বাংলাদেশে চীনা ঋণ : নেপথ্য কিছু কথা

গৌতম দাস | Nov 11, 2019 04:54 pm
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং - ছবি : সংগ্রহ

 

গত মাসে ১৮ সেপ্টেম্বর দেশের ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকায় একটা ছোট নিউজ ছাপা হয়েছিল। যার শিরোনাম ছিল, ‘চীন আপাতত বাংলাদেশে কোনো নতুন প্রকল্পে আর অর্থ জোগাবে না’। কেন?

বাংলাদেশ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে ব্যাপক, প্রতিযোগিতা না বলে, রেষারেষি চলে বলা ভালো। ‘বাংলাদেশে যে সরকার আছে সেটা তো আমাদেরই’ এমন দম্ভ ভারতের মিডিয়ায় প্রায়ই প্রকাশ হতে দেখা যায়। ভারতের সরকারি পাতিনেতারাও অনেক সময় এমন মন্তব্য করে থাকে। তারা বলতে চায়, বাংলাদেশের সরকার তাদেরই বসানো। ফলে চীন কেন বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে বা দাবি করবে। তাদের বক্তব্যের আকার ইঙ্গিত, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এরকমই থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে কার কেমন বিনিয়োগের সক্ষমতা- চীন না ভারতের, এই প্রসঙ্গ এলে এবার অবশ্য আবার তারা নিজেরাই কুঁকড়ে গিয়ে বলে ভারতের তো বিনিয়োগ সক্ষমতা নেই, তাই বাংলাদেশে আমরা চীনের কাছে হেরে যাই।

এক কথায় ভারতের ন্যূনতম মুরোদ না থাকলেও অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত চীনের সাথে সে টক্কর দিয়ে চলছে এই ভাব তাকে দেখাতেই হবে, এমনই জেদ ও গোঁয়ার্তুমি ঘটতে আমরা সবসময় দেখে থাকি। শুধু তাই নয়, ভারত চীন নিয়ে অজস্র নেতি-মিথ ছড়িয়ে রেখেছে, যার প্রবক্তা ও শিকার আমাদের বা ভারতে মিডিয়াও। যেমন ভারতকে ফেলে চীন বাংলাদেশকে দখল করে নিলো। কিভাবে? না, চীন বাংলাদেশে অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক উপস্থিত হয়ে আছে বা বিনিয়োগ করে আছে। কিন্তু ফ্যাক্টস অর্থে বাস্তবতা হলো- এটা একেবারেই কেবল সেদিনের ফেনোমেনা। গত ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরে আসার আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে চীনের বড় অবকাঠামো বিনিয়োগ প্রায় ছিলই না। তাই এ কথাগুলো পুরোপুরি ভিত্তিহীন। তবে সেই সময়কালে বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেটা কন্ট্রাক্টর বা বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে।

এ ছাড়া বাংলাদেশে চীনের অনেকগুলো বুড়িগঙ্গা মৈত্রী সেতু অথবা মৈত্রী অডিটোরিয়াম ধরনের ছোটখাটো বিনিয়োগ প্রকল্প এসব অনেক পুরনো। এগুলো টেনে আনলে এমন ছোট ছোট চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই আছে। তবে কোনো বড় অবকাঠামো প্রকল্পের বিনিয়োগকারী হিসেবে চীন ছিল না। বরং চীনা প্রেসিডেন্টের ২০১৬ সালের অক্টোবরে ওই বাংলাদেশ সফর থেকেই ব্যাপক বিনিয়োগ আসা শুরু হয়, সে সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের। এ নিয়ে ২০১৬ সালের অক্টোবরে সে সময় ভারতের এনডিটিভি লাইভ-ইনহাউজ একটা টকশো ধরনের আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল- ভারতের ক্ষমতাসীনেরা পাতিনেতাসহ বলে থাকেন, বাংলাদেশ তো তাদেরই, এটাই তারা শুনে আসছে।

