চীনা পত্রিকার দৃষ্টিতে বাবরি মসজিদ রায়
চীনা পত্রিকার দৃষ্টিতে বাবরি মসজিদ রায় - ছবি : সংগৃহীত
শনিবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট উত্তর ভারতের অযোধ্যার একটি বিরোধপূর্ণ জমির মালিকানা হিন্দুদের দিয়ে সেখানে একটি মন্দির নির্মাণের রায় দিয়েছে।
এই স্থানটি মহাকাব্য রামায়ণে উল্লেখ করা দেবতা রামের জন্মভূমি বলে বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। অবশ্য ১৯৯২ সালের আগে এখানে মোগল সম্রাট বাবরের নামে একটি মসজিদ ছিল। ১৫২৮ সালে নির্মিত বাবরি মসজিদ এলাকার আশপাশে আরো কিছু হিন্দু ও মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান রয়েছে।
দুই পক্ষই কয়েক দশক ধরে স্থানটির মালিকানা নিয়ে তীব্র লড়াই করেছে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর তা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। ওই সময় হিন্দু অ্যাক্টিভিস্টদের একটি গ্রুপ ঐতিহাসিক মসজিদটি ভেঙে দেয়। এতে সারা ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়, নিহত হয় প্রায় দুই হাজার মানুষ। তারপর থেকে বহু ধর্মের দেশে এই ঘটনাটি সাম্প্রদায়িক ফ্ল্যাশ পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
যদিও অনেক মুসলিম বলছেন যে শনিবারের রায়ে ‘প্রমাণের বিরুদ্ধে বিশ্বাসের জয়’ হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় সমাজের সাধারণ প্রতিক্রিয়া ছিল তুলনামূলক শান্ত। সামাজিক মাধ্যমে পোস্টের মাধ্যমে পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগে উত্তর প্রদেশ পুলিশ ৭৭ জনকে গ্রেফতার করেছে।
দীর্ঘ মেয়াদে বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত সৃষ্টি না করলেও রায়টি ভারতে প্রভাব সৃষ্টি করবে, ভারতের স্থিতিশীলতার জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিরাজ করবে।
অবশ্য এটি হয়তো দুই ধর্মের মধ্যকার বিরোধ পুরোপুরি দূর করবে না।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের ইতিহাস ধর্মীয় সঙ্ঘাতে বর্ণিল। আর তা দেশটির অগ্রগতির পথে বাধায় পরিণত হয়েছে। ভারতের উপর্যুপরি সরকারগুলো কেন জাতীয় আধুনিকায়নের লক্ষ্য পূরণ করতে পারেননি, এটি তার অন্যতম কারণ।
অভিন্ন জাতীয় পরিচিতি-সংবলিত সম্প্রীতিপূর্ণ সমাজ ছাড়া সরকারের পক্ষে নির্বাহী শক্তি প্রয়োগ করা কঠিন।
ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি ব্রিটিশ উপনিবেশিকদের ফেলে যাওয়া ব্যবস্থা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সাত দশকের শাসনে দেখা যাচ্ছে যে এই ব্যবস্থা ভারতের সব জাতিগত গ্রুপ ও ধর্মের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পরিচিতি নির্মাণ করতে পারে না।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকৈ তিনি লোকজনকে আকৃষ্ট করতে, সমর্থন লাভ করতে, পরিচিতির অনুভূতি গভীর করতে ও কর্তৃত্ব বাড়াতে হিন্দুধর্মের ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছে। এই প্রয়োগে ভারতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে, যা ধর্মগুলোর মধ্যে আরো বিভাজন সৃষ্টি করেছে।
আদালতের রায় মোদির সমর্থন সংহত করতে সহায়ক হবে। এর ফলে হিন্দুবাদের জয়ের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হবে। আর এতে করে অন্যান্য ধর্মের বিশেষ করে ইসলামে বিশ্বাসীরা অরক্ষিত অনুভব করবে।
এটি অতি সহজেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের স্পর্শকাতর ইস্যুটির কথা মনে করিয়ে দেবে।
এখন ভারত সরকারের উচিত হবে অন্ধভাবে হিন্দু পরিচিতি জোরদার করার বদলে বিদ্যমান আইন কাঠামোর আলোকে আরো কিছু নীতি প্রনয়ণেরমাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সহাবস্থান নিশ্চিত করা।
ভারত সমীক্ষাকারী বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে ভারত সবচেয়ে বড় যে সমস্যার মুখোমুখি হয়ে আছে তা হলো এর অর্থনীতি। ভারতের অর্থনীতি হাঁটা অবস্থা থেকে দৌড়াতে পারছে না, বরং চলতি বছর মন্থর হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুন কোয়ার্টারে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে মন্থর ছিল এই অর্থনীতি।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভোটার ভিত্তি সংহত করার জন্য হিন্দুবাদের দিকে বেশি নজর না দিয়ে মোদির নীতি হওয়া উচিত অর্থনীতিকেন্দ্রিক। অবশ্য, দীর্ঘ দিন ধরে জাতিগত ও ধর্মীয় সঙ্ঘাতের ইতিহাস থাকা একটি দেশের জন্য বেশি প্রয়োজন সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ বাড়াতে পারে এমন সব সমস্যার সমাধান করা।
এখনকার প্রশ্ন হলো, ভারত কি বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতির দরজা খুলতে পারবে, হিন্দু পরিচিতির জোরদার করার মাধ্যমে এর উন্নয়নের জন্য আরো স্থিতিশীল সামাজিক ভিত্তি সৃষ্টি করতে পারবে? মোদির সমস্যা হলো, দরজা খোলার জন্য সঠিক চাবিটি না থাকা।
গ্লোবাল টাইমস