কী করবে নেপাল

মীযানুল করীম | Nov 23, 2019 04:40 pm
নেপাল ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী

নেপাল ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী - ছবি : সংগ্রহ

 

আমাদের গ্রামাঞ্চলে জমির ‘আইল’ বা সীমানা ঠেলাঠেলি করে পাশের জমির মালিকের সাথে বিরোধ সৃষ্টির কথা অতীতে ব্যাপকভাবে শোনা যেত। ইদানীং এই প্রবণতা কমলেও আজও এটা একটা বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। এবার পত্রিকায় এএফপি কর্তৃক কাঠমাণ্ডু থেকে পরিবেশিত একটি খবর অনেককে পুরনো ভূমি বিরোধের বিষয় মনে করিয়ে দিতে পারে। একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার গত ২ নভেম্বর সংখ্যায় উল্লিখিত সংবাদটির শিরোনাম Nepal cries foul over new India map.

খবরটির মর্মার্থ হলো, গত ৩০ অক্টোবর ক্ষুদ্র নেপাল তার বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের নতুন একটি মানচিত্রের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে বলেছে, দু’দেশের সীমান্তবর্তী বিতর্কিত ‘কালাপানি’ এলাকাকে দিল্লির সীমানাভুক্ত বলে দেখানো হয়েছে এতে। নেপাল সরকারের দাবি, কালাপানি ‘সুস্পষ্টভাবেই’ এমন একটি এলাকা, যা নেপালের অন্তর্ভুক্ত। এই ম্যাপটি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেছে ২ নভেম্বর এবং এটি প্রকাশ করার আগেই বিতর্কিত হয়ে পড়ল। সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মির প্রদেশকে দু’টি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করে ফেলার কিছু দিনের মধ্যেই ভারত নতুন এই মানচিত্র বের করেছে। সবিশেষ উল্লেখ্য, নেপালের বর্ণিত ‘কালাপানি’র মতো কাশ্মির রাজ্যও একটি বিতর্কিত অঞ্চল। বাস্তবতা হলো, দিল্লির কৌশলে সাত দশক আগেই ‘বিতর্কিত’ হওয়ার পর কাশ্মিরের মূল অংশসহ বেশির ভাগই এখন ভারতের দখলে। একই কায়দায় কালাপানি ও অন্য কোনো ভূখণ্ড পরিকল্পিত বিতর্কের পথে বৃহৎ ভারতের মধ্যে শামিল দেখানো হতে পারে।

কালাপানি এলাকা নিয়ে ভারত ও নেপালের বিরোধ পুরনো এবং অর্ধশতাব্দী যাবৎ সেখানে ভারতীয় সৈন্যরা অবস্থান করছে। দীর্ঘকাল ভারতের ওপর প্রায় একচেটিয়াভাবে নির্ভরশীল থাকার পর সম্প্রতি নেপাল বিশেষত চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে একতরফা নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘নেপাল তার আন্তর্জাতিক সীমান্ত রক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বন্ধুভাবাপন্ন দু’রাষ্ট্রের সীমান্তসংশ্লিষ্ট যে কোনো সমস্যার নিরসন করা প্রয়োজন ঐতিহাসিক নথিপত্র ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এবং কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে।’ বিবৃতিতে কাঠমাণ্ডু জানিয়ে দিয়েছে, ‘এ ক্ষেত্রে নেপাল একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না।’

‘হিমালয় দুহিতা’ নেপাল বিরাট পড়শি দেশ ভারতের উত্তরে অবস্থিত এবং ভারতের উত্তরাখণ্ড ও উত্তরপ্রদেশ হয়ে বিহার প্রদেশের পূর্বপ্রান্ত ও সিকিম পর্যন্ত নেপালের সীমান্ত প্রলম্বিত। বাংলাদেশের সর্ব উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত, বাংলাবান্ধা থেকে নেপাল দেশটির দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত খুব বেশি দূরে নয়।

ভারতের সাথে ১৮১৬ সালে নেপালের সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক, নেপালের পশ্চিম সীমান্ত কালি নদী বরাবর চিহ্নিত। তবে এ নদীর উৎস কোথায়, তা নিয়ে দু’দেশ একমত না হওয়ায় সীমান্তবিরোধ জন্ম নিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা দরকার, সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরকালে ভারতের সাথে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী সে দেশ ফেনী নদীর পানি পাবে। তবে এ নদীর উৎস ভারতে নয়। বরং বাংলাদেশেই বলে ইদানীং পত্রপত্রিকায় তথ্যপ্রমাণসমেত জানানো হচ্ছে। ফলে ফেনী নদীর পানির ওপর বাংলাদেশের বিশেষ অধিকার রয়েছে বলে অনেকের অভিমত।

নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা রাজন ভট্টরাই বলেছেন, ‘ভারতের সাথে সীমান্ত সমস্যার সমাধান খোঁজা হবে আলোচনার মাধ্যমে।’ তার ভাষায়, ‘আলোচ্য ম্যাপটি পরীক্ষা করে দেখা হবে এবং আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সীমান্তরেখা নিরীক্ষা করা হবে। এরপর কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনা শুরু হবে।’ তবে নেপালের এতে কতটা লাভ হবে, তা অনিশ্চিত।

দক্ষিণ এশিয়া, তথা আমাদের এই উপমহাদেশে সীমান্তবিরোধ একটা বড় সমস্যা। শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, ভারত-নেপাল, চীন-ভারত, বাংলাদেশ-ভারত বিরোধও রয়েছে এ ক্ষেত্রে। উপমহাদেশে ভারত সবচেয়ে বড় দেশ। অন্য দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র, আর ভারত এত বিরাট যে, এ দেশ প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের চেয়ে বেশ কয়েকগুণ বড়; আয়তনে ৪ গুণেরও বেশি এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে ৫ গুণের মতো। উপমহাদেশের সব দেশের সাথে সীমান্ত আছে ভারতের। দেশটির সীমান্ত হাজার হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত যা পাকিস্তান, নেপাল, চীন, বাংলাদেশ, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা সংলগ্ন। অবশ্য শেষোক্ত দেশ এবং ভারতীয় ভূখণ্ডের মাঝে সঙ্কীর্ণ জলভাগ বিদ্যমান। বাস্তবতা হলো, ভারতের সাথে তার অন্তত চার প্রতিবেশীর গুরুতর সীমান্তবিরোধ বিদ্যমান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিরোধ হিমালয়ের অপর পাশের বৃহৎ শক্তি চীনের সাথে। বিশ্বে জনসংখ্যার দিক থেকে চীন ও ভারত যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

চীন-ভারত সীমান্তবিরোধের মূল কারণ হচ্ছে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে গৃহীত ‘ম্যাকমোহন লাইন’। এটা বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতের বর্তমান অরুণাচল (সাবেক North East Frontier Agency বা NEFA) প্রদেশের উত্তরাংশজুড়ে বিস্তৃত।

ব্রিটিশ শাসনের উত্তরসূরি হিসেবে নবগঠিত ভারত রাষ্ট্রের সরকার অনেক আগেই ম্যাকমোহন লাইনের স্বীকৃতি দিলেও কমিউনিস্ট চীন সরকার অদ্যাবধি এর বৈধতা স্বীকার করে না। বেইজিংয়ের বিশ্বাস, তাদের ওপর এটা চাপানো হয়েছে এবং তা চীনের সাথে আলোচনা করে, চীনের সম্মতি নিয়ে তৈরি করা হয়নি। ব্রিটিশ সরকার তাদের উপনিবেশবাদী শাসনকালে, উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে আফগানিস্তানের সাথে ভারতবর্ষের সীমানা নির্ধারণ করেছিল ‘ডুরান্ড লাইন’-এর মাধ্যমে। এই বিতর্কিত সীমারেখা অতীতে দীর্ঘকাল পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ককে বৈরী ও উত্তেজনাপূর্ণ করে রেখেছিল। যা হোক, ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের হাতে ভারত তার ঘঊঋঅ অঞ্চলের বিরাট অংশই হারিয়েছে। এ ঘটনা ম্যাকমোহন লাইনকে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, অর্থাৎ এর বিরোধিতার ক্ষেত্রে, চীনকে বিরাট মদদ জুগিয়েছে। ’৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের প্রভাবে ভারত ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়; এ যুদ্ধে ভারতের বিরাট বিপর্যয়ের শোক প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু (ইন্দিরা গান্ধীর বাবা এবং রাজীব গান্ধীর নানা) আমৃত্যু ভুলতে পারেননি।
চীন অরুণাচল বা ঘঊঋঅ-কে ‘দক্ষিণ তিব্বত’ নামে অভিহিত করে থাকে এবং সেখানে ভারতের কর্তৃত্বকে অবৈধ মনে করে। এ কারণে এবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অরুণাচল প্রদেশ সফরের আনুষ্ঠানিক বিরোধিতা করেছে চীন সরকার।

