১ শতংশের কাছে ব্যাংকের ৫০ ভাগ ঋণ
১ শতংশের কাছে ব্যাংকের ৫০ ভাগ ঋণ - ছবি : সংগৃহীত
সম্প্রতি আমাদের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল পার্লামেন্টে বলেছেন, দেশের ব্যাংকগুলোতে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে তার অর্ধেকই আছে মাত্র ১ শতাংশ ঋণগ্রহীতার কাছে। তাদের সংখ্যা মাত্র ৩০০ এবং তাদের খেলাপি ঋণের অঙ্কটি ৫০ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা (সূত্র: ২৩ জুন, ২০১৯ ডেইলি স্টার)। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়নি বলেও মনে করেন অর্থমন্ত্রী। বাংলাদেশে মোট কুঋণের পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রী কিছু ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়কে দায়ী করলেও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতাকে বড় করে দেখব এবং বলব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়ভারটিই বড়। কারণ, এখানে আইন থাকলেও তা প্রয়োগ করা হচ্ছে না। আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যত সমস্যা বিরাজ করছে তার মূলে এটাই। এই কাজটি তো কেন্দ্রীয় ব্যাংকই করা দায়িত্ব। আমরা রাজনৈতিক নেতাদের দোষ দেই, কিন্তু পর্দার আড়ালের চিত্র ভিন্ন।
বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। অনেকে মনে করেন, এটা অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে। আসলে তা নয়। এর যে চার্টার রয়েছে, তা মানা হলে এটাকে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না; যদিও গভর্নরকে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। অনেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দোষ দেন অর্থমন্ত্রণালয়ের চাপের কাছে নতি স্বীকার করার জন্য। পার্লামেন্টে আইন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে যেসব ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা চাইলেও অর্থমন্ত্রণালয় পরিবর্তন করতে পারবে না, সেগুলোও যেন তারা ভুলে বসে আছে। যারা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো ক্ষমতা দেয়া হোক, তাদের সাথে আমার দ্বিমত হলো- কেন দেয়া হবে? যা দেয়া হয়েছে সেগুলোর প্রয়োগ কোথায়? যে দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি তারা পালন করছেন না। ফলে আরো ক্ষমতা দেয়া হলে সেগুলো প্রয়োগ করতে পারবেন- তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর আইনি ক্ষমতা যদি প্রয়োগ করতে না পারেন, তাহলে তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকা আর না থাকা সমান কথা। আইনে দেয়া ক্ষমতাগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে অর্থ মন্ত্রণালয় বাধা দেয়ার কথা নয়। সে ক্ষমতা অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেই। সে ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীরও নেই। আইন পরিবর্তন করতে হলে পার্লামেন্টে যেতে হবে।
এরশাদের সময় আমাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। তখন আমি আইডিবিতে ছিলাম। তখনকার পত্রিকাতেও এ নিয়ে খবর ছাপা হয়েছে। বিনীতভাবে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। এর মূল কারণ ছিল, আমি কোনো ব্যক্তির অধীনে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিনি। এই কলামেই লিখেছি, পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করার সময় আইয়ুব খানের বন্ধু কবি হাফিজ জলন্ধরীর সম্মানী নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলাম। সরকারি আইনে সেই ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়েছিল। হাফিজ জলন্ধরীর সাথে প্রেসিডেন্টের বন্ধুত্বের কথা আমি জানতাম। কিন্তু তাই বলে তার অস্বাভাবিক পরিমাণ সম্মানী গ্রহণের ব্যাপারে আপত্তি জানাতে পিছপা হইনি। আমি শুধু আইনে দেয়া ক্ষমতা ব্যবহার করেছি। শেষ পর্যন্ত সে ফাইল প্রেসিডেন্টের কাছে যায় এবং তিনি আমার নোট বাতিল না করে শুধু লিখেন, ‘মানবিক কারণে তাকে ওই সম্মানী দেয়া যেতে পারে।’ ওই ফাইলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। তাই আমি এ কথাই বলছি, আজ আমাদের দেশে আর্থিক খাতে বিশেষ করে ব্যাংকগুলোতে যে অনিয়ম চলছে, সেগুলো ব্যাংলাদেশ ব্যাংকই দূর করতে পারে শুধু তাকে দেয়া ক্ষমতার সুষ্ঠু প্রয়োগ করে। সেই আইন প্রয়োগ করতে গেলে কেউ বাধা দিতে আসবে না। যেমন : ব্যাংকিং কোম্পানি আইন (১৯৯১)-এর ১৪(ক) ধারায় রয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাংকের শেয়ার কেন্দ্রীভূত করা যাইবে না এবং কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা কোনো পরিবারের সদস্যগণ একক, যৌথ বা উভয়ভাবে কোনো ব্যাংকের শতকরা দশ ভাগের বেশি শেয়ার ক্রয় করিবেন না।
এর ব্যাখ্যা হয়েছে : কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, একক বা অন্যের সাথে যৌথভাবে, কোনো ব্যাংক কোম্পানির মালিকানা স্বত্বের শতকরা পাঁচ ভাগের অধিক শেয়ার ধারণকে বুঝাইবে।
সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (সিএসই), ২২ নভেম্বর ২০১১ সালে, এক নির্দেশনায় বলেছে : তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের এককভাবে ২ শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হবে। আরো বলা হয়েছে : ‘ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক হতে হলে ২ শতাংশ পেইড আপ ক্যাপিট্যাল থাকতে হবে। সাধারণ শেয়ার কিনেও পরিচালক হওয়া যাবে, কিন্তু তার জন্য ৫ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে।’
সাধারণভাবে কোনো ব্যক্তির শেয়ার বলতে আমরা বুঝি, কেউ নিজে যতগুলো শেয়ার কিনেছেন, সেই শেয়ারগুলো। কেউ শেয়ারবাজারে যাচ্ছেন; সেখান থেকে এসব শেয়ার কিনছেন, বিক্রি করছেন, ইত্যাদি। কিন্তু ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৪(ক) ধারায় ‘ব্যক্তির’ শেয়ার বলতে বুঝানো হয়েছে তার নিজের, তার স্ত্রীর, তার পিতা-মাতার, তার ছেলে-মেয়ে, তার ভাই-বোন এবং তার ওপর নির্ভরশীল সবার শেয়ার। ফলে সেখানে যদি কোনো সমস্যা পাওয়া যায় এ জন্য এরা সবাই দায়ী হবে।
সব পরিচালকের মিলে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। এর অর্থ হলো, একটি বিশাল অঙ্কের মালিক হচ্ছে ‘বোর্ড অব ডাইরেক্টরস’। তাহলে তারা অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে পারেন। কিন্তু দশটা, পাঁচটা শেয়ার নিয়ে কেউ পরিচালক হয়ে বসলে তার তো কোনো দায়িত্ব থাকে না। এর মানে হলো, যখন রাজনৈতিক চাপ বা অন্যান্য অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন শেয়ার থাকা পরিচালকেরাই এতে বাধা দেবেন, যখন তিনি দেখবেন যে, তার টাকা চলে যাচ্ছে।
কোনো ব্যাংকে কারো এ ধরনের শেয়ার, তার স্বার্থ আছে এমন সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ৫ শতাংশের বেশি থাকতে পারবে না। সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত থাকতে পারে তবে তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমতি নিতে হবে। এটা একটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স প্রক্রিয়া। এই আইন পরিবর্তনের জন্য একটি মহল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু আধা-বিচারিক (quasi-judicial) ক্ষমতা বলে এসইসি ওই নির্দেশনা জারি করেছে। ফলে আদালত তা পরিবর্তন করতে পারেনি। এই ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য পার্লামেন্টে আইন করতে হবে।
