সুভাস বসুর আরেক অধ্যায়
সুভাস বসু - ছবি : সংগ্রহ
সুভাষচন্দ্র বসু। ব্রিটিশ-ভারতে অবিভক্ত বাংলার এক রাজনীতিবিদ, কংগ্রেস দলের দু’বারের সর্বভারতীয় সভাপতি। কিন্তু কলকাতার হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্তের যারা ঢবঢবে ইমোশনাল, এদের চোখে তিনি নেতাজী। প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে মধ্যবিত্তের সস্তা আবেগি নেতা হলেন সুভাষ বোস। এদেরই স্বীকার করে নেয়া সুভাষ বসুর খেতাবি নাম হলো ‘নেতাজী’।
তার রাজনৈতিক জীবনসীমা খুবই ছোট ১৯২১-১৯৪৫ সাল। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর ১৯২১ সালে ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতে না দিতেই সেই চাকরি ছেড়ে তিনি কংগ্রেসের রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। তার অপরপ্রান্তের এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো, তিনি এক ব্রিটিশ কলোনির বাসিন্দা হয়েও ব্রিটিশ-প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মানি ও জাপানের সামরিক সাহায্য নিয়ে ছোট হলেও যুদ্ধ করেছিলেন। সশস্ত্র যুদ্ধে ব্রিটিশদেরকে পরাজিত করতে জাপানি সহযোগিতায় জাপানে নিজস্ব এক সেনাবাহিনী (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আইএনএ) গড়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা-ব্রিটিশ ইত্যাদি মিত্রবাহিনীর কাছে জার্মানি, ইতালি ও জাপান অক্ষশক্তির জোটের পরাজয় ঘটেছিল। ফলে সুভাষের বাহিনীকেও ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশদের কাছে সারেন্ডার করতে হয়েছিল। কিন্তু এরপর দেশে ফিরতে যে সামরিক বিমানে তিনি উঠেছিলেন, এখান থেকেই তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। কেউ বলে মারা গেছেন, কিন্তু সেই লাশ কই কেউ জানে না। সুনিশ্চিতভাবে এরপর ঠিক কী হয়েছিল ব্যাপারটা রহস্য আবৃতই থেকে যায়। কিন্তু এ ঘটনাটাই আবেগি হিন্দু মধ্যবিত্তের আবেগ আরো সপ্তমে তুলে রেখেছে।
বয়সের হিসাবে নেহরু সুভাষের চেয়ে ৮-৯ বছরের বড়। তবে একসাথে কাজ করেছেন। যেমন- ১৯২৮ সালের কংগ্রেস দলের সম্মেলনে, গান্ধী আর মতিলাল নেহরু (জওয়াহেরলাল নেহরুর বাবা) এরা হেদায়েত করছিলেন ‘ব্রিটিশ ডমিনিয়ান রুল’ দাবি করে প্রস্তাব পাস করাতে। ডমিনিয়ান মানে হলো ভারতকে ব্রিটিশ শাসন কর্তৃত্বের অধীনেই রেখে কেবল নিজেদের জন্য এক সীমিত স্বায়ত্তশাসন চাওয়া। আর এ ক্ষেত্রে গান্ধীর বিপরীতে তারুণ্যের অবস্থান নিয়েছিলেন জওয়াহেরলাল নেহরু আর সুভাষ বোষ, তাদের দাবি ছিল ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’। সেকালে ‘পূর্ণ’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো ডমিনিয়ান শব্দটি নাকচ করতে। যদিও নেহরু আর সুভাষ কংগ্রেসের একই উপধারার রাজনীতির লোক ছিলেন না। এটা ছিল তাদের কমন সিনিয়রদের বিরুদ্ধে এক অবস্থান নেয়া।
সুভাষ বোস ছিলেন মূলত সব সময় রেডিক্যাল বা সশস্ত্রতার রাজনীতির পক্ষে। যদিও সুভাষ দল খুঁজে নিয়েছিলেন তার ওই কংগ্রেসই, তিনি আসলে তার গুরু চিত্তরঞ্জন দাশের (মৃত্যু হয় ১৯২৫ সালে) দলেই এসে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আবার রেডিক্যাল যদি তিনি হবেনই, তবে কংগ্রেস দলে যোগ দিয়েছিলেন কেন? এর কোনো সদুত্তর বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আবার তিনি কোনো কমিউনিস্ট-সোস্যালিস্ট রাজনীতিও করতেন না। ফলে এ কারণে তার চিন্তাকে রেডিক্যাল যদি বলি, তবে সে কথা টেকানোও মুশকিল।
তবে সশস্ত্রতা আছে তাও আবার ব্রিটিশদের শত্রু হিসেবে খোদ হিটলার, তারই সাথে সখ্য গড়ে, সামরিক সাহায্য নিয়ে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখা লোক হলেন সুভাষ। এমনকি এই নেতাজী সুভাষ আবার গান্ধী-নেহরুর কংগ্রেসের ১৯৩৭ সালের প্রথম (বাংলাসহ সাত প্রদেশে) প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি জার্মান-জাপানের সহযোগিতায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে এমনই বদ্ধধারণায় ডুবে মোহাচ্ছন্ন ছিলেন যে, ১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে পালিয়ে তিনি জর্মানিতে গিয়ে খোদ হিটলারের সাথে দেখা করেন।
কিন্তু হিটলার, এত দূর ব্রিটিশ-ভারত এসে জড়িয়ে যেতে অনাগ্রহী ছিলেন বলে তিনি না করে দিলে, সুভাষ সেখান থেকে জাপান চলে যান। হিটলারের যুদ্ধের বন্ধু জাপানের মার্শাল তেজোর সাথে দেখা করে সেখানে থেকেই নেতাজী সুভাষের সহায়তা পাওয়ার কপাল খুলে যায়। জাপানি সহায়তায় বাহিনী গড়ে নিয়ে সুভাষ একসময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে যান। তিনি ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া আর বার্মা সীমান্ত দিয়ে জাপানি বিমান হামলার ছত্রছায়ায় আক্রমণ করে দুটো ব্রিটিশ সীমান্ত চৌকি (ইম্ফল ও কোহিমা, দুটোই আজকের মনিপুর ও নাগাল্যান্ড ছোট দুই রাজ্যের রাজধানী) দখল করেছিলেন বলা হয়। এটাই তার সর্বসাকুল্যে কৃতিত্ব ধরা হয়।
এর আগে তিনি যে অনেক দিন ধরেই জার্মান-জাপানের শাসকদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন তা কংগ্রেসের অনেকেই জানত। তিনি কংগ্রেস দলে নিজ গ্রুপিং শক্তিশালী করে ১৯৩৮ সালে প্রথম কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমনকি পরের বছরও একই প্রভাবে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হয়ে গেছিলেন। কিন্তু গান্ধী পরে আলটিমেটাম দেন যে, সুভাষকে পদত্যাগ করতে হবে; না হলে কমিটির বাকি নির্বাহী সদস্যরাও পদত্যাগ করবে। এর মূল কারণ তত দিনে সুভাষের জার্মান-জাপানের সাথে যোগাযোগ-সম্পর্কটা খুবই পরিপক্ব হয়ে ওঠে, স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। তাই রাজনীতিতে সশস্ত্রতার পক্ষে হেদায়েত করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তাই সেটা ঠেকাতেই গান্ধীর আলটিমেটাম এসেছিল। তখনই তিনি নিজের গ্রুপকে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নাম