কী হতে যাচ্ছে সৌদি আরবে?
প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান - ছবি : সংগ্রহ
সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব দেয়া এক দেশ। ধর্মীয় গুরুত্ব থাকায় মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো মুসলিম বিশ্বই অলিখিতভাবে মেনে নেয় এ নেতৃত্ব। কিন্তু কয়েক বছর ধরে, আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে সৌদি যুবরাজ হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) অধিষ্ঠানের পর থেকেই খুব দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করে সামগ্রিক পরিস্থিতি। অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামাজিক দিকসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই দ্রুত এত ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করে যে, শুধু সৌদি আরব নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বেরই তা মেনে নেয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে।
সার্বিক সংস্কার করতে গিয়ে এমবিএস এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা চেনা সৌদি আরবের সাথে একেবারেই বেমানান। নারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া থেকে শুরু করে নারীদের রেসলিং পর্যন্ত চালু করার বিষয়টি রক্ষণশীল সৌদি সমাজের অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। এজাতীয় উদারবাদী সংস্কার দেশটির কিছু অংশের সমর্থন পেলেও অধিকাংশই এতে নাখোশ।
অন্য দিকে রাজনৈতিক সংস্কার বা পদক্ষেপ হিসেবে সৌদিকে নেতৃত্বের আসনে বসাতে গিয়ে অনেকটাই ব্যাকফুটে পড়ে গেছে রিয়াদ। ইরানের সাথে কূটনৈতিক টানাপড়েন, কাতার অবরোধ, ইয়েমেনে হামলা ইত্যাদি বিষয় অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাকফায়ার করেছে।
আবার যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মাখামাখির বিষয়টিও অনেকের দৃষ্টিতে সৌদি আরবের অবস্থানকে আরো খাটো করে দিয়েছে। সেই সাথে বিভিন্ন দেশ থেকে বিশাল বাজেটের সমরাস্ত্র কেনা দেশটির অর্থনীতিকে ফেলে দিয়েছে আরো চাপে। আর সব কিছুকেই ছাপিয়ে দেশটিকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ফেলে দিয়েছে সৌদি রাজতন্ত্রের কড়া সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার ব্যাপারটি। এ ঘটনার পর প্রায় একঘরে হয়ে পড়েছিল আরব এ দেশটি। নাইন-ইলেভেনের সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পর দেশটি আর এত বড় সঙ্কটের মুখে পড়েনি।
যা হোক, এ বিষয়গুলোর সরাসরি প্রভাব পড়েছিল সৌদি আরবের নিজস্ব আয়োজন বিনিয়োগ সম্মেলন ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভে (এফআইআই)। গত বছর দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত এ সম্মেলন বর্জন করেছিলেন অনেকেই। এমবিএস জামাল খাশোগির হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত- ট্রাম্পের বিরোধিতা সত্ত্বেও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র দ্ব্যর্থহীন এ ঘোষণায় অনেকেই এড়িয়ে গিয়েছিলেন সে সম্মেলন। তবে এ বছর আবারো সৌদি আয়োজিত সে সম্মেলনে ইতিবাচক দিকের সন্ধান পেয়েছে এমবিএসের টিম। গত বছরের ইস্যু ভুলে ২৯-৩১ অক্টোবরের এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন একঝাঁক মার্কিন কর্মকর্তা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। যেন তারা ঘোষণা দিচ্ছেন, সৌদি এখন বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত ও নিরাপদ। মার্কিন প্রতিনিধিসহ এ সম্মেলনে ছয় হাজার অতিথি যোগ দিয়েছিলেন। গত বছর না এসে এ বছর যুক্ত হওয়ার কারণ হিসেবে তারা মনে করছেন, খাশোগি ইস্যুতে সৌদি আরব একটি ভালো শিক্ষা পেয়েছে। দেশটির শাস্তি হিসেবে এতটুকুই যথেষ্ট। এ সম্মেলনে তিন হাজার ২০০ কোটি ডলার সৌদিতে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ব্যবসা সহজীকরণ সূচকেও এক লাফে অনেক উন্নতি করেছে রিয়াদ। এক লাফে ৬২তম স্থান থেকে উঠে এসেছে ৩০তম স্থানে। দেশটিতে বেকারত্বের হার কমেছে। তেল ছাড়া অন্য খাতেও দেশটির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য দেশটিতে টুরিস্ট ভিসা সহজ করা হয়েছে। এত কিছুর পরও দেশটির অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক কিন্তু পড়তির দিকে। এমনকি এতটা উন্নয়নের পরও অর্থনীতির অবস্থা এক যুগ আগের চেয়ে খারাপ অবস্থানে।