কোন পরিচালক কাকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, কার কত শেয়ার আছে, এটা বের করা কি বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য কঠিন? তাহলেই ‘থলে থেকে কালো বিড়াল বেরিয়ে আসবে’। তখনই ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে আছে, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক বুঝতে পারবে। এই বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের জানা নেই, তা নয়। কিন্তু বিষয়গুলো জনগণেরও জানা উচিত। সে কারণেই আমার এই লেখা। স্পন্সর পরিচালক এবং পরিচালক এক কথা নয়। সংজ্ঞা আলাদা। যেকোনো লোক ব্যাংকের ডিরেক্টর হতে পারেন, কিন্তু সবাই স্পন্সর পরিচালক হতে পারেন না।
বাজার থেকে শেয়ার কিনে ডিরেক্টর করার উদ্দেশ্য ছিল, মালিকানা ছড়িয়ে দেয়া; কয়েকজন ব্যক্তির হাতে মালিকানা সীমাবদ্ধ না রেখে অনেককে তার অংশীদার করা। এটা সরকারের সদিচ্ছা। আবার রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে ইচ্ছেমতো নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যও আইন পরিবর্তন করেছে। এরপরও যতটুকু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তারও প্রয়োগ না থাকার কারণে আজ ব্যাংকখাতের দুর্দশা। এর জন্য একজন সাহসী গভর্নর আমাদের প্রয়োজন।
এই আইন প্রয়োগ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরোপুরি ব্যর্থ। এমন অনেকের কথা জানি যাদের ক্ষেত্রে এই আইন মানা হয়নি। ব্যক্তিবিশেষের প্রতি ইঙ্গিত করছি না। আমি শুধু বলছি, যে আইন আছে সেটা প্রয়োগ করার জন্য। তাহলেই সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমরা কেন আইন প্রয়োগ না করে অন্যকে দোষ দেবো? গভর্নর বা সিকিউিরিটিজ এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান কেন দেখছেন না কয়জন ডাইরেক্টরের ৫ শতাংশ শেয়ার আছে। এখানে হাত দিলেই তো আজ ব্যাংকগুলোর অনেক সমস্যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাধান হয়ে যায়। নিজে ছয় বছর একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলাম। তাই ব্যাংকগুলোর প্রতি আমার দরদ আছে। আমরা তো স্বল্প আয়ের লোকজনের কাছ থেকে টাকা পয়সা এনে ধনীদের দিচ্ছি। বেসরকারি ও সরকারি সব ব্যাংকের আজকের দুর্দশার কারণ, আইনের প্রয়োগ না হওয়া। সরকারি ব্যাংকগুলো যেভাবে বছরের পর বছর ধরে ঋণখেলাপি হচ্ছে তাদেরকে কেন পুষতে হবে, সেই প্রশ্ন আমার। কোনো ছাত্র একই ক্লাসে ১০ বছর ফেল করলে তাকে আর রাখা হয় না। তাহলে বছরের পর বছর ফেল করে যাচ্ছে যেসব ব্যাংক, সেগুলোকে কেন আমরা রাখছি?
আমি মনে করি, একটি সরকারি ব্যাংক রেখে সবগুলোই বন্ধ করে দেয়া উচিত। অথবা সবগুলোকে একটি ব্যাংকে একীভূত করা উচিত। ‘মার্জার ল’ তৈরি করে এর বাস্তবায়ন করতে হবে। যত দূর জানি আমাদের দেশে ‘একুইজিশন অ্যান্ড মার্জিং’ আইন নেই। ক্যান্সার কখনো পেইনকিলার দিয়ে সারানো যায় না। যে অঙ্গে ক্যান্সার হয়েছে সেটি কেটে ফেলে দিতে হবে। সরকারি ব্যাংকগুলো আজ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে আমি নিশ্চিত, সামাজিক বিপ্লব ঘটবে। আজ যখন চেক দিয়ে গ্রাহক তার টাকা পায় না তখন তার মাথা খারাপ হওয়ারই কথা। তখন তো খুনোখুনি হরতে পারে। এর জন্য দায়ী হবে বাংলাদেশ ব্যাংক, তার আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ না করার কারণে। এখানে অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো দোষ নেই।
কোম্পানি আইনের সেকশন ৪৫-এ রয়েছে। ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে, সে জনস্বার্থে কাজটি করছে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করতে পারে। সে নিজেই এর জন্য বিধি তৈরি করতে পারে।’ এটা কি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়? এ বিষয়টি আমি জেনেছি ড. জহিরের কাছ থেকে। তিনি আমার বন্ধু ও সহপাঠী। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কি কখনো নিজের এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে?