তাই যদি হয় তবে চীনা প্রেসিডেন্ট এত ঘটা করে বাংলাদেশে আসছেন এটা তারা দেখতে পাচ্ছে কেন? এই চোখ আর কানের বিবাদ মেটানো তারা এটা কেন দেখতে পাচ্ছে, এই বিষয়টা পরিষ্কার করা ছিল এনডি টিভির উদ্দেশ্য। তাদের ওই আলোচনা থেকে তাদেরই করা হতাশ উপসংহার ছিল- ‘দিল্লি আসলে অনেক দূরে’। মানে কী? মানে, চীনের সক্ষমতার তুলনায় ভারত কোনো বিনিয়োগকারীই নয়। খোদ ভারতই যেখানে বিনিয়োগ-গ্রহীতা। কাজেই বিনিয়োগের বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের দিক থেকে বাংলাদেশে ভারত কেউ না। তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশে সরকারকে ভোটবিহীন অর্থে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতায় থাকতে হলে ভারত সে ক্ষেত্রে একটা ফ্যাক্টর অবশ্যই। যে ব্যাপারে আবার চীন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বলাই বাহুল্য। অতএব ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরে, সেটাই আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিকভাবে মিডিয়ায় ব্যাপক হইচই পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ তো হাতের মোয়াও নয়। চীন সেই সফরকে ‘মাইলস্টোন’ বলেছিল, আর তাতে বাংলাদেশে প্রো-ইন্ডিয়ান বিডিনিউজ২৪সহ আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়াগুলোও সবাই অনুরণিত করেছিল যে, এটা চীনের ‘মাইলস্টোন’ সফর। এমনটা না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কারণ সফর শেষে ফাইনালি দেখা গেল, মোট ২৭টা প্রকল্পের জন্য প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারে চুক্তি বা এমওইউ স্বাক্ষর হয়েছিল তখন।

যেটা আবার এখন ২০১৯ সালের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, সেই ফিগারটাও ছাড়িয়ে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ইতোমধ্যেই প্রবেশ করেছে। আর এরপর এখন? ‘কোনো কারণে’ চীন একটু দম নিতে চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, দম নেয়াই বলছি; অর্থাৎ সাময়িক বিরতি। এটা ঠিক মুখ ফিরিয়ে নেয়া নয়। ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের ওই রিপোর্ট বাংলাদেশের চীনা দূতাবাসের বাংলাদেশকে লেখা চিঠির বরাতে লিখেছে, ‘চলতি ২৫ বিলিয়ন ডলারের ২৭ প্রজেক্টের বাস্তবায়নের বাইরে অন্য কিছুতে চীন এখন মন দেবে না। আর বিগত নেয়া প্রকল্প কাজগুলোর একটা মূল্যায়ন করতে সে লম্বা সময় নেবে’। তাই বাংলাদেশ সরকার যেন নতুন আরো কোনো প্রকল্প নিতে নতুন কোনো প্রকল্প-প্রস্তাব না পাঠায়।

এই খবর থেকে বাংলাদেশজুড়ে একটা কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে যে, তাহলে চীনও কী হাত গুটিয়ে নিচ্ছে? তারা কী সরকারের ওপর নাখোশ? সরকারকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে? সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে? বাংলাদেশ কী আর কোনো চীনা বিনিয়োগ কোনোদিন পাবে না? ইত্যাদি নানান অনুমানের কানাঘুষা গুজব শুরু হতে দেখা গেছে। এর সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে সেটাই এখানে আলোচনার মূল প্রসঙ্গ।

খুব সম্ভবত এটা নতুনভাবে নতুন নিয়ম-কানুন চীনের আবার বিনিয়োগে বাংলাদেশে আসার পূর্বপ্রস্তুতি নেয়ার কালপর্ব। এ কারণে এটা সাময়িক বিরতি। যে ধরনের সম্পর্ক কাঠামো বা চুক্তি-কাঠামোর মধ্যে এতদিন অবকাঠামো বিনিয়োগ করে এসেছে, তাকে আরো স্বচ্ছ করে নিতেই সম্ভবত চলতি বিরতি এটা। আর এই ঢেলে সাজানোটা কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, এটা যেকোনো দেশে চীনা অবকাঠামো বিনিয়োগের বেলায় নেয়া এমন পরিবর্তন হওয়ার কথা।

আমাদের এই সম্ভাব্য অনুমান যদি সঠিক হয় তবে আমাদের কথা শুরু হতে হবে জিটুজি থেকে। জিটুজি মানে ‘গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট’ বা সরকারের সাথে সরকারের বোঝাপড়া।
চীনের সাথে নেয়া বাংলাদেশের বেশির ভাগ অবকাঠামো প্রকল্প এগুলো আসলে জিটুজির অধীনে নেয়া। যার সোজা অর্থ হলো- কোনো প্রকল্প নির্মাণে কত মূল্য বা খরচ পড়বে তা নির্ধারণ নিয়ে কোনো আন্তর্জাতিক টেন্ডার এখানে হবে না, তাই সবার জন্য কোনো উন্মুক্ত টেন্ডার ডাকা আর সেখান থেকে সে মূল্য যাচাই করে নেয়া হবে না। কিন্তু টেন্ডারবিহীনতাকে আইনে বাঁচাতে এখানে ‘সরকারের সাথে সরকারের চুক্তি’ হয়েছে বলে এই উসিলায় ‘খরচের কাহিনী’ আন্ডারস্টান্ডিং করে নির্ধারিত হয়েছে বলা হবে। এটা চীনা বিনিয়োগের অস্বচ্ছ দিক নিঃসন্দেহে; এক কথায় উন্মুক্ত টেন্ডার না হওয়া যেকোনো বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই একটা কালো দিক, তা বলাই বাহুল্য।

যেকোনো বড় অবকাঠামো প্রকল্পে টেকনিক্যাল দিক থেকে ওই প্রকল্প ব্লু-প্রিন্ট মতো ঠিক ঠিক নির্মিত হয়েছে কি না তা প্রকল্প-গ্রহীতা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দাতা বা দাতার নির্মাণ কোম্পানি সম্পন্ন করেছে কি না তা বুঝে নেয়া। এটা প্রকল্পে স্বচ্ছতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রকল্প-গ্রহীতা রাষ্ট্রস্বার্থের হয়ে প্রকল্প বোঝে নেয়ার কাজটা করে থাকে সাধারণত এক বিদেশী কনসালটেন্ট কোম্পানি। যেমন- বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প যমুনা সেতুর বেলায় তাই দেখা গিয়েছিল। আবার এই কনসালটেন্ট কোম্পানিগুলোই হয়ে দাঁড়ায় ঘুষের অর্থ সরানোর উপায় কোম্পানি। নির্মাণ কন্ট্রাক্টরের কাছ থেকে ঘুষের অর্থ নিয়ে সরকার বা সরকারের লোকের কাছে পৌঁছে দেয়ার কোম্পানি। কারণ কাজের বিল ছাড় করার অনুমোদন দেয়ার ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে ওই কনসালট্যান্ট কোম্পানির হাতে।

কিন্তু চীনা জিটুজির বেলায় চীন কনসালট্যান্ট পছন্দ করে না বলে প্রকল্পের খরচে না গ্রহীতা রাষ্ট্র চাইলে নিজ খরচে সমান্তরালভাবে কোনো কনসালট্যান্ট কোম্পানিকে নিয়োগ দিতে পারে। তা রাখতেও পারে। তাহলে কী চীন বিশ্বব্যাংকের নিয়মের চেয়ে স্বচ্ছ। না, একেবারেই নয়। কারণ বিশ্বব্যাংকে তো তবু উন্মুক্ত টেন্ডার ছাড়া কাজ দেয়ার নিয়মই নেই। তাহলে? আসলে চীন বলতে চায়- যেহেতু এটা জিটুজি, তাহলে কনসালটেন্টের আর প্রয়োজন কী? কিন্তু তাহলে এখানে ঘুষের অর্থ স্থানান্তরের প্রতিষ্ঠান কে হয়? সহজ উত্তর, চীনা নির্মাণ কোম্পানির এক স্থানীয় বাংলাদেশী এজেন্ট কোম্পানি থাকতে দেখা যায়। সাধারণত এটাই সেই অর্থ স্থানান্তরের কোম্পানি হয়ে থাকে। আবার কনসালট্যান্ট কোম্পানি রেখেই বা লাভ কী হয়? সে প্রশ্নও ভ্যালিড। কারণ, যমুনা সেতু নির্মাণের ১০ বছরের মাথায় ফাটল দেখা গিয়েছিল। এর দায় কনসালট্যান্ট কোম্পানিকে নিতে দেখা যায়নি। এ কথাটাও তো সত্যই।

ওই দিকে ইতোমধ্যে দুই বছর ধরে বিশেষ করে গত বছর আমেরিকান সরকারি উদ্যোগে কিছু একাডেমিককে দিয়ে একটা প্রপাগান্ডা শুরু হয়েছিল, যার সার বক্তব্য হলোÑ যে চীন ‘ঋণের ফাঁদ’ তৈরি করছে ও ঋণগ্রহীতা দেশকে এতে ফেলছে। এ নিয়ে চীনবিরোধী ব্যাপক ক্যাম্পেইন শুরু করা হয়েছিল।

পশ্চিমা ঋণ মানে মূলত আমেরিকান অবকাঠামো-ঋণ রাষ্ট্র নিজে অথবা বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ, দুনিয়াজুড়ে এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের ফেনোমেনা। কম কথায় বললে, বিশ্বযুদ্ধের পরেই কেবল আগে তো কলোনিমুক্ত হয়ে দেশগুলোকে স্বাধীন হতে হয়েছে; এরপর না খোদ বিশ্বব্যাংকেরই জন্ম হতে হয়েছে। আর এরও পর স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো তারা বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়ে শেষে লোন নেয়া শুরু করেছিল। এ কারণে সবটাই বিশ্বযুদ্ধের পরের ফেনোমেনা। তাও আবার আরো কাহিনী আছে। জাপান বাদে যে এশিয়া, এর বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাওয়ার কেস ঘটেছিল অন্তত আরো ২০ বছর পর, সেটা ষাটের দশকের আগে তো একেবারেই নয়। অর্থাৎ ’৪৫ সাল থেকে পুরো ষাটের দশক পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত সারা ইউরোপ ও এদিকে একমাত্র জাপানকে পুনর্গঠনে অবকাঠামো বিনিয়োগ করেছিল। যার চিহ্ন হিসেবে ‘রি-কনস্ট্রাকশন’ শব্দটা বিশ্বব্যাংকের নামের সাথে জড়িয়ে যায়।

আর সেই বিনিয়োগ যা আমেরিকার ‘মার্শাল প্ল্যান’ নামে পরিচিত ছিল, তা স্যাচুরেটেড কানায় কানায় ভর্তি হয়ে উপচিয়ে না পড়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক ইউরোপ আর জাপান থেকে সরেনি, এশিয়াতেও আসেনি। বরং এশিয়ায় বিশ্বব্যাংক পুরোদমে ঋণ দিতে শুরু করেছিল ১৯৭৩ সালের পর থেকে, ততদিনে বিশ্বব্যাংক প্রথম ম্যান্ডেট (সোনা ভল্টে রিজার্ভ রেখে তবেই সমতুল্য মুদ্রা ছাপানোর বাধ্যবাধকতা) অকার্যকর ও এই পরাজয় সামলানোর পরে ১৯৭৩ সালে নতুন ম্যান্ডেটে বিশ্বব্যাংকের পুনর্জন্ম হয়েছিল। আর বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক প্রথম তৎপরতায় এসেছিল ১৯৭৫ সালের শেষভাগে। তবুও সেই থেকে বাংলাদেশে গত ৪৫ বছরে বিশ্বব্যাংক যে মোট ঋণ দিয়েছে তা গত তিন বছরে চীন একা যে অবকাঠামো ঋণ দিয়েছে তার চেয়েও কম। মূল কথা, বিশ্বব্যাংকের মোট সামর্থ্যরে চেয়ে চীনা সামর্থ্য অনেক বেশি। কিন্তু এতদিনে বিশ্বব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পেশাদারিতে ইন্ট্রিগিটিতে নিজেকে যতটা তুলনামূলক কিছুটা স্বচ্ছ করতে সক্ষম হয়েছে, এই বিচারে চীন অনেক পেছনে।

এ ব্যাপারে অবশ্য চীনের কিছু পাল্টা যুক্তি ও শেল্টার আছে।

কোনো দেশে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা ও সেই কাজ ধরা প্রসঙ্গে চীনের যুক্তিটা অনেকটা এরকম যে গ্রহীতা রাষ্ট্র চোর হলে আমরা ওর সহযোগী হয়ে যাই ও বেশ করে ঘুষের ব্যবস্থা করে দেই। আবার তারা যদি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার সরকার হয় সে ক্ষেত্রেও আমরা তার সহযোগীই হয়ে যাই। বাংলা মানে হলো- আমরা ঘুষ না দেয়ার কারণে কাজ হারাতে চাই না। এ ছাড়াও চীন বলতে চায় (বুর্জোয়া) আমেরিকার চেয়ে আমরা ভালো। কারণ ওই গ্রহীতা দেশে ক্ষমতায় কে আসবে বসবে তা নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। কিন্তু আমেরিকার আছে। আমরা বরং আমেরিকার কাছে নিশ্চয়তা নিয়ে নেই যে, হবু যেকোনো সরকার যেন আমার অর্থনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করে দেয়। এটাই চীনের আপাতত অবস্থান ও কৌশল।

বাস্তব এমন পরিস্থিতিতে উত্থিত অর্থনীতির চীনের বিরুদ্ধে, শুরু থেকেই বিশেষত একালে চীনা বেল্ট-রোড মহাপ্রকল্প নিয়ে হাজির হওয়ার পর আমেরিকার পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব হয়নি। আমেরিকা চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের বিরুদ্ধে, নিজের গ্লোবাল নেতৃত্বকে চীনের চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্য বিরোধ দেখিয়েছিল চীনের বিশ্বব্যাংক ‘এআইআইবি’ ব্যাংকের জন্মের সময় থেকে। এক কথায় দিন কে দিন আমেরিকা স্পষ্ট জানছিল যে, সত্তর বছর ধরে তার পকেটে থাকা গ্লোবাল নেতৃত্ব এটা চীন কেড়ে নিতে চ্যালেঞ্জ করতে উঠে আসছে। আর তাতে আমেরিকা ২০০৯ সালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, চীনের এই উত্থানকে আমেরিকা নিজের পাশাপাশি সমান্তরালে উঠতে বা চলতে দিতে চায় না। বরং যতদূর ও যতদিন পারে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে- এই নীতি নিয়েছিল। এই নীতিরই সর্বশেষ অংশ হলো- চীন ‘ঋণের ফাঁদ’ ফেলতে চাচ্ছে, এই ক্যাম্পেইন শুরু করা।

প্রথমত, চীনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেলা যে, চীন দুনিয়াতে বিভিন্ন দেশের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে আসেনি। বরং ‘ঋণের ফাঁদ’ ফেলে চাপ দিয়ে বাড়তি সুবিধা নেয়া, যেন এটাই চীনের ব্যবসায়, এমন একটা প্রচারণার আবহ তৈরি করেছে আমেরিকা- এটা ডাহা ভিত্তিহীন ক্যাম্পেইন। এমনকি সত্তর-আশির দশকের বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেও যেসব অভিযোগ কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলেরা করত যে, ঋণের অর্থ বিশ্বব্যাংক অপচয় বা নিজের কর্মীদের সে অর্থ পকেটে ভরা অথবা কনসালট্যান্টের নামেই ঋণের অর্ধেক টাকা মেরে দেয়া বা ফিরিয়ে নেয়ার অভিযোগ (যারা এই অভিযোগ তুলত এদের জানাই নেই যে, কনসালটেন্সিতে দাবি করা অর্থ মোট প্রকল্পের পাঁচ শতাংশের বেশি দেখানোও কত অসম্ভব) চালু ছিল, তাতে যতটুকু বাস্তবতা ছিল, একালে চীনবিরোধী এই ক্যাম্পেইনে তাও নেই। তবে আবার চীনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই নেই, সে কথাও মিথ্যা। ঠিক যেমন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, এ কথাও ডাহা মিথ্যা।
প্রথমত কোনো উন্মুক্ত টেন্ডার ছাড়াই তথাকথিত জিটুজিতে প্রকল্প নেয়া, এটাই তো চীনা প্রকল্পের সবচেয়ে বড় অগ্রহণযোগ্য দিক। চূড়ান্তভাবে অস্বচ্ছতা। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক অন্তত প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে যে, অবকাঠামো ঋণের দাতা যে দেশই হোক না কেন, তাতে ওই প্রকল্পের কাজ সেই দাতা দেশ পাবে না। খোলা টেন্ডার হতে হবে- বিশ্বব্যাংক যেখানে ইতোমধ্যেই এই নীতিতে পরিচালিত, চীনা ঋণ নীতি এখনো এই মান অর্জন করতে পারেনি। কাজেই চীনা অবস্থান গ্রহণযোগ্য হতেই পারে না।

তবে আবার এ কথাও সত্য যে, ঋণগ্রহীতা দেশ পরিশোধের সমস্যায় পড়ে যায় এমন বেশি ঋণ যদি হয়েও যায়, তবে চীন তা গ্রহীতা দেশের ঘটিবাটি সম্পত্তি বেঁধে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়, তা-ও কখনোই ঘটেনি। বরং পুনর্মূল্যায়ন সুদ কমিয়ে দেয়া, পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দেয়া থেকে শুরু করে এক কথায় যেকোনো রি-নিগোশিয়েশনের সুযোগ- এ পর্যন্ত সব দেশের ক্ষেত্রেই চীন দিয়েছে। যেমন- মালয়েশিয়া বা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে আমরা তাই দেখেছি। আর শ্রীলঙ্কার বন্দর নির্মাণের ঋণ পরিশোধের জটিলতা মূলত অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খেয়াখেয়ি থেকে উঠে এসেছে। নিজের মাজায় জোর নেই এমন শ্রীলঙ্কার একটা রাজনৈতিক দলকে বাগে এনে ভারত কাছে টেনে উসকানি দেয়া থেকে এটা তৈরি হয়েছে। যার কারণে বাড়তি সমস্যা হলো, বন্দর তৈরি হয়ে যাওয়ার পরও তা চালু করা যায়নি।

পরের পাঁচ বছর এটা অকেজো ফেলে রাখা হয়েছিল ও এতে আয়হীন ঋণের দায় আরো বাড়ছিল। আবার চীন ওই বন্দর নির্মাণ ঋণ পরিশোধে চাপ দিচ্ছিল এমন কোনো ব্যাপার সেখানে ছিল না। কিন্তু শ্রীলঙ্কা নিজেরাই দুই দলের টানাটানি সামলাতে না পেরে নির্মিত এই বন্দরের মালিকানা নিতে অপারগতা জানালে ওই বন্দর নিজে অপারেট করে চালিয়ে আয় তুলে আনার কোম্পানি হিসেবে চীন বাধ্য হয়ে অন্য এক চীনা কোম্পানি সামনে এনেছিল।