তবে অক্টোবরের বিনিয়োগ সম্মেলনে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তারা তেল উত্তোলন ২০২০ নাগাদ ৩ শতাংশ কমিয়ে দেবে এবং তেল দ্বারা অন্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে। তবে তেলপ্রধান দেশের তেলপ্রধান অর্থনীতিতে তেলবিহীন খাত বলতে আসলে কী বোঝানো হয় তা বলা কঠিন। সম্প্রতি জানা গেছে, সৌদি আরবে বর্তমান তেলের রিজার্ভ রয়েছে ২৬৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ব্যারেল। তবে দিনদিন এর পরিমাণ কমতে থাকায় এবং তেলের বাজারে মাঝে মধ্যেই মারাত্মক মন্দা দেখা দেয়ায় তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বের হতে চাচ্ছে সৌদি। এ কারণে ভিশন-২০৩০ নামের একটি লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করেছে দেশটি। তাদের প্রত্যাশা, এই সময়ের মধ্যে শুধু তেলের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসবে সৌদি আরব।
রিয়াদ দাবি করছে, সংস্কার ও উন্নয়ন অভিযাত্রায় বিশ্বের অধিক প্রগতিশীল দেশ হিসেবে বিশ্বে সৌদি আরবের অবস্থান এখন প্রথম সারিতে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ‘ইজি অব ডুয়িং বিজনেস ২০২০’ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তারা এ দাবি করে। রিয়াদের আরো দাবি, ভিশন ২০৩০ এর লক্ষ্য অর্জনে তারা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কৌশল হাতে নিয়েছে। রিয়াদে তারা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্র উদ্বোধন করেছে। রিয়াদভিত্তিক ওই কেন্দ্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, ডাটা পলিসি, ইন্টারনেট সামগ্রী, আধুনিক নগরী ও রোবোটিকের মতো আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে।
বর্তমানে সৌদি আরব বিদেশী শ্রমিকনির্ভরতা কমাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কারণ, তাদেরকে এমন সব পেশায় এখন দেখা যাচ্ছে, যা আগে কখনো কল্পনাও করা যায়নি। তারপরও বর্তমানে দেশটিতে বেকারত্বের হার ১২ শতাংশের ওপর। তবে দেশটির এ পদক্ষেপে দেশটিতে বিদেশী বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ, বিদেশী শ্রমিকনির্ভরতা কমাতে দেশটিতে আগত বিদেশী শ্রমিকদের ওপর উচ্চহারে করারোপ করা হয়েছে। সে কর পরিশোধ করা যেমন কষ্টসাধ্য হবে, তেমনি তাদের জায়গায় স্থানীয় কর্মীদের কাজে লাগানোও ব্যয়বহুল ও ঝামেলাপূর্ণ। কারণ, সৌদি শ্রমিকদের পারিশ্রমিক যেমন বেশি, তেমনি অনেক ক্ষেত্রেই তারা অনভিজ্ঞ। ফলে তাদের নিয়ে কাজ করে লাভ তুলে নেয়া বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজসাধ্য ব্যাপার হবে না।
এ ছাড়া দেশটির সাম্প্রতিক কৌশল অনুসারে পর্যটনকে সৌদি আরবের মোট দেশজ উৎপাদনের ৩ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এক বছরে দর্শনার্থীর সংখ্যা ১৮ মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১০০ কোটিতে উন্নীত করার লক্ষ্য নেয়া হয়েছে। এর ফলে নতুন ১৫ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
সব মিলিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমান দেশের পুরোটা জুড়ে যে সংস্কার বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করতে চাইছেন, তা শেষ পর্যন্ত কতটা কার্যকর হবে তা দেখার জন্য আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। দেশটিতে যেহেতু শাসকদের কোনো মেয়াদের সীমারেখা নেই, সেজন্য পূর্ণ ফলাফল জানতে ২০৩০ সাল পর্যন্তও অপেক্ষা করা লাগতে পারে।