রাজনৈতিক চাপকে দোষ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আইনের কথা বলা হচ্ছে না কিংবা আইন অনুসরণ করা হচ্ছে না। যখন এসআইবিএলের সিটিং চেয়ারম্যান ছিলাম, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বহু মন্ত্রীর কাছ থেকে বহু অনুরোধ পেয়েছি। আমি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় প্রথমে বিএনপি, পরে আওয়ামী লীগের আমল পেয়েছিলাম। বিনীতভাবে সব অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। ব্যাংকিং কার্যক্রমকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করেছি সব সময়। এটা অন্যের বেলায় যেমন সত্য, আমার নিজের বেলাতেও সত্য। এসআইবিএলের যাত্রা শুরুর পর ব্যাংকের জন্য কেনা সব গাড়ি রাখার জায়গা ছিল না। আমার বারিধারার বাসায় এর অনেকগুলো গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করি। কিন্তু আমার পরিবারের কেউ কখনো এর একটিও ব্যবহার করেনি। এমনকি আমার স্ত্রীও নয়। ব্যাংক থেকে অনেক সময় তাকে যেকোনো একটি গাড়ি ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু আমি বলে দিয়েছিলাম যে- চেয়ারম্যান হিসেবে আমার জন্য ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী গাড়ি বরাদ্দ আছে, কিন্তু আমার স্ত্রীর জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। তার কোনো কাজ থাকলে তাকে আমার সাথে আমার গাড়িতে যেতে বলেছি। এতে কেউ আপত্তি করবে না।
কিন্তু আইন উপেক্ষা করে আমার স্ত্রী যদি সে কাজটি করত, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারত। আসলে তখন ব্যাংকে বিনিয়োগের কারণে আমার হাতে ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার মতো টাকা ছিল না। আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ হওয়ার কারণে মাঝে মধ্যে বাড়িতে যেতাম ব্যাংকের গাড়ি নিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন অনুুযায়ী ব্যাংকের চেয়ারম্যান কোনো জানান না দিয়েই যেকোনো শাখা পরিদর্শনে যেতে পারেন। যাওয়া-আসার জন্য তেল খরচ হতো, অন্যান্য খরচও ছিল। আমি নিজে তেলের খরচ দিয়েছি। আমার ড্রাইভার বলেছে স্যার, এটা ব্যাংকের গাড়ি, এখানে ব্যাংকের শাখাও আছে। ব্যাংক থেকেই তো খরচ বহন করতে পারে। আমি বলেছি না, ব্যক্তিগত কাজে এসেছি। কেউ না দেখুক, আল্লাহ তো দেখছেন আমি কোন নিয়তে এসেছি। গাড়িটি নিয়ে এক মাইল দূরে ব্যাংক থেকে ঘুরে এলেই আমার টাকাটা হালাল হয়ে যেত। কিন্তু আমার মন কখনো এ ধরনের কাজে সায় দেয়নি।
ছয় বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলাম। আমার জন্য ব্যাংকে আপ্যায়নের কোনো বিল দিতে হয়নি। আমার সাথে তো ক্লায়েন্টদের কোনো ডিল ছিল না, সেটি ছিল এমডির কাজ। তিনি ক্লায়েন্টকে আপ্যায়ন করতে পারেন ব্যাংকের টাকায়। আমার গেস্টদের জন্য ব্যক্তিগত টাকায় সামান্য কিছু আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকত। ব্যাংকের কোনো কোনো পরিচালক আমার কাছে এসে নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন আইনবহির্ভূতভাবে ঋণ পাওয়ার জন্য। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছেন। এমনও হয়েছে যে, আমি বুঝতে পেরেছি কোন কোন ঘটনায় এমডি প্রভাবিত হয়েছেন। তখন প্রকাশ্য বোর্ড মিটিংয়ে বলেছি, ‘আপনি যে ঘুষ খেয়েছেন, সেখানে আমার ভাগটি কোথায়? তা না হলে আপনি কি এ ধরনের মেমো আনতে পারেন?’
আমি আরো বুঝাতে চাচ্ছি, একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান যদি নির্মোহ, সৎ, দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন হন তাহলে ব্যাংকের ৯০ শতাংশ সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। ফলে আমার সময়ে ব্যাংকটির ওভারডিউ লায়াবিলিটি ছিল ২ শতাংশের কম। দেশের অন্যতম সেরা ব্যাংক ছিল এটি- ‘এ+ ব্যাংক’। একসময় যখন দেখলাম, পরিচালকেরা একের পর এক ঋণ নেয়ার জন্য আসছেন। আর এ চাপ তো আমি সহ্য করতে পারব না। তখন নিজের জন্য ‘মেমো’ তৈরি করি। সেখানে আমার নিজের ও আমার পরিবারের সব সদস্যের জন্য আজীবন ব্যাংক থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছি। কোনো সিটিং চেয়ারম্যান এ ধরনের ‘মেমো’ আনতে পারেন বলে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
আজকে বেসিক ব্যাংকের, ফার্মার্স ব্যাংকের কেন এই দুর্দশা? আমার সময়ে বেসিক ব্যাংক ছিল সরকারি খাতের নম্বর ওয়ান ব্যাংক। আজ সেটি কোনো নাম্বারেই নেই। আমাদেরটি ছিল বেসরকারি খাতে নম্বর ওয়ান। তাই আমি বলব, নিজকে সংশোধন করো। কথায় আছে ‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম’। এখনো ব্যাংকিংয়ের যেসব আইন আছে, তা এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com