বেইজিং-দিল্লি অর্থনৈতিক সম্পর্ক যত উষ্ণই হোক, তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক আগের মতোই শীতল। ভারতঅধিকৃত কাশ্মিরের উল্লেখযোগ্য অংশও ‘আকসাই চীন’ নামে নিজ অধিকারে রেখেছে চীন। পূর্ব কাশ্মিরের এই ভূভাগ কিংবা অরুণাচলের দখলকৃত বিরাট অঞ্চলের ওপর থেকে চীন নিজের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রত্যাহারের কোনো লক্ষণ আজ পর্যন্ত দেখায়নি। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতায় রণকৌশলগত দিক থেকে আকসাই চীন ও অরুণাচলে চীনের কর্তৃত্বকে তার জন্য অপরিহার্য বলে মনে করা হচ্ছে। উদীয়মান আঞ্চলিক শক্তি ভারত এবং ‘উন্নয়নশীল’ বৃহৎশক্তি গণচীন, উভয়ই নেপাল, বাংলাদেশ, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশসহ বঙ্গোপসাগরে নিজ নিজ প্রভাব সুদৃঢ় ও বিস্তৃত করতে নানাভাবে তৎপর। তাই চীন-ভারত সীমান্ত সমস্যা অচিরেই মিটবে বলে মনে করা যায় না।

সীমান্তবিরোধসহ নানা সমস্যা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সৃষ্টি হয়েছে। এর অনেকগুলোর সুরাহা করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সমাধান তো হয়-ইনি; বরং এ বিরোধ কোথাও কোথাও সশস্ত্র সঙ্ঘাতে পর্যবসিত হয়েছে। দু’টি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মাঝে সীমান্ত বা অন্য কোনো ইস্যু নিয়ে বিরোধ ঘটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি এর সুরাহার স্বাভাবিক ও সর্বোত্তম পন্থা হলো কূটনীতি বা সংলাপ। তবে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলো যত বড় বা ছোট হোক না কেন, পরস্পরের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে আন্তরিকভাবে। দু’টি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক দেনদরবার এবং আলোচনা ফলপ্রসূ হতে পারে যদি উভয়পক্ষ সমমর্যাদাসম্পন্ন হয়। একপক্ষ যদি স্বঘোষিত ‘বড় ভাই’ বা ‘মুরব্বি’সুলভ মাতবরি করতে চায় এবং অন্যপক্ষ আগে থেকেই মানসিকভাবে হেয় অথবা পরাজিত বোধ করে, তাহলে আলোচনায় কখনো প্রত্যাশিত সুফল অর্জিত হতে পারে না। ক্ষুদ্রশক্তি থেকে পরাশক্তি- সব দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে জাতীয় মর্যাদা, স্বার্থ ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। অন্যের কাছে অযৌক্তিকভাবে নতজানু হওয়া কোনো স্বাধীন দেশের জন্য নিদারুণ অবমাননাকর। মনে রাখা চাই, ‘আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে স্থায়ী কোনো শত্রু কিংবা মিত্র নেই। আছে কেবল জাতীয় স্বার্থ।’ ভুলে গেলে চলে না, Friendship is not oneway traffic. অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি, মহল, জাতি বা দেশের সাথে মৈত্রী গড়তে হলে উভয় তরফেই ইচ্ছা, আগ্রহ, আন্তরিকতা এবং পর্যাপ্ত তৎপরতা থাকতে হবে।

কোনো বিশেষ রাষ্ট্রশক্তিকে পরীক্ষিত মিত্র, ‘জানের দোস্ত’ কিংবা ‘প্রাণের সখা’রূপে চিরস্থায়ীভাবে গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত কিংবা বাস্তবসম্মত নয়। যে রাষ্ট্র কম দিয়ে বেশি নেয় এবং সর্বদা ‘নিজের বোঁচকা বাঁধা’য় ব্যস্ত থাকে, সে রাষ্ট্র যত বড়, শক্তিশালী, সমৃদ্ধ আর ঐতিহ্যবাহী হোক না কেন, তা সত্যিকারের বন্ধু হতে পারে না। ঈশপের গল্পের A friend in need, is a friend in deed কথাটা চিরন্তন সত্য। এদিক দিয়ে নেপাল ও বাংলাদেশসহ সবাইকে শুধু অতীত নিয়ে পড়ে না থেকে, বর্তমান নিয়ে বেশি ভাবতে হবে। আর তা করতে হবে দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us