একেই বলে বন্ধুত্ব
পেঁয়াজ - ছবি : সংগৃহীত
২ অক্টোবর ২০১৯ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়েছিল, দুই দেশ ভারত-বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে তিস্তাসহ ৫২টি অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু মানুষ হতাশ হলো- প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে তিস্তা, রোহিঙ্গা ইস্যু, এনআরসি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে। সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তেমন কোনো অগ্রগতি না হলেও আপ্যায়ন এবং ঠাকুর শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রশ্ন হচ্ছে, জাতি কী পেল? উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সফরে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফেনী নদীর পানি চান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিস্তার পানি এলে ভারত ফেনী নদীর পানি পাবে। ৩ অক্টোবর ২০১৯ ভারত সফরে গিয়ে ঐতিহাসিক হায়দরাবাদ হাউজে ৫ অক্টোবর ২০১৯ বৈঠকে যে সই হয়, সেখানে তিস্তার পানি প্রাপ্যতার কথা উল্লেখ নেই। ত্রিপুরায় সাব্রুম শহরে পানি সরবরাহ প্রকল্পে ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার বিষয়ে বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং ভারতের জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ১৯৭২ থেকে এ পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশ থেকে যতটা সুবিধা নিয়েছে- তার চেয়ে কম সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ ভারত থেকে। ৯০ শতাংশ সুবিধা ভারত পেয়েছে আর বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ সুবিধা ভারত থেকে। ৭ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকে লিড নিউজ ছিল- সমাধান হয়ে যাচ্ছে ভারতের ইস্যুগুলো আর পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার। বাংলাদেশ ন্যায্য প্রাপ্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি না, কিছুই না পেয়ে শুধু দিয়ে যাওয়াকে কি বন্ধুত্ব বলে। বিবিসি নিউজ বলেছে- ভারতকে এবারো বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ... অন্য দিকে তিস্তা চুক্তি অধরা রয়ে গেল শেখ হাসিনার এবারের সফরেও। প্রশ্ন থেকে যায়, শেখ হাসিনার দিল্লি সফর থেকে বাংলাদেশ আসলে কী পেল?
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বিবাদগুলো- ১. ফারাক্কা বাঁধ; ২. তিন বিঘা করিডোর; ৩. শিলিগুড়ি করিডোর; ৪. অর্থনৈতিক ট্রানজিটবিষয়ক বিরোধ; ৫. বাংলাদেশ এবং ভারতের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো ভারতীয় সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা- বিগত এক দশকে এক হাজার ২০০ মানুষ নিহত হয়েছে, এরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক; (৬) ভারতের সাথে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের মালিকানা-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের আগে দুই দেশই একই এলাকা নিজেদের বলে দাবি করেছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুুল মোমেন বলেছেন, ‘ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘স্বামী-স্ত্রী’র মতো (তথ্যসূত্র বাংলাদেশ টুডে, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ঠিক থাকলে ছোটখাটো সমস্যা বড় হয়ে ওঠে না।
মিটমাট হয়। বাংলাদেশে ভারতের মধ্যে আসা-যাওয়া বাড়লেও বাংলাদেশের একটি অংশের মধ্যে প্রবল ভারতবিরোধী মনোভাব রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়া এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে ভারতের চাপ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে নানা সমালোচনা রয়েছে। একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে, বাংলাদেশের ২০১৪ সাল এবং ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচনে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির মনে করেন, দুই দেশের সরকারের মধ্যে ভালো সম্পর্কের পাশাপাশি জনগণ সেটিকে কিভাবে মূল্যায়ন করছে, সেটিও বিবেচনা করতে হবে। হুমায়ুন কবির মনে করেন- বাংলাদেশের বিগত সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারত যে ভূমিকা নিয়েছিল, সেটি বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। তিনি আরো বলেন, কোনো স্বাধীন দেশের মানুষই তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য একটি দেশের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। দু’টি স্তরে সম্পর্ক তৈরি হয়। একটি হচ্ছে, সরকার ও সরকার এবং অপরটি হচ্ছে জনগণ ও জনগণের মধ্যে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মো: জমির বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ভেতরে অনেকেই মনে করেন, গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থকে যতটা প্রাধান্য দিয়েছে, বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে ততটা মূল্যায়ন করেনি এবং এ বিষয়টি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখা দরকার।’ (সূত্র বিবিসি বাংলা ঢাকা, ২৫ মে ২০১৮)।
চার দিনের সফর শেষে ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রাতে ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সফরে সাতটি চুক্তি ও তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে দুই দেশের মধ্যে, সেগুলোতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি দেখছেন না আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন ডয়চেভেলেকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। উল্টো ফেনী নদীর পানি তুলবে ভারত, সেটা যতটুকুই হোক। এগুলো দেশের মানুষ ভালোভাবে নেয় না। ফলে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। তিনি আরো বলেন, যে চুক্তিগুলো হয়েছে সেগুলো ভালো। কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, আমাদের যেগুলো জীবন-মরণ সমস্যা, সেগুলো যদি না পাই তাহলে তো প্রশ্ন উঠবেই। তিস্তা নিয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে শক্তভাবে পাশে দরকার ভারতকে। সেটাও হয়নি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হলো, এবার ভারতকে আমাদের সমুদ্রতটে নজরদারি করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এনআরসি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশ্বস্ত করলেও তার মন্ত্রীরা প্রতিনিয়তই হুমকি দিচ্ছেন। এগুলোর সুরাহা হওয়া দরকার।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চেভেলেকে বলেছেন, আমরা আসলে দেখছি ভারত বাংলাদেশের জনগণের সাথে নয়, সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে আগ্রহী। কারণ তারা বাংলাদেশের জনগণের কোনো সুবিধার কথা চিন্তা করছে না। ফলে দেশে জনগণ ও সরকার যদি বিগড়ে যায় তাহলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সৃষ্টি হবে, যা ভারত-বাংলাদেশ কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। তা ছাড়া একতরফা কোনো সফলতাকে সফলতা বলা যায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে তিনটি ইস্যু জনগণের মুখে মুখে শোনা যায়।
এগুলো হলো- ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করায় বাংলাদেশের খুচরাবাজারে পেঁয়াজের মূল্য ২৩০ টাকা ছাড়িয়েছে। অন্য দিকে বিশেষ আদেশে পূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রফতানি হচ্ছে আর ফারাক্কার সবগুলো গেট খুলে দেয়ায় আকস্মিক বন্যার শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক অঙ্গনেও ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। সবাই এক কথা বলেছেন- তিস্তার পানির ওপর বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি বরাবরের মতো ঝুলিয়ে রেখে ভারতকে ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের চুক্তি করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। বাংলাদেশ সরকারের এই একতরফা প্রেম কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। শীর্ষ বৈঠক থেকে সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধে সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য পণ্যের জন্য ভারতের বাজার উন্মুক্ত ও শুল্ক সুবিধা দেয়ার বিষয়েও চুক্তি বা সমঝোতায় না এসে বাংলাদেশের বন্দরগুলো ভারতের পণ্য পরিবহনের জন্য অবারিত করে দেয়া হয়েছে। চড়া মূল্যে বন্ধুত্ব রক্ষা জাতি কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন- বাংলাদেশকে ভারত তাদের ডাম্পিং ভাগাড়ে পরিণত করেছে। বাংলাদেশে যত ক্ষতিকর প্রকল্প তা যৌথভাবে করছে ভারত। প্রকল্পে যে পণ্য ব্যবহার হবে তাও দেবে ভারত। এর সুযোগ-সুবিধাও তারা নেবে। বন্ধুত্বের নামে বাংলাদেশের পরিবেশ নিয়ে ভারত ডাবল স্ট্যান্ডার্ড রূপ ধারণ করেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আচরণ। আমি ভারতবিরোধী কোনো কথা বলছি না। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত যদি আমাদের পাশে না দাঁড়াত, তাহলে আমরা মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে শেষ করতে পেরেছি, সেভাবে হয়তো শেষ করতে পারতাম না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেটা স্মরণ করি। কিন্তু আজকে বাংলাদেশকে একটা বাজারে কিংবা তাদের শিল্পকারখানার জায়গা বানিয়ে নিজেরা সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে যাবে, এ বিষয় আমাদের এখন চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। গত ৫ অক্টোবর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ইউনেস্কোর ৪৩তম সভার সব সুপারিশ বাস্তবায়ন, স্ন্দুরবনের পাশে রামপালসহ সব শিল্প নির্মাণ প্রক্রিয়া বন্ধ ও সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা সম্পন্ন শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, গ্রন্থকার
E-mail : harunrashidar@gmail.com