শ্রীলঙ্কায় কাশ্মির ফাঁদে ধরা পড়েছে ভারত!
গোতাবায়া ও মোদি - ছবি : সংগৃহীত
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ স্বায়াত্তশাসন-সংবলিত সাংবিধানিক ব্যবস্থা বাতিল করার ভারতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপটি এখন শ্রীলঙ্কার হিন্দু তামিল সংখ্যালঘুদের নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেছে দিল্লি।
ভারতের সর্বদক্ষিণের রাজ্য তামিল নাড়ুর বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন যে জাতীয়তাবাদী প্রচারণার মাধ্যমে জয়ী শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের তামিল প্রাধান্যপূর্ণ প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাখ্যান করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন।
মোদি ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ সফরের সময় ১৩তম সংশোধনী পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধবাদী সিংহলি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালের ওই সাংবিধানিক ব্যবস্থায় তামিল হিন্দুদের সাথে সমন্বয় সাধনের কথা বলা হয়েছিল।
মোদি বলেছিলেন, আমরা বিশ্বাস করি যে ১৩তম সংশোধনীর দ্রুত ও পূর্ণ বাস্তবায়ন এই প্রক্রিয়ায় অবদান রাখবে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপাকসার (নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্টের বড় ভাই ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) বক্তব্য সামনে এনে গ্রন্থকার ও ভাষ্যকার শাস্ত্রী রামচন্দ্রন আনাদুলু এজেন্সিকে বলেন যে ভারত আর তামিল সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য কলম্বোকে রাজি করাতে সক্ষম হবে না।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় মহিন্দা রাজাপাকসা (তিনিই ক্ষমতাসীন পদুজানা পেরামুনা- এসএলপিপি-এর নেতা) বলেছিলেন যে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিতর্কটি এখন জম্মু ও কাশ্মিরের ঘটনাবলী বিবেচনা করবে।
যেকোনো ধরনের কূটনৈতিক ও ঘরোয়া বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়ানোর দ্রুত প্রয়াসের অংশ হিসেবে ভারত রাজাপাকসা নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের এক দিন পরই চৌকষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামেনিয়াম জয়শঙ্করকে কলম্বো পাঠিয়েছিল।
মন্ত্রী নতুন প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাত করেন, তাকে ভারত সফরের জন্য মোদির আমন্ত্রণ পৌঁছে দেন। রাজাপাকসা তা গ্রহণ করেন। নতুন প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাতকারী প্রথম বিদেশী অতিথি হলেন জয়শঙ্কর। ২৯ নভেম্বর রাজাপাকসা ভারত সফরে যেতে পারেন। এটি হবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তার প্রথম বিদেশ সফর।
ভারতের তামিল নাড়ুর রাজনীতিবিদ ও আইনপ্রণেতা ভি গোপালস্বামী (ভাইকো নামেই বেশি পরিচিত) বলেন, এই অঞ্চলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যই মোদি সরকার এই ঠেক দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
তামিল নাড়ুর অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলের সাথে গোপালস্বামীও কাশ্মিরে নয়া দিল্লির পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। তারা বিশ্বাস করেন যে কাশ্মিরের পদক্ষেপটি কেবল ভারতেই নয়, শ্রীলঙ্কাতেও প্রভাব ফেলবে।
তিনি মনে করেন, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজাপাকসার জয়ী হওয়াটা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর ফলে নয়া দিল্লির ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে।
ভাইকো বলেন, এই নির্বাচনে তামিলদের বেশির ভাগ ভোট দিয়েছিল সাজিথ প্রেমাদাসাকে। তাদের আশঙ্কা ছিল, গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হলে তাদের ওপর ঝামেলা সৃষ্টি হবে। গোতাবায়ার জ্বালাময়ী বক্তৃতাই তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোট পেতে সহায়তা করেছে।
তিনি বলেন, অতীতে তামিলরা অনেক সমস্যায় ছিল। কিন্তু একদিন অবশ্যই ন্যায়বিচারেরই জয় হবে। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার তামিলদের স্বার্থ সুরক্ষা করার দায়দায়িত্ব ভারত সরকারের ওপরই ন্যস্ত রয়েছে।
ভারতের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি শ্রীলঙ্কার নির্বাচনে
ভারতের প্রতিবেশীদের অবস্থা নিয়ে গ্রন্থের লেখক রামচন্দ্রন বলেন, শ্রীলঙ্কার নির্বাচনের ফলাফল মোদির প্রত্যাবর্তনেরই অনুকরণ ঘটেছে। মোদিও হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভোট ব্যাংকের ওপর ভর করে জয়ী হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, গোতাবায়াও সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে জয়ী হয়েছেন। বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা আকাঙ্ক্ষা করেছিল একজন শক্তিশালী নেতার। তারা রাজাপাকসার মধ্যে সেটিই পেয়েছিল। গোতাবায়া সেটিই কাজে লাগিয়েছেন।
তিনি বলেন, মোদির বিজেপি পাকিস্তান ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। আর শ্রীলঙ্কায় এসএলপিপি কাজে লাগিয়েছে ভারত আর তামিলদের।
রাজাপাকসা তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেমাদাসাকে ১৩ লাখ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। বৌদ্ধ প্রাধান্যপূর্ণ দক্ষিণ, পশ্চিত ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে তিনি জয়ী হয়েছেন।
সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এম কে ভদ্রকুমার বলেন, ভারতের মতোই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগিয়ে শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার জয়ী হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে ভারত ও পাশ্চাত্য মিলে মহিন্দা রাজাপাকসাকে হারিয়ে দিয়েছিল। মহিন্দা অভিযোগ করেছিলেন যে ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তিনি শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর স্টেশন চিফ কে ইলাঙ্গোকে ফিরিয়ে নিতে ভারতকে বাধ্য করেছিলেন। মহিন্দা মনে করতেন, এই লোকটিই তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক জোট গড়েছিলেন।
তামিলদের জন্য কঠিন সময়
ভদ্রকুমার বলেন, রাজাপাকসা শ্রীলঙ্কার তামিলদের ফেডারেশনভিত্তিক শ্রীলঙ্কা গড়ার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি আশঙ্কা করছেন, তামিলরা এই সরকারের আমলে কঠিন অবস্থায় পড়বে।
তিনি বলেন, এই সরকারের আমলে শ্রীলঙ্কায় চীনা উপস্থিতি বাড়বে।
রামচন্দ্রন বলেন, কলম্বোর সাথে সম্পর্ক রক্ষার সময় ভারতের উচিত হবে না দেশটিতে চীনা উপস্থিতিকে কোনো ইস্যুতে পরিণত করা। ভারতের উচিত হবে, চীনের সাথে প্রতিবেশীদের ব্যবসা করার বিষয়টি মেনে নেয়া। কারণ খোদ ভারতই ব্যবসা করছে চীনের সাথে। এসব দেশে চীনের আইনসম্মত স্বার্থ রয়েছে।
এদিকে ভারতীয় রাজ্য তামিল নাড়ুর বেশির ভাগ লোক শ্রীলঙ্কার তামিলদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। তামিল নাড়ুকে বিবেচনা করা হয় জম্মু ও কাশ্মিরের পর দ্বিতীয় সবচেয়ে স্পর্শকাতর অঞ্চল। এখানে রাজ্য বিধান সভার নির্বাচন হবে ২০২১ সালে। রামচন্দ্রন বলেন, তামিল নাড়ুর স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা শ্রীলঙ্কায় তামিলদের সাথে আচরণকে নির্বাচনীয় ইস্যুতে পরিণত করতে পারেন।
তিনি বলেন, মোদির মতোই গোতাবায়া কঠিন লোক। তার সাথে বাড়াবাড়ি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
ভারত ১৯৮৭স সাল থেকে শ্রীলঙ্কার তামিল রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে আছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে ওই সময়ের শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট জে আর জয়াবর্ধনের সাথে একটি চুক্তি করেছিলেন। তাতে তামিল প্রাধান্যপূর্ণ প্রদেশের হাতে আরো ক্ষমতা দেয়ার কথা ছিল।
এর জের ধরে ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট ১৩তম সংশোধনী পাস করে। কিন্তু কলম্বোর পরে সরকারগুলো এই পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়ন করেনি। তারা তামিল এলাকাগুলোতে তামিল টাইগারদের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল।
তামিল টাইগাররা কিন্তু চুক্তিটির বিরোধিতা করেছিল। ১৯৯১ সালে তামিল নাড়ুতে পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রচারকাজ চালানোর সময় রাজীব নিহত হন। ওই সময় এলটিটির মধ্যে আশঙ্কা ছিল যে রাজীব জয়ী হলে তিনি চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঠাবেন।
তিনি এর আগে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং সরকারের শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতীয় শান্তিরক্ষীদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন।
আনাদুলু এজেন্সি