গ্যাস সিলিন্ডাররে মারাত্মক বিপদ
গ্যাস সিলিন্ডারর - ছবি : সংগ্রহ
গ্যাস ভরা উড়ন্ত বেলুনের প্রতি শিশুদের আকর্ষণ পুঁজি করে প্রাণঘাতী ব্যবসা কতটা মর্মান্তিক হতে পারে, এর প্রমাণ ফের পাওয়া গেল রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে। বেলুন ওড়ার বদলে বেলুন বিক্রেতার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মুহূর্তে নিভে যায় বেশ কয়েকজনের জীবনপ্রদীপ। এমন মর্মান্তিক ঘটনায় সমবেদনা জানানোর ভাষাও কারো নেই। শিশুদের খেলনা রঙিন বেলুন ফোলানোর সিলিন্ডার যেন এক একটি ‘চলন্ত বোমা’। অপেশাদার বেলুন বিক্রেতারা সনাতন পদ্ধতিতে বিক্রিয়া ঘটিয়ে ‘হাইড্রোজেন’ গ্যাস উৎপাদন করছেন, যা জীবনের জন্য শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অথচ বিপজ্জনক এই ব্যবসা বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ। এমন ঘটনা অতীতেও ঘটেছে; কিন্তু টনক নড়েনি দায়িত্বশীলদের। বিস্ফোরক অধিদফতরের দায়িত্বশীলদের বক্তব্য- পত্রপত্রিকায় বিস্ফোরণের খবর দেখে এ অপপক্রিয়া বন্ধে বছর দুই আগে তারা পুলিশকে চিঠি দিয়েছিলেন; কিন্তু এরপর আর কোনো উদ্যোগ নেই! পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকার কিছু এলাকায় বিপজ্জনকভাবে নানা রকম রাসায়নিক উপকরণের সংমিশ্রণে অনভিজ্ঞ লোকজন মুনাফা লাভের আশায় এমন গর্হিত কাজ করে চলেছেন। কিন্তু সবার জানা, ‘হাইড্রোজেন’ এক ধরনের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জ্বালানি।
শিশুদের কাছে অতিপ্রিয় এবং অনুষ্ঠানাদিতে দৃষ্টিনন্দন সাজসজ্জায় গ্যাস বেলুন ব্যবহার করা হয়। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী অবৈধভাবে সিলিন্ডারে হাইড্রোজেন গ্যাস ভরে তা বেলুন বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে আসছেন। ঘরে ঘরে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সিলিন্ডারের মতো গ্যাস বেলুন সিলিন্ডারের সংখ্যা প্রচুর না হলেও প্রায়ই ঘটছে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনা। এসব গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা হতাহত হয়ে থাকে। সারা দেশে বেলুন বিক্রেতারা এই বিপজ্জনক সিলিন্ডার গ্যাস দিয়ে বেলুন বিক্রি করছেন। গত বছর অক্টোবরে পাবনার ঈশ্বরদীতেও বেলুন বিক্রেতার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে পাঁচ শিশু দগ্ধ হয়েছিল। তবে রূপনগরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে ট্র্যাজিক-প্রাণঘাতী বলে এখন পর্যন্ত সবার মানে দাগ কেটেছে।
সিএনজি বা প্রাকৃতিক গ্যাসের বোতলজাত ব্যবহার সারা বিশ্বে বাড়ছে। তবে বাংলাদেশের মতো আর কোনো দেশে এমন যথেচ্ছ, নিরাপত্তাহীন গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার করতে দেখা যায় না। সিলিন্ডারের যথাযথ মান, উৎপাদনের পর নিরাপদ মেয়াদ ও গ্যাসের যথাযথ পরিমাপ ও মূল্য কোনোটাই যথার্থভাবে রক্ষিত হয় না।
এ কারণে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অনুমোদনহীনভাবে মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিরাপত্তাহীন সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে বিক্রি করছেন। ফলে যত্রতত্র ঘটছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগীদের বেশির ভাগই রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের শিকার। দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে এলেও ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা। এ চাহিদা পূরণে পাইপ লাইনে গ্যাস সংযোগের বদলে সিলিন্ডার ব্যবহারের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করছে সরকার।
অন্য দিকে সিএনজি, এলএনজি গ্যাস সিলিন্ডার উৎপাদন, রিফিলিং এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার যথাযথ নিয়মাবলি ও তদারকি না থাকায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জীবন ধারণের প্রয়োজনে আমাদের রান্নাবান্না করতে হয়, যাতায়াতে যানবাহনে চড়তে হয়, সব ক্ষেত্রেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। নিরাপদ খাদ্য ও সড়ক নিরাপত্তার মতো সিলিন্ডার নিরাপত্তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব ও নজরদারি বাড়ানোর জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
পুরনো, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিসহ কঠোর পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। একই সাথে বেলুন ফোলাতে হাইড্রোজেন গ্যাস সিলিন্ডার নিষিদ্ধ করতে হবে। রাস্তায়, স্কুলে, উৎসবে বা খেলার মাঠে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে শিশুদের মৃত্যুর মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা যাতে না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিক্রেতা এবং ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও নিরাপত্তা গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে হবে।