কেমন আছে ফরাসি মুসলিমরা?
কেমন আছে ফরাসি মুসলিমরা? - ছবি : সংগ্রহ
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বাস। পিউ রিসার্চের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ দশমিক ৮ শতাংশ মুসলমান। সংখ্যার হিসাবে তা প্রায় ৫৭ লাখ ২০ হাজার জন। ‘ইফপ’ নামের এক সংস্থার জরিপ বলছে, ফ্রান্সের ৪০ শতাংশের বেশি মুসলমান ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
গত রোববার ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এক সমাবেশ হয়। এতে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার মানুষ অংশ নেন। কয়েকটি বামপন্থী সংগঠন ও গণমাধ্যমের উদ্যোগে সমাবেশটির আয়োজন করা হয়। ‘অকারেন্স’ নামের একটি সংগঠন বলছে, এতে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা নির্ধারণ করতে এএফপিসহ কয়েকটি গণমাধ্যম অকারেন্সকে দায়িত্ব দিয়েছিল।
একটি গাড়ি কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করা ২৯ বছর বয়সী নারী আসমা ইউমোসিদ নেকাব পরে সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘ইসলাম ও পর্দা করা নারীদের সম্পর্কে ইদানীং অনেক বাজে কথা শোনা যায়।’
নাদজেত ফেলা নামের এক নার্স বলছেন, তিনি আলজেরিয়ায় নেকাব পরার চাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন। রোববারের সমাবেশেও তিনি ছিলেন। ফেলা বলেন, ‘আমি নেকাব না পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিন্তু যারা এটা পরেন তাদের আলাদা করে দেখার বিষয়টি আমাকে আহত করে।’
প্যারিসের পাশাপাশি মার্সেই শহরেও বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে কয়েক শ’ মানুষ অংশ নেন।
সরকার ও ডানপন্থী দলগুলো রোববারের সমাবেশের সমালোচনা করেছে। ‘কালেক্টিভ অ্যাগেইনস্ট ইসলামোফোবিয়া ইন ফ্রান্স’ নামের সংগঠনটির সাথে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সম্পর্ক রয়েছে বলে তাদের অভিযোগ। মুসলিম ব্রাদারহুডকে তারা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে।
লিঙ্গসমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মারলেন শিয়াপা বলেছেন, রোববারের সমাবেশ ‘বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ার বেশে’ আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ফ্রান্সে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে যেকোনো ধর্মকে সমালোচনা করার অধিকারকেও বোঝায়।
প্রতিমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পাল্টা যুক্তি হিসেবে সমাবেশে অংশ নেয়া কয়েকজন ‘ধর্মের সমালোচনার প্রতি হ্যাঁ, তবে এর বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিরুদ্ধে না’ শীর্ষক প্ল্যাকার্ড নিয়ে এসেছিলেন। মারলেন শিয়াপা ছাড়াও ইকোলজি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এলিজাবেথ বোর্ন সমাবেশের সমালোচনা করে বলেছেন, এটি একজন মানুষকে আরেকজনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইমানুয়েল মাক্রোঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চরম ডানপন্থী দলের নেতা মারি ল্য পেন রোববারের সমাবেশের সমালোচনা করেছেন। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘ফ্রান্সে ইসলামবিদ্বেষের চেয়ে উগ্রবাদ অনেক বেশি মুসলমানকে হত্যা করেছে। আপনারা যে কি করম ভুয়া, এই তথ্য তার প্রমাণ।’
কেন বাড়ছে এই ইসলামবিদ্বেষ
ডানপন্থী আন্দোলনের প্রভাব বৃদ্ধির ফলেই পুরো ইউরোপজুড়ে ইসলামোফোবিয়া বাড়ছে। আঙ্কারাভিত্তিক একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্কের প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। ফাউন্ডেশন ফর পলিটিক্যাল, ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল রিসার্চ (এসইটিএ) কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইউরোপীয় ইসলামোফোবিয়া : রিপোর্ট ২০১৮’ ইউরোপে মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদের উত্থানকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করে, এমন কিছু কারণের ওপর আলোকপাত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার, বহুসংস্কৃতিবাদ এবং ইউরোপের রাষ্ট্রীয় আইনের ক্ষেত্রে সবসময় মুসলিমবিরোধী আলোচনা করার কারণেই বৃদ্ধি পেয়েছে ইসলামফোবিয়া এবং মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদ। মুসলিম-বিরোধী এই বর্ণবাদের প্রজনন ও প্রতিপালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ইউরোপের গণমাধ্যম। ইউরোপের এমন খুব কম গণমাধ্যম আছে, যারা মুসলিমদের ইতিবাচক দিকগুলো পুটিয়ে তোলে। বরং নেতিবাচকভাবেই মুসলিমদের তুলে ধরে সবসময়। আর ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে ক্রমাগত মুসলিমবিদ্বেষ তো আছেই।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মুসলমানদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের ইসলামোফোবিক ভাষা এবং ডানপন্থীদের বর্ণবাদী ভাষা ইসলামোফোবিয়াকে আরো বাড়িয়ে তুলছে এবং বিশ্বকে সন্ত্রস্ত করছে। এখন ইসলামোফোবিয়া কেবল মুসলমানদের নয়, ইউরোপের সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও নির্বাচনী উদ্দেশ্যে তারা এই বর্ণবাদ ও ইসলামোফোবিয়াকেই উসকে দেয়।