রাসূল সা:-এর প্রধান বড় দু’টি কাজ
রাসূল সা:-এর প্রধান বড় দু’টি কাজ - ছবি : সংগ্রহ
রাসূল সা:-এর প্রধান বড় দু’টি কাজ ছিল। একটি হলো তাওহিদ অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা। অপরটি মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তাওহিদ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আলোচনা করলে দেখতে পাবো যে, তখন দুনিয়ায় কোথাও তাওহিদ প্রতিষ্ঠিত ছিল না। চীনে, ভারতে, ইউরোপে বা আফ্রিকায় কোথাও তাওহিদ ছিল না। ওইসব দেশে মূলত কাল্পনিক দেবদেবীর পূজা করার পাশাপাশি প্রকৃতির পূজা করা হতো। সে সময়ে এমনকি, আরব দেশেও তাওহিদ প্রতিষ্ঠিত ছিল না। এ কারণে তারা হজরত ইব্রাহিম আ:-এর সুমহান শিক্ষাও ভুলে গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে হজরত মুহাম্মদ সা: নির্ভেজাল তাওহিদের প্রচার করেছিলেন।
নির্ভেজাল তাওহিদের একমাত্র স্রষ্টা হচ্ছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। তার কোনো শরিক নেই, তার কোনো পুত্র-কন্যা নেই, তার নেই কোনো স্ত্রী। সব উত্তম গুণই তার। তিনি সৃষ্টি জগতের সব কিছুরই দেখভাল করছেন। তাকে সহায়তা করার জন্য কোনো দেবদেবীর বিন্দুমাত্রও প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তায়ালার কাজ সম্পাদনের জন্য ফেরেশতারা নিযুক্ত রয়েছে। রাসূল সা:-এর জীবনাদর্শের প্রভাবে আরব দেশের প্রায় সবটাই তার অধীন হয়ে যায় এবং তিনি গোটা আরব দেশেই তাওহিদের বিস্তার ঘটালেন। যারা রাসূল সা:-এর সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন, তারা তাওহিদের পূর্ণ অনুগত ছিলেন। অবশ্য তৎকালীন আরবের বেশির ভাগ মানুষ পূর্ণভাবে তাওহিদের যথাযথ অনুসরণ করতে পারেনি। কারণ, তারা শিক্ষিত ছিল না; তেমনিভাবে প্রাচীন গোত্রীয় প্রভাব থেকেও তারা মুক্ত হতে পারছিল না।
রাসূল সা:-এর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। মদিনায় রাসূল সা:-এর আগে রাষ্ট্র ছিল না। সেখানে কয়েকটি গোত্র ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রের আলাদা আলাদা নেতা ছিলেন। কিন্তু গোটা মদিনায় একজন নেতার অধীনে একক রাষ্ট্র ছিল না। তেমনিভাবে মক্কাও কোনো রাষ্ট্র ছিল না। সেখানে কুরাইশ ছাড়াও অন্যান্য গোত্র ছিল। প্রত্যেকের শাসন ছিল আলাদা আলাদা। প্রকৃতপক্ষে আরব দেশে কোনো রাষ্ট্রই ছিল না। রাসূল সা: সর্বপ্রথম মদিনায় রাষ্ট্র স্থাপন করেন। তার সময়েই গোটা আরব ভূমি এ রাষ্ট্রের অধীনে চলে আসে।
রাষ্ট্রব্যবস্থা ইসলামেরই যে অংশ অবিচ্ছেদ্য, তা তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে প্রমাণ করে গেছেন। এক পর্যায়ে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে তিনি বাধ্য হলেন। এর আগে রাসূল সা: ১৩ বছর মক্কায় ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। এতে কিছু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু তারা মক্কায় টিকে থাকতে পারেননি। ফলে তারাও মদিনায় হিজরত করেন। মক্কায় থাকাকালে রাসূল সা: কে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে। এমনকি তার দাওয়াতি মিশনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য নগ্নভাবে বিরোধিতা করা হলো। সে পর্যন্ত তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এ অবস্থায় রাসূল সা: আল্লাহ তায়ালার নির্দেশেই মদিনায় হিজরত করেন।
মদিনায় পৌঁছে রাসূল সা: একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। মদিনার সব গোত্রের এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য তিনি একটি সনদ দেন, একে ‘মদিনার সনদ’ বা মিসাক আল মদিনা বলা হয়। মদিনার সনদ রাসূল সা: দিয়েছিলেন এবং ইহুদিরা পর্যন্ত এ সনদ মেনে নিয়েছিল। মদিনার সনদ ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ দিয়ে শুরু হয়েছিল। ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, এটা বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান। এর দীর্ঘ বারো শ’ বছর পরে যুক্তরাষ্ট্রে লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করা হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে।
মদিনার সনদে বলা হয়েছিল, মুসলিম জাতি একটি উম্মাহ। সব মুসলমান তারা যেখানে থাকুক না কেন, ইসলামী উম্মাহরই অংশ। তেমনিভাবে ইহুদিরা একটি উম্মাহ। আদর্শভিত্তিক জাতিকে উম্মাহ বলা হয়। এ সনদে আরো বলা হয়েছিল, মদিনার সব অধিবাসী মিলে একটি উম্মাহ। অর্থাৎ এ সনদে ভৌগোলিক জাতীয়তারও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। মদিনা সনদে আরো বলা হয় যে, মদিনার সব মানুষের অধিকার সমান।’ এসব থেকে প্রমাণিত হয়, মদিনা রাষ্ট্রে সব নাগরিক সমান অধিকার পেয়েছিলেন। তারা সবাই ছিলেন একই রাষ্ট্রের নাগরিক। এ রাষ্ট্রে ইহুদিদের জন্য স্বায়ত্তশাসন ছিল। অর্থাৎ স্বায়ত্তশাসন দেয়া ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম নীতি হিসেবে গণ্য।
মদিনা রাষ্ট্রের আরেকটি বিষয় ছিল, রাষ্ট্রের অসহায় নাগরিকদের দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করেছিল। রাসূল সা:-এর বিখ্যাত উক্তি, যা সিয়া সিত্তাহতে বর্ণিত হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি সম্পদ রেখে মারা যান, তবে তা তার উত্তরাধিকারীর প্রাপ্য। কিন্তু সে ব্যক্তি যদি কোনো অসহায় সন্তান রেখে যান, তাহলে তার দেখভালের দায়িত্ব রাষ্ট্রের।’ এ রকম রাষ্ট্রকে ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ বলা হয়। তাই বলা যায়, মদিনা রাষ্ট্রের আগে পৃথিবীতে কোনো কল্যাণ রাষ্ট্র ছিল না। আধুনিককালে ইউরোপের কয়েকটি রাষ্ট্র ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি হচ্ছে, আধুনিক গণতন্ত্রের চেয়ে আরো উন্নত একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার