বাবরি মসজিদ রায়ে যে ক্ষতি হলো মুসলিমদের

জয়নাব সিকান্দার | Nov 11, 2019 08:27 pm
বাবরি মসজিদ

বাবরি মসজিদ - ছবি : সংগৃহীত

 

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অবশেষে অযোধ্যা শীর্ষক বিরোধের রায় দিয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করলেও কোনো দাঙ্গা সৃষ্টি হয়নি, সান্ত্বনা হিসেবে মুসলিমদেরকে অন্য কোথাও ৫ একর জমি দিতে বলা হয়েছে।

হিন্দু দাঙ্গাবাজদের ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর যে ‘রক্তের বিবাদ’ ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণার সৃষ্টি হয়, ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়কে এখনো ওই ঝাঁকুনি সহ্য করতে হচ্ছে। অদ্ভূত বিষয় হলো, ভূমিটি রাম লালাকে দিয়ে দেয়া হলেও শান্তি রক্ষার দায়িত্ব বর্তেজে ১৯৯২ সালের দাঙ্গার ক্ষত বহনকারী মুসলিমদের ওপরই। সাত শতাধিক মুসলিম নিহত হয়েছে।

তাহলে মুসলিমরা কোথায় যাবে? বাস্তবতা হলো, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরও দাঙ্গার জন্য কাউকেই বলা যায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। তবে ১৯৯৩ সালের মুম্বাই বোমা বিস্ফোরণের জন্য ১০০ জনকে (তাদের বেশির ভাগই মুসলিম) দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

আর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ফলে ভারতে মুসলিমদের জীবন যাপন ও অনুভূতি কিভাবে বদলে গেছে, সেই বিচার করার কোনো ব্যবস্থা নেই।

মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে মসজিদ ধ্বংস এবং এখন অযোধ্যা মামলার রায় প্রদান করার মাধ্যমে ভারতে মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত হয়ে গেছে। আর আধুনিক ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাবাবেগ ও নিরাপত্তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু ‘আস্থা’।
বাবরির পর
বাবরি ধ্বংসের পর ভারতের গতিপথই বদলে গেছে।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর কিভাবে অনেক মুসলিম বাইরে বের হলে ‘হিন্দু’ নাম গ্রহণ করত, দাড়ি কেটে ফেলত, মাথায় টুপি পরা বাদ দিয়েছিল, তা নিয়ে অনেক গল্প আমি শুনেছি। হিন্দু-মুসলিম মিশ্র এলাকাগুরো ধর্ম-নির্দিষ্ট গেটৌতে পরিণত হয়েছিল। আর এখনো প্রতিদিনকার কথাবার্তায় ‘মুসলিম হানাদার’ নিয়ে তর্ক শোনা যায়।
আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি আমাদের অনেকের কাছে দেশ ভাগের ভূতকে ফিরিয়ে এনেছিল। ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে আধুনিক ভঅরত একে করব দেয়নি, বরং মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনকার গোঁড়ামিতে তা প্রকটভাবে ফুটে ওঠে, ছাদ থেকে চিৎকার করে ওঠে, রাজনৈতিক টোপ হিসেবে একে ব্যবহার করা হয়। ভারত জিনটিকে আর কখনো ফের বোতলে ভরতে পারেনি।

বড় ভাইসুলভ সিনড্রোম
বর্তমানে মুসলিমরা অযোধ্যা রায় নিয়ে কথা বলার সময় অনেকেই জোর দিয়ে বলে যে রায় মন্দির বা মসজিদের পক্ষে গেল কিনা তা অপ্রাসঙ্গিক। বরং বাস্তবতা হলো, খোদ সুপ্রিম কোর্টই রায় দিয়েছে যে মসজিদটি ভাঙ্গা, ১৯৪৯ সালে এর ভেতরে প্রতিমা স্থাপন করে অবমাননা করা ছিল অন্যায় কাজ। কিন্তু তা সত্ত্বেও, রায় দেয়া হয়েছে মন্দিরের পক্ষে। রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : মসজিদটি ধ্বংস করা এবং ইসলামি কাঠামোটি নিশ্চিহ্ন করা ছিল আইনের শাসনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

