আফগানিস্তান যদি আরএসএসের অখণ্ড ভারতের অংশ হয়, তবে শ্রীলঙ্কা নয় কেন?
আফগানিস্তান যদি আরএসএসের অখণ্ড ভারতের অংশ হয়, তবে শ্রীলঙ্কা নয় কেন? - ছবি : সংগৃহীত
জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন, রাজনৈতিক ভাষা এমনভাবে বলা হয়, যাতে মিথ্যাও মনে হবে সত্য বলে, খুনিদের শ্রদ্ধাভাজন করা হবে, বিশুদ্ধ বাতাসকেও কঠিন পদার্থ হিসেবে তুলে ধরা হবে। নরেন্দ্র মোদি যেভাবে তার বিপর্যয়কর নীতি গেলানোর কাজ করছেন, তাতে এই বর্ণনাই সবচেয়ে ভালো উদাহরণ।
আর নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল (সিএবি), ২০১৯-এর কথা বিশেষভাবে বলা যায়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটি সম্ভবত আইনে পরিণত হবে। প্রধানমন্ত্রী মোদির ভাষ্য মতে, মা ভারতীর অনেক সন্তান পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে নির্যাতনের মুখে রয়েছে।... যারা একবার ভারতের অংশ হলেও আমাদের থেকে আলাদা রয়েছে, আমরা তাদের পাশে দাঁড়াব।
দাবি করা হচ্ছে যে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলটি দেশভাগের সময়কার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবে। আসলে এটি দেশভাগের সময়কার ক্ষত আবার সামনে নিয়ে আসবে।
মা ভারতীর নিমজ্জিত সন্তান
দেশভাগ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল, কারণ স্বাধীনতার পর ভারত কেমন হবে তা নিয়ে দুটি ভিন্ন ভিশন সামনে এসেছিল। একটি ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব। এতে বলা হচ্ছিল যে হিন্দু ও মুসলিমরা আলাদা জাতি।
অপর ভিশনে ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তা নির্ধারণের বিরোধিতার কথা বলা হচ্ছে। এই মতে, দেশ হবে ভৌগোলিক বিষয়। এই ভিশন অনুযায়ী, পেশোয়ার থেকে পণ্ডিচেরি পর্যন্ত অখণ্ড ভূগোল ও ইতিহাসে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ। আমরা বৈচিত্র্যের মধ্যে একত্রিত।
এই পার্থক্যের কারণেই পাকিস্তান সৃষ্টির পথ সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান নিজেকে মুসলিম দেশ বিবেচনা করে। আর ভারত নিজেকে সেক্যুলার দেশ বিবেচনা করে। পাকিস্তানের মতো এই দেশের কোনো রাষ্ট্রীয় ধর্ম নেই।
আর ভারতের সব লোকই ‘মা ভারতীর’ সন্তান। তার ধর্ম যাই হোক না কেন, এতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এখন কিছু সন্তানকে তথা মুসলিমদেরকে আলাদা করতে চান।
আপনি যদি বর্তমান আফগানিস্তান, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি বা খ্রিস্টান হয়ে থাকেন, তবে আপনি শিগগিরই অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করবেন বা ভিসা নিয়ে প্রবেশ করলেও মেয়াদের পরও অবস্থান করবেন। আর এর ফলে মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই ভারতীয় নাগরিক হয়ে যাবেন। এই সুবিধা থেকে মুসলিমদের বাদ দেয়ার কারণ হলো, মুসলিমরা ওই তিন দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর মুসলিমরা মা ভারতীর সন্তান নয়।
কিন্তু পাকিস্তান যে আহমদিদের অমুসলিম বিবেচনা করে, এবং খ্রিস্টান ও হিন্দুদের চেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়, তাদের কী হবে? সংশোধনীতে তাদের রাখলে ভালোই হতো।
জিন্নাহকে গর্বিত করা
সিএবির সমর্থকেরা বলছে যে এই বিল ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করবে না। কারণ এতে শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টানদেরকেও স্বাগত জানানো হচ্ছে। কিন্তু আসলে এতে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের বাদ দেয়াছে। প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে, এসব দেশের মুসলিমরা কেন ‘মা ভারতীর’ সন্তান নয়?
বাস্তবে ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্বের এই নতুন আইডিয়ার ফলে ওই তিন দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক লোককে ভারতে অভিবাসন করতে উৎসাহিত করবে। আর তা আমাদেরকে দেশভাগের ক্ষতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। আর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বৃহত্তম ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু হওয়ায় সিএবি থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে হিন্দুরা। একইসাথে সর্বভারতীয় জাতীয় নাগরিক পুঞ্জির (এনআরসি) টার্গেট হলো মুসলিমেরা। তাদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিয়ে আটক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে। এটি হবে দ্বিজাতি তত্ত্বের চেয়েও খারাপ বিষয়। আর তা করা হবে ভারতের মাত্র একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তথা মুসলিমদের নির্যাতন করার জন্য।
হিন্দুরা আসবে, মুসলিমেরা বের হয়ে যাবে। সিএবি ও এনআরসিকে একসাথে বিবেচনা করলে এই বার্তাই পাওয়া যায়।
আসলে অরওয়েলের চালে সিএবি ও এনআরসি দ্বিজাতি তত্ত্বকেই গ্রহণ করার আরেক পথ। আর মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মদিনে কাজটি করার সর্বোত্তম সময়। নরেন্দ্র মোদির জন্য গর্বিত হবেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। মনে হচ্ছে, এখনো দেশভাগের বিষয়টি রয়ে গেছে।
অরওয়েলের চাল
ঘটনাক্রমে প্রস্তাবিত সিএবির নথিতে দেশভাগ, নির্যাতন নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। কেবল বলা হয়েছে মা ভারতী।
আর বলা হচ্ছে, ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে যেহেতু নাগরিকত্ব দেয়া হচ্ছে, তাই আগতদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা নির্যাতনের মুখে পড়েছে। এর ভিত্তিতেই জাতিসঙ্ঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক হাই কমিশনের সহায়তায় পাশ্চাত্যের দেশগুলো উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব মঞ্জুর করে থাকে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিএবি আইনে পরিণত হলে পাকিস্তানের ভান্দারা পরিবার (তারা পারসি) ভারতে এসে ভারতীয় নাগরিক হয়ে যাবে। তারা কি পাকিস্তানের ‘নির্যাতিত’? মোটেই না। তারা পাকিস্তানের উঁচু সমাজের লোক, মালি ব্রেওয়েরির মালিক। ওই পরিবারের কোনো সদস্য কি ভারতে একে মারি ব্রেওয়েরির কার্যক্রম ভারতে চালু করতে চাইবে না?
আসলে সিএবিতে থাকা পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের ‘নির্যাতিত’ ধর্মীয় সংখ্যালঘু আমাদের বোকা বানানোর হাতিয়ার। আসল কারণ হলো লাখ লাখ হিন্দুকে আমদানি করা, যাতে তারা বিজেপির ভোট ব্যাংক হিসেবে কাজ করতে পারে।
বামিয়ান থেকে বার্মা
প্রশ্ন সৃষ্টি হতে পারে, ভারতবর্ষ ভাগে সাথে আফগানিস্তানের সম্পর্ক কী? ১৯৪৭ সালে দেশটি ভারতবর্ষের অংশ ছিল না। দেশটি কখনো ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল না। আমরা সবসময় বলে আসছি, ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। আর পাকিস্তান থেকে হয়েছে বাংলাদেশ। তাহলে সিএবির মধ্যে আফগানিস্তান এলো কেন?
আর আফগানিস্তানকে বাছাই করা হলো, কিন্তু মিয়ানমারকে নয় কেন? ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার (ওই সময়ের বার্মা) ছিল ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের অংশ। মিয়ানমারের নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের কেন ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে না? জাতিগত ও ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য হয়েছে সাত লাভের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম। যদি হেরাতের আফগান-খ্রিস্টানেরা ‘মা ভারতীর’ সন্তান হতে পারে, তবে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমরা কেন ‘মা ভারতীর’ সন্তান নয়?
আর আফগানিস্তান যদি আরএসএসের অখণ্ড ভারতের অংশ হয়, তবে শ্রীলঙ্কা নয় কেন? এটা কি কেবল এই কারণে যে শ্রীলঙ্কার তামিল ভাষাভাষী হিন্দুরা তামিল নাড়ুর নির্বাচনে বিজেপিকে জয়ী করতে সহায়তা করবে না?
সিএবির সাথে আরেকটি ইস্যু রয়েছে। ভারত তো ইতোমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল একটি দেশে পরিণত হয়ে গেছে। এই দেশের কি আরো লোক দরকার? আর নিরাপত্তার ইস্যুটিই বা কী? সিএবির মাধ্যমে এজেন্সিগুলো আনায়াসেই ভারতে গুপ্তচর পাঠিয়ে তাদেরকে মাত্র ছয় বছরের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকে পরিণত করতে পারবে।
এর মানে এই নয় যে ভারতের কোনোভাবেই উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেয়া উচিত নয়। ভারতের যা প্রয়োজন তা হলো দেশটি কিভাবে প্রতি বছর কত লোককে নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করবে, তা নির্ধারণ করা। আর তাদের নাগরিকত্বের ভিত্তি ধর্ম বা কোন দেশের লোক তারা তা হওয়া উচিত নয়। ভারতীয় সংবিধানের চেতনা মাথায় রেখে তা হওয়া উচিত মানবতা।
দি প্রিন্ট