, এখন অভিশংসন প্রস্তাবে স্বাক্ষর করতে পারেন। কারণ সরকার যেসব প্রক্রিয়া নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য ও অগণতান্ত্রিক। এ সম্পর্কে তাদের অনেকেই এখন নানা কথাই বলছেন।

এ কথা ঠিক, শেষ পর্যন্ত সরকারের নানা অপকৌশলের মুখে এই পাটীগণিত ঠিকঠাক মতো কাজ নাও করতে পারে। সুকৌশলে সরকার এ অভিশংসন প্রস্তাব ব্যর্থ করে দিতে পারে। কারণ, এই অভিশংসন প্রস্তাব পাস করতে হলে রাজ্যসভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে। তবে পার্লামেন্টের উপায়ে বিরোধীদলীয় এমপিদের মেজোরিটারিয়ান প্রতিরোধ ঠেকানোর চেষ্টা করা উচিত বলে অনেকেই মনে করেন। এই পদক্ষেপটি হতে পারে সুপ্রিম কোর্টের আইনি চ্যালেঞ্জের অতিরিক্ত পদক্ষেপ। তা ছাড়া এরই মধ্যে বেশ কিছু গণবিক্ষোভও অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের ও পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কাশ্মিরি জনগণের চাপ এ ক্ষেত্রে কার্যকর সুফল বয়ে আনতে পারে। অনেকের অভিমত, রাজ্যসভায় অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়াটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং এই পদক্ষেপ থেকে পিছপা হওয়া উচিত হবে না। প্রথমেই ৬০ জন এমপির স্বাক্ষর নিশ্চিত করতে হবে। এটি করা সম্ভব। কারণ, ৬১ জন সদস্য রাজসভায় এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। এরপর ভারতজুড়ে চালাতে হবে এ নিয়ে নানামুখি আলোচনা। তুলে ধরতে হবে এই অভিশংসনের যৌক্তিকতা। অনেকেই ২২ আগস্ট ২০১৯-এর ‘ন্যাশনাল প্রটেস্ট সাইট’ প্ল্যাটফরমে অনেকে যোগ দিয়েছেন। এটি এ ক্ষেত্রে একটি ইতবাচক দিক।

রাজ্যসভায় এই অভিশংসন নিয়ে আলোচনা অবশ্যই ব্যাপকভাবে প্রচারিত হবে বলে মনে হয়। কারণ, ভারতের ইতিহাসে এটাই হতে পারে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আনা অভিশংসন প্রক্রিয়া। আবারো আশঙ্কা প্রকাশ করছিÑ আলোচনা শেষে রাজ্যসভায় অভিশংসন নিয়ে ভোটে সম্ভবত সরকারি দলের পক্ষই ভারী হবে। কারণ, ভোট পক্ষে টানার ব্যাপারে সরকারের হাতে রয়েছে নানা কৌশলী হাতিয়ার। যদি রাজ্যসভায় দুই-তৃতীয়াংশ এমপি অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেন, তবে প্রক্রিয়াগতভাবে ইস্যুটি যাবে লোকসভায়। লোকসভা তখন অভিযোগটি তদন্ত করে দেখতে পারে কিংবা অভিযোগ তদন্ত করে দেখার মতো কারণ খুঁজতে পারে। আর যদি অভিশংসন প্রস্তাব রাজ্যসভায় পরাজিত হয়ও, তবু বিষয়টি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে এমন একটি নৈতিক দায় হিসেবে যে, কোনো প্রেসিডেন্টই আইনের ঊর্ধ্বে নন।

ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি বিরোধী দলগুলোকে প্রেসিডেন্টবিরোধী অভিশংসন উদ্যোগে আরো সাহসী করে তুলতে পারে। শিবসেনা বিজেপির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। হরিয়ানার একটি জোট সরকারও বিজেপি থেকে দূরে সরে গেছে। এটি বিজেপির অবস্থান অনেকটা নিচে নামিয়ে এনেছে। আগামী ৫ ডিসেম্বর কর্নাটকে অনুষ্ঠিত হবে ১৫টি অ্যাসেম্বলি আসনের নির্বাচন। সেখানেও বিজেপি আরো খারাপ করবে বলে অনেকের ধারণা। ঝাড়খণ্ডের অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে আগের এই সময়টায়ও বিজেপি জোট নিয়ে সমস্যায় আছে। খবর আসছে, স্যাফরন পার্টির মিত্ররাও ডুবন্ত জাহাজ ছেড়ে পালাচ্ছে।

এদিকে ১৮ নভেম্বর, ২০১৯ থেকে শুরু হয়েছে রাজ্যসভার ২৫০তম অধিবেশন। তা ছাড়া প্রতি বছর ২৬ নভেম্বর ভারতে পালিত হয় সংবিধান দিবস (জাতীয় আইন দিবস)। ওই দিনে ভারতে সংবিধান গৃহীত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিশংসন প্রক্রিয়ার মুখোমুখি। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব এলে সেটি হবে দেশে সংবিধান প্রণেতা ও কাশ্মিরি জনগণের জন্য একটি অনন্য উপহার।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us