দিয়ে আলাদা দল হিসেবে প্রকাশ করেন। ফরওয়ার্ড ব্লক নামে দলটা এখনো কলকাতায় আছে আর তা বামফ্রন্ট নামে কমিউনিস্টদের জোটের এক শরিক দল। মজার কথা হলো, এই ব্লক নিজেদেরকে এক কিসিমের কমিউনিস্ট দল দাবি করে। কিন্তু কোন সূত্রে তারা কমিউনিস্ট, এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সম্ভবত আবছা জোড়াতালির ভাষ্য হলো এ রকম যে, তারা সশস্ত্রভাবে ‘দেশ স্বাধীনের’ লোক। সুতরাং তারা ‘বিপ্লবী’ না হয়ে যায় না। আর বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট-সোস্যালিস্ট না হলেও অন্তত প্রগতিবাদী তো বটেই।
কিন্তু তাহলে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ মানে পূর্ববঙ্গের পশ্চিমের চেয়ে আলাদা প্রদেশ হয়ে যাওয়ায় হিন্দু-জমিদারদের এর বিরোধিতার ইস্যুতে অথবা খোদ জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদে পূর্ববঙ্গের দাবির প্রতি সুভাষ বসুর অবস্থান কী ছিল? এক কথায় ভিন্ন কিছুই না। একেবারেই আর পাঁচটা হিন্দু কংগ্রেসের নেতা, গান্ধী-নেহরুর মতোই সুভাষের অবস্থান। অর্থাৎ হিন্দু-জমিদারি স্বার্থের নেতাই তিনিও। মূলত এ কারণেই নেতাজী (সুভাষচন্দ্র বসু) কংগ্রেস দলে গান্ধী-নেহরুর বিরোধী ক্যাম্পের নেতা হলেও তিনি পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের রাজনীতিতে তখন বা এখন কেউ হতে পারেন নাই, নন।
যদিও আমরা দেখব, বাংলাদেশে খুঁজে পাবো কেউ কেউ সুভাষ বোসের ছবি বা মূর্তি সাজিয়ে রেখেছেন ড্রয়িংরুমের শোকেসে। যেমন বাংলাদেশে টাটা গাড়ির এজেন্ট কোম্পানির মালিক অথবা কোনো দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারে। সম্ভবত তাদের সাধারণ অবস্থান বোঝাবুঝি হলো- কংগ্রেস দল মানে তো প্রগতিশীলতা, কাজেই কংগ্রেস দলের কোনো নেতার চিহ্ন তো ধারণ করাই যায়। অথবা ওপরে বলা আগের ফর্মুলা যে সশস্ত্রতা মানেই বিপ্লবীপনা মানেই প্রগতিশীলতা। এ রকমই কিছু একটা।
সম্প্রতি মোদির এই জমানায় কিছু পুরনো বিতর্ক টেনে তোলা হয়েছে। মোদি বা বিজেপির ধারণা নেতাজী সুভাষ যেহেতু নেহরু-গান্ধীর কংগ্রেসের বিরোধী, কাজেই ‘নেতাজী’ আবেগে কৌশলগত সুড়সুড়িতে সমর্থন দিলে আখেরে লাভ আছে। তাই গত নির্বাচনে নেতাজীর এক ভাতিজার ছেলে চন্দ্রকুমার বসু বিজেপির প্রার্থী হিসেবে কলকাতা থেকে দাঁড়িয়েছিলেন, যদিও জিততে পারেননি।
একালে এসে হঠাৎ সেই চন্দ্রকুমার মোদির বিজেপিকে এক হুঁশিয়ারির কথা বলে বিপদে ফেলে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘মোদির দল যদি ঐক্যবদ্ধ ভারতের নেতাজীর সেকুলার মতাদর্শ অনুসরণ না করে, তবে দেশ টুকরা টুকরা হয়ে যাবে।’ কথাটা বিজেপির নেতাদের জন্য বিব্রতকর সন্দেহ নেই। কিন্তু তবু এটা কোনো অর্থপূর্ণ কথা তিনি বলেননি। কারণ, চন্দ্রবসু যদি এ কথাই আওড়াবেন তবে বিজেপির টিকিট নেয়ার তো তার কথা নয়। তিনি গেছিলেন কেন? আর বিজেপি যে তার এই নতুন রাজনীতির কেউ না, সেটি তো সবাই আগে থেকেই জানে। কাজেই এই তামাশা অর্থহীন। স্টান্টবাজি করা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
