ভূস্বর্গ কাশ্মির যেভাবে হয়ে গেল নরক
ভূস্বর্গ কাশ্মির যেভাবে হয়ে গেল নরক - ছবি : সংগৃহীত
মুবিন-উর-রহমানের জন্য কাশ্মিরে দিন কাটানোর চেয়ে অস্বস্তিকর আর কিছুই হতে পারে না। পেশায় চিত্রকর এই ২৩ বছর বয়স্ক তরুণের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। তার চাচা যখন তাকে কাশ্মিরে নিয়ে আসতে রাজি হয়েছিলেন, তিনি খুশিতে টগবগ করছিলেন। ভারতের মুসলিম শ্রমিক শ্রেণির বেশির ভাগের জন্য কাশ্মির ছিল স্বর্গের ঠিকানা।
কাশ্মিরের বেশির ভাগ লোকই ইসলামের অনুসারী। তারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মুসলিম শ্রমিকদের স্বাগত জানাতেন। বেশির ভাগ আসত বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে।
বরফ মোড়া পর্বতরাজিতে ঘেরা স্থলবেষ্টিত এই এলাকার তাপমাত্রা মধ্য গ্রীস্মেই ৩২ ডিগ্রির বেশি বাড়ত না। শ্রমিকদের বেশির ভাগই হতেন চিত্রকর, কাঠমিস্ত্রি ও ওস্তাগার। তাদের কাজের জন্য আদর্শ জায়গা।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে এখানে অনেক বেশি মজুরিও পাওয়া যেত। স্থানীয় লোকজনও তাদের সাথে ভালো আচরণ করতেন।
কাশ্মিরি অর্থনীতি অনেকটাই বাইরের শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। তারা কৃষিকাজ, নির্মাণকাজ, ক্ষৌরকাজ, ফাস্ট ফুডের দোকান পরিচালনা- সবই এসব শ্রমিক করত। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, কাশ্মিরের অ-স্থানীয় শ্রমিকদের সংখ্যা ৫ লাখ।
অবশ্য ৫ আগস্টের পর ওই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে নাটকীয়ভাবে। ওই দিন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে। এর ফলে রাজ্যটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি বাইরের লোকজনও এখানে জমি কিনে বসতি স্থাপনের সুযোগ পেয়ে যায়। তাছাড়া রাজ্যটিকে দুটি অংশে ভাগও করা হয়।
স্থানীয়রা এসব পদক্ষেপকে রাজ্যের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ চরিত্রের ওপর সরাসরি হামলা বলে বিবেচনা করে। তাদের মধ্যে শঙ্কার সৃষ্টি হয় যে হিন্দুদের বিপুল সংখ্যায় বসতি স্থাপন করিয়ে এখানকার জনসংখ্যার চিত্র বদলে ফেলা হবে।
অবশ্য সরকার বলছে, এর ফলে এখানে আরো বেশি মঞ্জুরির ব্যবস্থা করা যাবে, আরো বেশি উন্নয়ন কাজ হবে। এর ফলে দারিদ্র্য ও চাকরিহীনতা হ্রাস পাবে।
ওই ৫ আগস্ট ছিল সঙ্ঘাত-পীড়িত জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের জন্য জেগে ওঠার দিন। তারা দেখতে পায় বিপুলসংখ্যক ভারতীয় সৈন্য প্রধান প্রধান রাস্তা ও পয়েন্ট বন্ধ করে দিয়েছে, মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন, ল্যান্ড ফোনগুলোও অচল। ইন্টারনেটও বন্ধ পুরোপুরি। টিভি ক্যাবল নেটওয়ার্কগুলোকে তাদের পরিষেবা স্থগিত রাখতে বলা হয়।
এখন উপত্যকায় মোবাইল ফোন সার্ভিস আংশিকভাবে খুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু রাস্তাগুলোতে এখনো কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা।
আর ৪ আগস্ট সরকার অস্থানীয়দের (পর্যটক ও শ্রমিকসহ) সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব কাশ্মির ত্যাগ করতে বলে।
অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করার পর কাশ্মিরের বিভিন্ন পয়েন্টে উগ্র পোস্টার দেখা যায়। এতে অস্থানীয় শ্রমিকদের কাশ্মির ত্যাগ করতে কিংবা ‘পরিণতি ভোগ করতে’ হুঁশিয়ারি দেয়া হয়।
