কালাপানি : নেপালি ভূমিতে চীন-ভারত লড়াই
কালাপানি : নেপালি ভূমিতে চীন-ভারত লড়াই - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের প্রকাশিত নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র নেপালে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে, কারণ এতে কালাপানিকে ভারতের নিজস্ব ভূখণ্ড হিসেবে দেখানো হয়েছে। নেপাল সরকার কালাপানিকে ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে এবং তা যথাযথ। নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুই দেশ তাদের নিজ নিজ পররাষ্ট্রসচিবদের মধ্যে পরামর্শের ভিত্তিতে সীমান্ত বিরোধ নিরসন করতে সম্মত হয়। ভারতের সর্বশেষ পদক্ষেপ সুস্পষ্টভাবেই ওই চুক্তির পরিপন্থী এবং বিশ্বস্ততার বরখেলাফ।
তবে এই প্রথম লিপালেখ ও কালাপানিতে জবর দখলের সমালোচনা করা হলো না। ভারত চায় সীমান্তে চীনা চলাচলের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে এবং তা করার ব্যাপারে সম্ভবত কালাপানি সবচেয়ে ভালো জায়গা। ভারত ১৯৫০-এর দশকে নেপালি ভূখণ্ডের মধ্যে ১৭টি চেক পোস্ট স্থাপন করেছে। উত্তর-পশ্চিমে কালাপানির একটি ছাড়া ১৯৭০-এর দশকে সবগুলো অপসারণ করা হয়। এরপর থেকে ভারতের জাতীয় মানচিত্র কর্তৃপক্ষ কালাপানি ও লিপুলেখ পাসের দক্ষিণ এলাকাটি অন্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছে। কিন্তু নেপালের হাতে লিপুলেখ, কালাপানি ও লিমপিয়াধুরা তার নিজের হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। ১৮২৭ ও ১৮৫৬ সালে ওই সময়ের ব্রিটিশ সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রকাশিত মানচিত্রগুলোতে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় যে এসব এলাকা নেপালের অংশ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। নেপালের উত্তর-পশ্চিমের লিমপিয়াধুরাকে ১৮১৬ সালে সুগুইলি চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী মহাকালি নদীর উৎস হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নেপালের ওই সময়ের রাজা কালি (মহাকালি) নদীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত সব ভূখণ্ডের দাবি পরিত্যাগ করেন। এর মানে হলো এই যে এর বাইরে থাকা ভূখণ্ড সবসময় ছিল নেপালের অংশ। অবশ্য নেপালের এই অংশের ওপর ভারতের বিশেষ আগ্রহ ছিল। কারণ এটা হলো চীন-ভারত-নেপালের মিলিত হওয়ার ত্রি-বিন্দু। নেপাল সরকারের করা সবচেয়ে বড় ভুল হলো নেপালের সীমান্তটি লিমপিয়াধুরা পর্যন্ত সম্প্রসারণের সুযোগটি মিস করা।
নেপালের অনুমোদন ছাড়াই দেশটির লিপুলেখের মতো এলাকাগুলো অন্তর্ভুক্ত করেই চীনের সাথে চুক্তি সই করেছে ভারত। ভারতের প্রকাশিত মানচিত্রে অনেক দিন ধরেই লিপুলেখকে তাদের বলে দেখানো হচ্ছে, নেপাল এর বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানায়নি। এর ফলে ভারত সুযোগ পেয়েছে ধীরে ধীরে এসব এলাকা দখল করার। বর্তমান মানচিত্রটি এসব ভূমি স্থায়ীভাবে দখল করার পথে একটি পদক্ষেপ।
ভারতের সর্বশেষ এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে নেপালের উচিত উদ্বেগ প্রকাশ করা, এ ব্যাপারে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে যাওয়া। ভারত সরকারের আশ্বাসের ওপর ভরসা করে বসে থাকা হবে বোকামি। বর্তমানে অস্তিত্বহীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে করা হলেও নেপাল এখনো সুগুইলি চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হলে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে, তা অনুসরণ করতে হবে। ভারত সরকার যদি তা মানতে না চায়, তবে নেপাল সরকারের উচিত হবে আত্মরক্ষামূলক কাজ করা, জাতিসঙ্ঘ সমাবেশগুলোতে তা তুলে ধরা।
নেপাল তার ভূমির বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে নিয়ে যেতে পারে। ভারত সরকার একতরফাভাবে যে সমস্যার সৃষ্টি করছে, তার স্থায়ী সমাধানের জন্য জাতিসঙ্ঘের দ্বারস্থ হওয়া উচিত। অবশ্য বাণিজ্য ও আর্থিক সহায়তাসহ অনেক বিষয়ে ভারতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল নেপাল। এ কারণে নেপালের কঠোরতর পদক্ষেপ হিতে বিপরীত হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি সতর্কভাবে, তবে উদ্দীপ্তভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
সীমান্ত বিরোধ নির্বুদ্ধিতার সাথে সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হলে তাতে রাজনৈতিক সঙ্কট ও বিদেশী-ভীতির সৃষ্টি করতে পারে। এটি ইতোমধ্যেই সীমান্তে উত্তেজনায় ইন্ধন দিয়েছে। সীমান্ত সম্প্রীতি কেবল মানচিত্রের ব্যাপারই নয়, এটি রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সুষ্ঠু কূটনীতির বিষয়ও। নেপাল ও ভারতের উচিত হবে উজবেকিস্তান-কিরজিগস্তান, ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়ার মতো দেশগুলোর বিরোধ যেভাবে মেটানো হয়েছে, সেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। উভয় ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুষ্ঠু পরিবর্তনের মাধ্যমে মীমাংসা হয়েছে।
নেপাল ও ভারতের বর্তমান নেতাদের পরিবর্তন করাটা অপরিহার্য নয়। তবে কূটনৈতিক সম্পর্কের ধরনটি বদলাতে হবে। এখানে ভারত বড় খেলোয়াড় হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার সদেচ্ছার মূল্য দেয়া উচিত। কারণ দেশটি অন্যতম পরামক্তি হতে চাচ্ছে। ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোতে দ্রুত তার বন্ধু হারাচ্ছে, সে এখন নেপালের সাথেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নষ্ট করার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। ভারত যদি নেপালের সাথে তার সম্পর্ক সুষ্ঠু রাখা অব্যাহত রাখতে চায়, তবে তাকে নেপালি ভূখণ্ড দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে হবে, ১৯৫০ সালের শান্তি ও মৈত্রী চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। ভারতের আশ্বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা উচিত হবে না নেপালের। বরং তার উচিত হবে বিষয়টির প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করা। নেপালের আরো উচিত হবে বিষয়টি নিয়ে ভারত ও চীনের সাথে আলোচনা করা, সম্প্রীতিপূর্ণভাবে বিরোধের অবসানের উদ্যোগ নেয়া।
বর্তমান পরিস্থিতি সীমান্ত বিরোধ স্থায়ীভাবে অবসান করা ও ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগানোর চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। নেপালের বর্তমান নেতৃত্ব যদি শক্তিশালী থাকে, সীমান্ত দখলদারিত্ব অবসান করতে পরিস্থিতিকে কূটনৈতিকভাবে সামাল দিতে পারে, তবে সে কেবল প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও দুই বৃহৎ দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সেতুবন্ধই রচনা করতে পারবে না, সেইসাথে তার নিজের নাগরিকদের (যাদের অনেকে এখন ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছে ) কাছ থেকেও প্রশংসা অর্জন করতে পারবে।
কাঠমান্ডু পোস্ট