বাংলাদেশের মানুষ কি ভারতবিরোধী?
বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ - ছবি : সংগ্রহ
গত ৬ অক্টোবর নয়া দিগন্তে, ‘ভারত বাংলাদেশকে একটা বাজার বানিয়েছে’ শিরনামীয় সংবাদে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি সুলতানা কামালের প্রকাশিত বক্তব্যের মূল কথাটি ছিল, ‘স্বাধীনতার আগে সুযোগ-সুবিধা যেত পশ্চিম পাকিস্তানে আর শোষণ হতো পূর্ব পাকিস্তান, যত ক্ষতিকর প্রকল্প হতো পূর্ব পাকিস্তানে। তেমনিভাবে বাংলাদেশে যত ক্ষতিকর প্রকল্প হচ্ছে তা করছে ভারত। সেটা করতে যে পণ্য ব্যবহৃত হবে তাও হতে হবে ভারতীয়। এমনকি সব সুযোগ-সুবিধাও নিয়ে যাবে ভারত। এই জায়গায় মনে হয়, চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে।’
ইতিহাসের রূঢ় সত্যটি হলো, পাঠান, মোগল, ইংরেজের বিরুদ্ধে শোষণের অভিযোগ করেও আমরা কিছুই অর্জন করিনি। এরপর পাকিস্তান এবং সর্বশেষে এখন ভারতের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তুলছি। তাই প্রায় এই ৮০০ বছরের ধারাবাহিক শোষণের অভিযোগের ফলে যেন মনে হয় পাঞ্জাবের গুরুনানক বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন প্রফেসর ড. এস এস বিন্দ্রার মন্তব্যটি যথার্থ, ‘বাঙালিরা ভাবোদ্দীপক, আবেগপ্রবণ এবং আচরণে নেতিবাচক। তারা তাদের কৃত বোকামির ফলের জন্য সর্বদাই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপায়।’
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা ছিল আমাদের অনেকেরই কাম্য, যার ব্যতিক্রম মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামালও ছিলেন না। তাই আজ ভারতকে দেয়া বিনিময়ী সুযোগ-সুবিধার দায়ভার যখন তার ওপরেও বর্তায়, তখন আপত্তি কেন? এ প্রশ্নের কারণ, যুদ্ধ ঘোষণার আগেই বাংলাদেশে সেনা অগ্রসর করানোয় ভারতকে ‘আগ্রাসী’ বলে ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর লন্ডনস্থ ডেইলি মিরর পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ জন্য ওইদিনই ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘যদি কোনো দেশ আমাদেরকে আগ্রাসী বলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ভোলাতে চাপ মনে করে, তবে সে দেশ বোকার স্বর্গে বাস করছে।’ (Bangladesh documents, Vol-2, Page-224)। আমাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতের জাতীয় স্বার্থ কী ছিল? বাস্তব তথা অপ্রিয় সত্য হলো, রাজনীতির বিশ্ব ইতিহাসে কোনো যুগে কখনোই নিঃস্বার্থ হয়ে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় যুদ্ধ করার নজির নেই। এহেন ক্ষেত্রে হয় দখল, নয়তো ক্ষতিপূরণ।
১৯৭১ সালে ‘মিত্রবাহিনী’ হলেও আমাদের এ অংশে বস্তুত ভারতীয় বাহিনীর হাতেই পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পণ কার্যত পাকিস্তানের দেয়া অঘোষিত ক্ষতিপূরণ। এখানে আত্মসমর্পণ সাপেক্ষে পাকিস্তান সীমান্তে ভারতের একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা। এর পরে ক্ষতিপূরণের দাবি উত্থাপন না করেই যুদ্ধে দখলীয় প্রায় তিন হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার জায়গা ভারতের ছেড়ে দেয়াই এর প্রমাণ। তথ্য মতে, তখন কথা উঠেছিল, বাংলাদেশে ভারতকে সুরক্ষিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করার, যেমনি ১০৫০ সালে অভিযান চালিয়ে তিব্বতে চীন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু ইতিহাস, ভূগোল ও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত একক আধিপত্যবাদে ইন্দিরা গান্ধীর সেই জাতীয় স্বার্থ পূরণ হওয়ার সম্ভাব্য সুযোগের চেয়ে দখল অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বলে তখন তা করা হয়নি।
Larry Collins Dominique Lapierre-এর 'Mountbatten and the partition of India-এর 'They are now making friends with India. And the Little tribe up in the North will split up, if it was not for the Americans given the others enormous aid, they could not continue to exist. They are finished the day America with draws her aid. I don't see how they can survive. Even with an army, an air force they will be completely at the merey of India." (এখন তারা ভারতের সাথে বন্ধুত্ব করছে। সর্ব উত্তরে থাকা ক্ষুদ্র উপজাতি বিচ্ছিন্ন হবে। যদি আমেরিকার পক্ষে ব্যাপক সাহায্য দেয়া সম্ভব না হতো, তারা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারত না। যে মুহূর্তে আমেরিকা তার সাহায্য প্রত্যাহার করবে, সেই মুহূর্তে তারা শেষ হয়ে যাবে। আমি বুঝি না, তারা কী করে টিকবে। এমনকি সেনা ও বিমান বাহিনী নিয়েও তারা ভারতের সম্পূর্ণ দয়ার ওপরে থাকবে।)
১৯৪৬ সালে বাংলার স্বাধীনতা, ভাগ ও পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি প্রশ্নে বইটির ১৪৫ পৃষ্ঠায় তখনকার বাংলার গভর্নর লর্ড বারোজের (Lord Burrows) বক্তব্যটি ছিল, ""I have no doubt myself that Unity is necessary for Bengal; for if the province. is divided; eastern Bengal even with Sylhet will be an uneconomic entity which is bound gradually to fail, and cannot receive any help from the rest of Pakistan."
(বাংলার ঐক্যের প্রয়োজনীয়তায় আমার কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, যদি প্রদেশটি ভাগ করা হয়, তবে এমনকি সিলেটসহ পূর্ব বাংলা হবে একটা অন-অর্থনৈতিক অস্তিত্ব যা ক্রমে ক্রমে ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং অবশিষ্ট পাকিস্তান হতে কোনো সাহায্য পাবে না।)
১৯৪৭-এ ভারত ভাগের আগে পশ্চিম বাংলায় সব কাঁচামাল পাঠনোরই শুধু যোগ্যতা ছিল আমাদের। এখানে আদৌ কোনো পাটকল না থাকায় সব পাট যেত পশ্চিম বাংলার ৫৮টি পাটকলে। রফতানির জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও কলকাতা বন্দর ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থেকে যায়, যার অবসান ঘটানো হয় ১৯৫০ সালে চালনা (যার পরবর্তী নাম মংলা) বন্দর নির্মাণে। আমার তথ্যগত ভুল না হলে, পাকিস্তানি যুগে আমাদের এখানে ৭৭টি পাটকল, ৫৯টি টেক্সটাইল মিল, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল, ঘোড়াশাল ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি, ফেঞ্চুগঞ্জ ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি, চট্টগ্রাম স্টিল মিল, কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্প, রাজেন্দ্রপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি, চারটি বিশ্ববিদ্যালয়, তিনটি মেডিক্যাল কলেজ, চারটি ক্যাডেট কলেজ, কয়েকটি টেকনিক্যাল স্কুল বা কলেজ, কমলাপুর রেল স্টেশন, রামপুরা টিভি সেন্টার, সচিবালয়, হাইকোর্ট ভবন, সংসদ ভবন ইত্যাদির কোনোটি বা এখানে অনুল্লিখিত কোনো ক্ষতির প্রকল্প করে পাকিস্তানের নেয়া সুযোগ-সুবিধা হয়তো বা আমার অজানা। এটা স্বীকৃত সত্য, তখন পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনীতি ছিল অনেকটাই একে অন্যের পরিপূরক। ফলে ভারতের চেয়ে মুদ্রামান ছিল শক্তিশালী। পাকিস্তানি ১০০ রুপিতে ভারতকে দিতে হতো ১৪৫ রুপি। এখন আমাদের ১০০ টাকায় পাওয়া যায় ভারতীয় ৮৩.৩৬ রুপি মাত্র।
তথ্য আছে, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ আমেরিকার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার প্রদত্ত এক রিপোর্টে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের দুই অংশে চলমান অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেটা ভারতের অধিকারে পূরণ হওয়া সম্ভব হবে।’ তাই ভারতকে বাজার না দিলে আমাদের সম্ভাব্য সমস্যাও তো বিবেচনায় নেয়া উচিত। আমাদের স্বাধীনতার বয়স আজ ৪৮ বছর। তাই পাকিস্তান কোনো আলোচনার বিষয় নয়। তারা ১৯৫৮ সালেই কাশ্মিরের বিনিময়ে আমাদের ভারতকে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল।