এক রোহিঙ্গার করুণ আর্তি
এক রোহিঙ্গার করুণ আর্তি - ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকবার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে তাদের দেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশ ও বৃহত্তর অঞ্চলের জন্য নিরাপত্তাগত হুমকির প্রতিনিধিত্ব করছে। এই প্রেক্ষাপটে তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ওই সম্প্রদায়ের ওপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তবে তাদের দাবির সমর্থনে কোনো প্রমাণ নেই। আমরা রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করি যে আমাদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে যাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছাড়াই আমরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য হই।
ঐতিহাসিকভাবেই রোহিঙ্গারা আক্রমণকারী নয়, বরং তারা নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার। ইতিবাচর ও নিরাপদ সম্প্রদায় হিসেবে আবার গড়ে তোলার জন্য আমাদের প্রয়োজন অধিকারের, আমাদেরকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার কোনো প্রয়োজন নেই।
ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বিদ্রোহী মতাদর্শ দমন শীর্ষক এক সম্মেলনে বক্তৃতাকালে বলেছেন যে রোহিঙ্গা সঙ্কট এই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করেছে। তিনি তাদেরকে তাদের বাড়িতে ফেরার ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা লোকজন চরমপন্থীদের সহজ শিকারে পরিণত হতে পারে। ফলে যত দ্রুত মিয়ানমারে তাদের বাড়িঘরে ফেরত নেয়া যাবে, ততই মঙ্গল।
বাস্তবতা হলো, আমরা বধ্যভূমি থেকে এসেছি নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে। আমরা বাংলাদেশে বসবাস করতে আসিনি। এটি আমাদের দেশ নয়। আমরা ফেরার জন্য টেকসই সমাধান চাচ্ছি। আমরা তা নিশ্চিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এখানে থাকতে চাই।
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে তাদের বাড়িঘরে ফেরার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, তারা যত দ্রুত সম্ভব ফিরে যাবে, বাংলাদেশের জন্য ততই মঙ্গল। তার বক্তব্য সঠিক হলেও পরিস্থিতি ও অবস্থা আমাদেরকে এখনো ফেরত যেতে দেয়নি। আমাদের নিরাপত্তা, আমাদের নিরাপদে থাকা, আমাদের নাগরিক অধিকারের কোনো নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। অধিকন্তু, আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়া লড়াইয়ের ফলে রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা ছাড়া রোহিঙ্গারা নিরাপদে থাকবে না।
ক্যাম্পে বসবাসকারীদের জন্য নিরাপত্তা আরেকটি বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ সরকার বলছে যে তারা ক্যাম্পগুলোর চারপাশে বেড়া দেবে। এতে করে আমাদের রক্ষা করা সহজ হবে। আমরা এই পদক্ষেপের কার্যকারিতার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করছি। আমরা মনে করি, এসব বেড়া আমাদের নিরাপদ রাখবে না, বরং এটা আমাদের জীবনের ওপর আরো বিধিনিষেধের সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ আমাদের দেশ নয়, আমরা এখানকার নাগরিক নই। তা সত্ত্বেও মৌলিক মানবাধিকার পাওয়ার অধিকার আছে আমাদের। সব মানুষের মতো আমাদেরও শিক্ষা, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে। এগুলোই আমাদেরকে অপেক্ষাকৃত কম নাজুক, অপেক্ষাকৃত কম অপরাধপ্রবণ জাতি হিসেবে গড়ে ওঠতে সহায়তা করবে।
সেপ্টেম্বর থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। রোহিঙ্গাদের মোবাইল ফোনগুলো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা জব্দ করেছে। বাংলাদেশের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে ক্যাম্পগুলোর ইন্টারনেট ব্লক করা হয়েছে। এর অনেক নেতিবাচক পরিণাম রয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে মিয়ানমারে আমাদের পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা ক্যাম্পগুলোতেও নিরাপত্তার হুমকিতে পড়েছি। আমরা পুলিশকে সেগুলো জানাতেও পারছি না।
অপরাধমূলক তৎপরতা থামাতে আমাদের প্রয়োজন আরো বেশি নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি। সেইসাথে যোগাযোগব্যবস্থাও প্রয়োজন। দিন দিন অপরাধমূলক তৎপরতা বাড়ছে, পাচার বাড়ছে, কিন্তু সময়মতো নিরাপত্তা বাহিনীকে জানানো যাচ্ছে না।
সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ওপর আরো কিছু কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে এনজিওগুলোর সাথে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার ওপর কড়াকড়ি। এছাড়া আমাদের শিক্ষা, চলাচলের স্বাধীনতার ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, আমাদের মানবাধিকারগুলো ক্রমাগত খর্ব করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ২০১৭ সালে আমাদের মারাত্মক প্রয়োজনের সময় আমাদের প্রতি যে মানবিকতা প্রদর্শন করা হয়েছে, তা আমরা কখনো ভুলব না। আমরা যখন জীবন নিয়ে পালাচ্ছিলাম, তখন সীমান্তগুলো খুলে দেয়া হয়েছিল। আমাদের স্মারক অনুষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতাও প্রতিফলিত হয়। আমরা বাংলাদেশী ভাইবোনদের প্রতি কোনো হুমকি নই। অনুগ্রহ করে আপনাদের দেশে আমাদেরকে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে দিন, আমাদের বাড়িঘরে, আমাদের দেশে ফেরত যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদের নিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করুন।
এশিয়া টাইমস