অবশ্য কাশ্মির ত্যাগ না করার ব্যাপারে মুবিন ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি এই এলাকা, এখানকার লোকজনের আতিথেয়তার মায়ায় পড়ে গিয়েছিলেন।
তিনি বরেন, আমি এখানে কোনো বিপদ অনুভব করিনি। আমার কাছে স্থানটি ছিল আমার বাড়ির চেয়েও নিরাপদ। এ কারণে আমি এলাকাটি ত্যাগ করিনি।
তিন মাসের বেশি সময় ধরে তিনি কোনো উপার্জন না করলেও তার কোনো অভিযোগ ছিল না। তিনি দার্শনিকের মতো বলেন, কেউ উপার্জন করেনি, আমিও ভিন্ন ছিলাম না।
কিন্তু ১৪ অক্টোবর তিনি প্রথমবারের মতো ভয় অনুভব করেন। সন্ধ্যায় তিনি খবর দেখছিলেন। শুনতে পেলেন, দক্ষিণ কাশ্মিরে অস্থানীয় কয়েকজন শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে।
১৫ দিন পর উগ্রবাদীরা দক্ষিণ কাশ্মিরে ছয় অস্থানীয় (পশ্চিমবঙ্গের) শ্রমিককে হত্যা করে। তারা আপেল বাগানে কাজ করতে এসেছিল। তারা তাদেরকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে।
উগ্রবাদীরা আগে থেকেই অস্থানীয় ভারতীয় শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের এলাকটি থেকে চলে যেতে বলেছিল। কিন্তু মুবিনের ওপর এর কোনোই প্রভাব পড়েনি। তিনি মাসে ৩০ হাজার রুপির মতো ভালো আয় করছিলেন। তিনি আগামী বছর তার মাকে হজে পাঠানোর জন্য টাকা পাঠানোর কথা ভাবছিলেন।
কিন্তু ওই হত্যাকাণ্ডের পর তার ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। এত ঠাণ্ডা মাথায় যেখানে হত্যা করা হয়, সেখানে বাস করা সহজ নয়। এখন আর স্থানটি তার বলে মনে হচ্ছিল না। তিনি কেবল তার মালিকের কাছ থেকে বকেয়া বেতন পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
একই উদ্বেগ পশ্চিমবঙ্গের কাঠমিস্ত্রি শাকিল হাসানেরও। তিনি মধ্য কাশ্মিরের শ্রীনগরে কাজ করতেন। তিনি ২০ বছর ধরে কাশ্মিরে কাজ করছিলেন। কখনো এই এলাকা ত্যাগ করার কথা ভাবেননি। কিন্তু এখন এই এলাকাকে বিপজ্জনক মনে করছেন।
কাশ্মিরিরা বাইরের এসব শ্রমিককে হানাদার মনে করে। তাদের মনে হচ্ছে, এসব লোক তাদের ভূমি দখল করতে চায়। ফলে শাকিলের কাছে স্থানটি শত্রু ভূমির মতো মনে হচ্ছে।
কামার আলী ২৩ বছর ধরে মধ্য কাশ্মিরের গান্দাবাল জেলার একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। তিনি এখন তার ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছেন, কাশ্মির ত্যাগ করবেন। তিনি বিহারের বক্সার জেলার লোক ছিলেন। পুরো পবিত্র কোরআন তার মুখস্ত। তিনি বলেন, এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা আগে কখনো ছিল না।
তিনি বলেন, গত সপ্তাহে কিছু তরুণ এসে গালাগাল করে গেছে। আমি শত শত তরুণকে কোরআন শিখিয়েছি, নামাজ পড়া শিখিয়েছি। এখন আমাকে মনে করা হচ্ছে কাশ্মিরের শত্রু। তারা মনে করছে, আমাকে এখানকার ভূমি দখল করার জন্য ভারত সরকর পাঠিয়েছে।
অবশ্য মুবিন মনে করেন, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, কাশ্মির সবসময় তার মনে থাকবে।
তিনি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, এই স্থানের জাদু আছে। এই স্থান সবচেয়ে সুন্দর, এখানকার লোকজন দারুণ। হয়তো আমি আর কখনো ফিরে আসব না। হয়তো এ স্থান আর কখনো দেখব না। কিন্তু একদিন আমার সন্তানদের এই স্বপ্নভূমির কথা বলব।