আবার, প্রথমত যে তর্কের ভিত্তি কোনো দিনই সাব্যস্ত করা যায়নি যে, কোনো রাষ্ট্রে ‘ঋণ অতিরিক্ত নেয়া হয়ে গেছে’ কী হলে এটা বোঝা যাবে? ঋণ জিডিপির কত পার্সেন্ট হয়ে গেলে সেটা অতিরিক্ত ঋণ বলে গণ্য হবে- এর সর্ব-গ্রহণযোগ্য নির্ণায়ক কোথায়? তা খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে যেখানে কিস্তি না দিলে টুঁটি চেপে ধরতে হবে, চীনের এমন কোনো নীতিই নেই। আবার এই নীতি মানলে ভুটানে ভারতের বিনিয়োগ একই দোষে দুষ্ট। মানে ভুটানে ভারতও ঋণের ‘ফাঁদ পেতেছে’ অভিযোগ উঠে, এর কী হবে? তাহলে চীন ঋণের ফাঁদ পেতেছে এটা যেমন মিথ্যা, তেমনি আবার চীনের অবকাঠামো ঋণ নীতি সব স্বচ্ছ; তাও একেবারেই সত্যি নয়। এমনকি চীন আপটুডেট এখনকার গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলে, তাও নয়।

সার কথায়, আমেরিকার এসব তৎপরতা নেতিবাচক ও চীনবিরোধী প্রপাগান্ডা। আর ভারতও সুযোগ বুঝে এতে সামিল হয়েছে আর নিজের মিডিয়ায় এসবের প্রগান্ডায় ভরিয়ে ফেলেছে। এমনকি আমাদের প্রথম আলো কোনো ক্রিটিক্যাল অবস্থান না নেয়া ছাড়াই ভারতের মিডিয়ার খবর অনুবাদ করে ছাপাচ্ছে। ইদানীং অবশ্য লক্ষ করা যাচ্ছে, হঠাৎ এমন প্রপাগান্ডায় ভাটা পড়েছে। হতে পারে প্রপাগান্ডাকারীদের সাথে চুক্তি শেষ হয়ে গেছে!

সেটা যাই হোক, আসলে নতুন এ ঘটনা ঘটে গেছে। ব্যাপ্যারটা হলো- নতুন এক স্টেজ তৈরি হয়ে গেছে। এই আসরের ইতিবাচক নেতা ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আর এর সূত্রপাত, চীনা বেল্ট-রোড মহাপ্রকল্পের সারা ইউরোপকে সাথী হিসেবে পেতে যাচ্ছে এখান থেকে। অথবা কথাটা উল্টা করে বলা যায়, বেল্ট-রোড প্রকল্পের ইউরোপে বিস্তৃতিকে ইইউ বিরাট সম্ভাবনা হিসেবে দেখেছে ও সক্রিয় যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আর ঠিক এ কারণে আমেরিকার যেমন অবস্থান হলো চীনকে কোনো সহযোগী স্থান না দেয়া বা হওয়া নয়। চীনের সাথে মিলে কোনো স্ট্যান্ডার্ড তৈরি হয় তা বরং নাকচ করে চীনকে কোণঠাসা করা; ঠিক এরই বিপরীতে ইইউয়ের অবস্থান হলো- চীনকে গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে আসতে হবে, সেই স্ট্যান্ডার্ড যৌথভাবে আরো উপরে উঠাতে ভূমিকা নিতে হবে। এই শর্তে বেল্ট-রোডসহ চীনকে আপন করে নিতে হবে।

এ ব্যাপারে গত ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল চীন-ইইউ যৌথ সম্মেলনসহ ঘটনা অনেক দূর এগিয়ে কাজে নেমে গেছে। আর ওই দিনই একমতের করণীয় নিয়ে এক যৌথ ঘোষণাও প্রকাশিত হয়ে গেছে। যদিও অবকাঠামো ঋণদানসহ অর্থনৈতিক তৎপরতায় স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড তৈরি কথাটা শুনতে যত সহজ মনে হয়, ব্যাপারটা ততই সহজ-সরল নয়।

মূল কারণ গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড কথাটা বলা মানেই আপনা থেকেই উঠে আসবে জাতিসঙ্ঘের কথা। জাতিসঙ্ঘের চার্টার, ঘোষণা, আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন এককথায় অধিকারবিষয়ক সবকিছুই। মূল কারণ জাতিসঙ্ঘ দাঁড়িয়ে আছে ‘অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র’ এরই একটা সমিতি বা অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে।
কিন্তু তাতে সমস্যা কী?

সমস্যা বিরাট। মৌলিক সমস্যাটা হলো- কমিউনিস্ট রাজনীতি অধিকারভিত্তিক রাজনীতি বা রাষ্ট্রচিন্তা নয়। যদিও জাতিসঙ্ঘের পাঁচ ভেটোওয়ালা রাষ্ট্রের দুটিই কমিউনিস্ট। অন্তত কমিউনিস্ট ব্যাকগ্রাউন্ডের রাষ্ট্র, যার সোজা অর্থ হলো- ‘অধিকারের রাষ্ট্র’ কথাটায় তাদের ‘ঈমান’ কম। অধিকারের রাষ্ট্র ও রাজনীতি এটা কমিউনিস্টদের রাজনীতি নয়, কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাও নয়। অথচ কমিউনিস্টরাও বহাল তবিয়তেই জাতিসঙ্ঘে সক্রিয় আছে। কিন্তু যেসব জায়গায় অধিকারবিষয়ক নীতি বা কথাবার্তায় প্রাবল্য আছে, সেসব সেকশন বা বিভাগ কমিউনিস্টরা তেমন অংশ নেয় না বা পাশ কাটিয়ে চলে। আড়ালে টিটকারীও দেয়। এগুলো এতদিনের রেওয়াজের কথা বলছি।
কিন্তু আমরা যদি এ নিয়ে চীন-ইইউয়ের যৌথ ঘোষণা পাঠ করি, তাহলে বুঝব ঘটনা আর সে জায়গায় নেই। পানি অনেকদূর গড়িয়েছে। ওই যৌথ ঘোষণায় জাতিসঙ্ঘের অধিকারবিষয়ক ভিত্তিগুলোর রেফারেন্স উল্লেখ করে বলা হয়েছে- চীন ও ইইউ এগুলোকে মেনে চলে ও ভিত্তি মনে করে। এমনকি বলা হয়েছে, এখন থেকে প্রতি বছর চীন ও ইইউ মানবাধিকারের বিষয়গুলোর পারস্পরিক বোঝাবুঝি বাড়াতে আলাদা যৌথ সেশনের আয়োজন করবে।

এমনকি ওই সম্মেলনের পরে এ বছরের চীনা বেল্ট-রোড প্রকল্পের দ্বিতীয় সম্মেলনেও যে যৌথ ঘোষণা গ্রহীত হয়েছে সেই যৌথ ঘোষণাও আসলে চীনা-ইইউয়ের আগের যৌথ ঘোষণার ছাপে তৈরি।

এই সবগুলো অভিমুখ বিচারে, বাংলাদেশে চীনা অবকাঠামো বিনিয়োগে বিরতি এবং চীনা অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের কথা যেগুলো শোনা যাচ্ছে, তাতে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা হলো- চীন যে অভ্যন্তরীণ নীতি বদলাচ্ছে; এরই ছাপ এখানে পড়ছে বলে অনুমান করা আশা করি ভুল হবে না। লেটস হোপ ফর দ্য বেস্ট! চীন আবার স্বচ্ছ নীতিতে অবকাঠামো ঋণ দিতে এগিয়ে আসবেই।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us