ভারতের সেক্যুলারবাদ বর্তমানে বড় ধরনের পরিচিতি সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সেক্যুলারবাদের অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে মোহন ভগত একবার যেভাবে বলেছিলেন যে একজন বড় ভাইয়ের মতো আচরণ করবে এবং অপরজন ছোট ভাইয়ের মতো তার সব কিছু শুনবে। পরিস্থিতি যদি এমনই হয়, তবে ভারত আর গণতান্ত্রিক সেক্যুলার দেশ থাকে না। এটা হয়ে পড়ে সামন্তান্ত্রিক দেশ।
অনেক মুসলিম এখনো মনে করে, এই বিরোধপূর্ণ জমিটি কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়কে না দিয়ে হাসপাতাল, স্কুল বা সেক্যুলার উদ্দেশ্যপূর্ণ কোনো কাজে ব্যবহারের জন্য দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু ‘মন্দির ওহিন বানায়েঙ্গা’ চিৎকার বিষয়টিকে অহংয়ের লড়াইয়ে পরিণত করেছে। মসজিদটি ধ্বংস করে মন্দির নির্মাণের কাজটি ১৬তম শতকের বদলায় পরিণত হয়ে গেছে। আর তা একটি পুরো সম্প্রদায়কে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে যাদের বাবর বা মোগলদের নিয়ে করার কিছুই নেই।

অযোধ্যাতেই থামবে?
বিষয়টি কি অযোধ্যাতেই থামবে? উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের হিন্দু যুব বাহিনী চায় তাজমহলের ভেতরে শি চালিসা পাঠ করতে। আর বিজেপির সাবেক এমপি বিনয় কাত্যিয়ার একে বলেছেন তেজো মহল।‘ হিন্দু উগ্রপন্থীরা বেম কয়েকটি মসজিদ, সমাধিসৌধ বা স্মারকসৌধকে একসময় মন্দির ছিল বলে দাবি করছে।

গত বছর হিন্দু মহাসভার আলিগড় ইউনিট কুতুব মিনারকে ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। অনেক উগ্রবাদী হিন্দু মনে করে, লাল কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন কোনো হিন্দু শাসক। আর ওয়্যারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএস অনেক দিন ধরেই স্বঘোষিত ইতিহাসবিদ পুরোষোত্তম নগেশ ওকের নীতি অনুসরণ করছে। ১৯৬৪ সালে তিনি ইনস্টিটিউট ফর রিরাইটিং ইন্ডিয়ান হিস্টরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ওকের কিছু অদ্ভূত দাবির মধ্যে ছিল, সৌদি আরবের কাবাঘর ছিল হিন্দু মন্দির, গোয়ালিয়রের মোহাম্মদ গাউস, ফতেহপুর সিক্রির সেলিম চিশতির সমাধি, আজমিরের মইনুদ্দিন চিশতির মাজার ইত্যাদি মুসলিম জয়ের আগে ছিল হিন্দু কাঠামো।

এখন অযোধ্যা লাভের পর হিন্দুদের দাবি কি থামবে?
অযোধ্যা রায় ভারতের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় নজির হয়ে রইল। এখন আদালতগুলোতে বিশ্বাস আর ভাবাবেগের স্থান গুরুত্ব পাবে। কে জানে এরপর হয়তো শোনা যাবে ‘তেজো মহালয়া ওহিন বানায়েঙ্গা।‘

তারা বলে, সফল আলোচনা হলে কোনো পক্ষই অসন্তুষ্ট হবে না। কিন্তু অযোধ্যায় দেখা গেছে, কেবল একটি সম্প্রদায়ই অসন্তুষ্ট। মুসলিমেরা জোর দিয়ে বলেছে যে তারা অযোধ্যা রায়টি মেনে নিয়েছে। কিন্তু তারা কি একে শ্রদ্ধা জানাবে? কোনোভাবেই নয়।

রায়টি ভারতের নেহরুবাদী আদর্শকে আহত করেছে।

দি প্রিন্ট

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us