এ ছাড়া আবার চন্দ্রকুমারের উদ্ধৃত ও কথিত ‘নেতাজীর সেকুলার মতাদর্শ’- এটা কী জিনিস? চন্দ্রবসু নিজেই বলছেন যেহেতু, নেতাজীর সেনাবাহিনীতে হিন্দু-মুসলিম-শিখ ইত্যাদি সব ধর্মের লোক ছিল তাই এটাই নাকি ‘নেতাজীর সেকুলার মতাদর্শ’। একজন কথিত মুসলমান প্রেসিডেন্ট থাকলেই দেশ সেকুলার এসব বোকা-বুঝের রাজনীতি অনেক দিন ধরে চলে আসছে। এগুলো অর্থহীন, না বুঝে কথা বলা। রাষ্ট্র ইস্যুতে কোনো বোঝাবুঝি না রেখে বা অর্জন করে আন্দাজে কথা বলতে শুরু করা।
ভারতের স্বাধীনতা কোনো সশস্ত্র আন্দোলনের ফলাফলে অর্জন হয় নয়। আবেগি হিন্দু মধ্যবিত্ত মনে এ নিয়ে মেলা আপসোস আছে। এই ফাঁপা আবেগি জোশ মেটাতে ‘নেতাজী’ এক ভালো টোটকার নাম। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা যায়, নেতাজীর অবদান কী? এ ছাড়া আবার আরেক প্রশ্ন, অবদান মাপে কেমনে? যেমন বলা হলো, তিনি জাতীয়তাবাদী ছিলেন? এখন জাতীয়তাবাদী মানে কী? তিনি রাষ্ট্র বুঝতেন? তাহলে বলেন যে, আপনার নেতাজীর ভারত রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে অবদান কী? এবার কবিরা নীরব হয়ে যাবে। অনেকে বলতে চাইবেন তার মৃত্যুরহস্য? মানে তিনি বলতে চাইছেন, এখানে গোয়েন্দা গল্পের প্লট আছে। আছে হয়তো তাতে কী?
এতেও নেতাজীর অবদান কী তা দেখানো যায় না। আসেন তাহলে উল্টো জায়গায় তার হিটলারের সাথে দেখা করা বা জাপান যাওয়াকে মূল্যায়ন করি। প্রথমত, জার্মান-জাপান যেতে বের হয়ে পড়া; এটা তার অবসেশন ও এক আবেগ মাত্র। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল আসলে অধিকারভিত্তিক কলোনিমুক্ত রাষ্ট্র ও জাতিসঙ্ঘের নতুন ব্যবস্থার দুনিয়া কায়েম বনাম রেসিজম ও ফ্যাসিজমের কলোনি মালিকের দুনিয়া- এ দুয়ের লড়াই ছিল। যেখানে হিটলাররা দ্বিতীয় বা নেতিপক্ষ। এ দিকটা মূল্যায়নের ক্ষমতা হিন্দু মধ্যবিত্তের আবেগি-গর্বের কলকাতার নেই।
সবশেষে একটা পরিণতির কথা দেখিয়ে শেষ করব। ধরা যাক নেতাজী সুভাষ ও তার সেনাবাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জিতে গেছেন। তাহলে কেমন ভারত দেখতাম আমরা?
আগে বলেছি দুটো সীমান্ত চৌকি তারা দখল করতে পেরেছিলেন, ইম্ফল ও কোহিমা। কিন্তু এগুলো বার্মা-ভারত সীমান্তে কেন? আসলে আমরা কেমন নেতাজী দেখতাম- এর এককথার জবাব হলো, বার্মার এখনকার রোহিঙ্গা-মারা জেনারেলদের মতো এক নেতাজী সুভাষের জেনারেলদের ভারত- এটাই দেখতে পেতাম আমরা। বার্মা ব্রিটিশ কলোনি দখলে যায় ভারত দখলের যাওয়ার ৬৭ বছর পরে, ১৮২৪ সালে। যদিও ১৮৮৫ সালে তৃতীয় ব্রিটিশ-বার্মার যুদ্ধের পরে সেবার দখল হয়ে যাওয়া বার্মা একই ব্রিটিশ-ভারত শাসক প্রশাসনের অধীনেই একটা প্রদেশ (বার্মা প্রদেশ নামে) হিসেবে শাসিত হতে থাকে। এর ফলে বার্মার দিক থেকে ধীরে ধীরে যে সর্বব্যাপী মূল অসন্তোষ দেখা দেয় এর লিড নেয় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়; তা হলো এই বলে যে, ব্রিটিশরা ভারতীয় সহকারীদের দিয়ে বার্মা প্রশাসন চালাত, সাথে ব্যবসার বিষয়গুলোও ভারতীয়রাই বার্মা এসে দখল দিক, এটাই প্রেফার করে ফেলেছিল পুরনো অভ্যস্ততায়।
অর্থাৎ বার্মিজ মধ্যবিত্তের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ভারতীয়রা বার্মায় চাকরি-ব্যবসা করত। এই অসন্তোষ টের পেয়ে ব্রিটিশরা বার্মার জন্য আলাদা শাসক প্রশাসন কায়েক করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এরপর ১৮৩৭ সালে এসে বার্মা আর ভারতের প্রদেশ নয়, আলাদা ব্রিটিশ-বার্মা কলোনি হিসেবে শাসিত হতে থাকে।
কিন্তু তত দিনে বিক্ষুব্ধরা জাপানের তোজোর নাগাল পেয়ে গেছে। জাপান তিনজন বিপ্লবী তরুণকে আগে সরাসরি ট্রেনিং দিয়েছিল। পরে তাদের হাতে একটা বাহিনী গড়ে তুলেছিল। এদেরকে সামনে রেখে পেছনে জাপানি আর্মি মিলে এড়া ১৯৪২ সালে বার্মাকে ব্রিটিশ সৈন্যমুক্ত স্বাধীন করে ফেলেছিল। আজকের সু চির বাবা ওই ৩০ জনের একজন ও ১৯৪৪ সালে জাপান সমর্থিত বার্মা সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় আগেই তার মৃত্যু হয়েছিল। পরে আবার বার্মায় এদেরই বিরোধীদের ১৯৪৪ সালে ফ্যাসিবাদবিরোধী জোটে শামিল করে ব্রিটিশরা বার্মা দখল করে। পরে অবশ্য ওই ৩০ জনের বেশির ভাগই বার্মার (১৯৪৮ সালে) নতুন ক্ষমতায় আসীন হয়ে যায়।
তাহলে অসুবিধা কী? অসুবিধা বিরাট। ব্রিটিশরা কলোনি মাস্টার, জাপানের তেজোর সাম্রাজ্যও তাই। তফাত হলো, ব্রিটিশদের হাত দিয়ে রেনেসাঁও এসেছিল, রিপাবলিক রাষ্ট্র কী তা জানা গেছিল। আর জাপানের মার্শাল তেজোর হাত ধরে এসেছিল রেসিজম আর ফ্যাসিজম।
নির্মম রোহিঙ্গা খেদানো ক্লিনসিং রেসিজম ইত্যাদি- এগুলোই কি পুরনো জাপানি ট্রেনিংয়ের উসুল নয়! পরম্পরা, ধারাবাহিকতা নয়!
আজ জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা কী? মার্শাল তেজোর ফ্যাসিজম? না। আজ জাপানে পার্লামেন্ট, সিনেট নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা ইত্যাদি আছে। সাথে অবশ্য আছে জন্মগত হতাশ জাপানি নাগরিক। ওই যুদ্ধের পর থেকে তাদের কাছে জবাব নেই যে কেন তারা এমন দানব, কেন তারা চীন আর দুই কোরিয়া জুড়ে তাদের কলোনি বানিয়ে রেখেছিল, সেবাদাসী বানানো আর নির্মমতার কিছুই বাকি রাখেনি! এই লজ্জা থেকে লুকাতে, জবাবহীনতা থেকে আপাত মুক্তি পেতে আমেরিকান বিনিয়োগ নতুন উদ্যমে জাপানিজরা কাজপাগল সাজার সুযোগ নিয়েছিল।
আর জাপানি ট্রেনিংপ্রাপ্ত বার্মা? ওর কপালে সেই সুযোগ আর জোটেনি। সেই আপাত সংশোধনও জোটেনি। তাই বার্মা মানে আসলে পুরনো জাপান। কাজেই বিরাট নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তিনি বার্মিজ আজকের জেনারেলদের চেয়েও নিকৃষ্ট কেউ একজন হতেন! কাজেই কলকাতার হিন্দু মধ্যবিত্তের ভগবান নিশ্চয়ই আছেন, বোধ করি! নইলে কার আশীর্বাদে তারা- নেতাজী, এক বার্মিজ জেনারেলের মতো- এমনটি দেখার হাত থেকে বেঁচে গেলেন!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com