কর্তারপুরে ইমরানের ফাঁদে পা দিয়েছেন মোদি!
কর্তারপুরে ইমরানের ফাঁদে পা দিয়েছেন মোদি! - ছবি : সংগৃহীত
শনিবার কর্তারপুর করিডোর উদ্বোধনের প্রেক্ষাপটে ভারত-পাকিস্তানের সংক্রমণ-প্রতিরোধক ব্যবস্থা থেকে অনেক যন্ত্রণা দেখা গেছে।
অটল বিহারি বাজপেয়ি ও নওয়াজ শরিফ প্রথম যখন এই দুর্দান্ত আইডিয়াটি নিয়ে কাজ করছিলেন তখন কিন্তু এমন কিছু হবে বলে ধারণা করা যায়নি। ঐতিহাসিক একটি ঘটনাকে সামাল দিতে পারেননি রাজনীতিবিদেরা। ছোট মানুষদের বিশাল পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে থাকতে দেখা যাওয়ার সময়ই এমনটা ঘটছে।
অবশ্য, এটা দোষ ভাগাভাগি করার দিন নয়। তবে দায়িত্ব নিয়েই বলা যায় যে এই মুহূর্তটিকে পাকিস্তান যেভাবে সামাল দিয়েছে, তা আসলেই চমকপ্রদ। উপমহাদেশের অন্তহীন টানাপোড়েনের মধ্যেই পাকিস্তান দারুণ কাজ করেছে। তারা রেকর্ড সময়ের মধ্যেই কর্তারপুর প্রার্থনাগাহ ও প্রাঙ্গনটি নির্মাণ করেছে, আশপাশে শিখ তীর্থযাত্রীদের জন্য চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আশা করা হচ্ছে, সারা দুনিয়া থেকে শিখ তীর্থযাত্রীরা এখানে হাজির হবে।
বাস্তবতা হলো, পাকিস্তান এই প্রকল্পটি শেষ করার ব্যাপারে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে। জম্মু ও কাশ্মিরের মর্যাদা বাতিল করার মোদি সরকারের আশ্চর্য সিদ্ধান্তে আটকে না থাকে, কিংবা উপত্যকার অচলাবস্থার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে কিংবা মানবাধিকার সঙ্ঘনে সীমাবদ্ধ না থেকে কিংবা ভারতের সামরিক ও বেসামরিক নেতাদের পাকিস্তানবিরোধী কথাবার্তা আমলে না নিয়ে ওই কাজটি একাগ্রচিত্তে করে গেছে।
পাকিস্তান কর্তারপুর প্রকল্প শেষ করতে বদ্ধপরিকর- বিষয়টি যখন পরিষ্কার হয়ে যায়, তখন মোদি সরকার দোটানায় পড়ে যায়। ভারতের প্রতি শুভেচ্ছা প্রদর্শন করার জন্য পাকিস্তানের জনগণ ক্ষেপে যেতে পারে- এই ভয়ে প্রকল্পটি বন্ধ করা হতে পারে- এমন আশা থাকলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি।
আবার ভারতের দিক থেকেও স্পর্শকাতর দিক ছিল। এই প্রকল্পটি শিখ ধর্মের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। তারা পাঞ্জাবে, বিশেষ করে শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের অবস্থান জোরদার করতে চাইছে। এমন অবস্থায় পাকিস্তানের বাড়ানো শুভেচ্ছার হাত অস্বীকার করতে পারছিল না ভারত। কারণ তাতে শিখ সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
আবার যৌক্তিক কারণেই মোদি সরকার কর্তারপুর প্রকল্পের জন্য গর্ব করতে পারে। কারণ এর সাথে বাজপেয়ি সরকারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতি মোদি সরকারের এ ধরনের কোনো কৌশলগত ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শনের অবকাশ নেই। কারণ এর সাথে হিন্দু রাষ্ট্র মতাদর্শের মেলে না।
আবার মোদির নজরদারির মধ্যে অতি সম্প্রতি ভারত জাতীয় নিরাপত্তা নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই পাকিস্তান তার দরজা-জানালা খুলে দিয়েছে ভারত ও সারা দুনিয়ার শিখ সম্প্রদায়ের জন্য।
কঠোর বাস্তবতা হলো, পাকিস্তান বেশ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল কাজটি করতে। তারা দিল্লিকে এড়িয়ে সরাসরি শিখ সম্প্রদায়ের নেতাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে প্রকল্পটি এগিয়ে নিয়ে গেছে।
এখানেই রয়েছে ধাঁধা। আমি যখন পাকিস্তান ডেস্কে ছিলাম, তখন পাকিস্তানকে লজ্জায় ফেলে এর এস্টাবলিশমেন্টকে এড়িয়ে বন্ধুপ্রতীম পাকিস্তানিদের সাথে জনগণ পর্যায়ে সম্পর্ক বিকশিত করার চেষ্টা করেছি। আর এখন আমরা যখন পাকিস্তানের সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখতে চাইছি না, তখন ভারতীয়দের পাকিস্তানের মাটিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাদের পাগল করে ফেলছে।
আমরা যদি আমাদের দেশবাসীর আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করি, তবে পাকিস্তান আমাদের লজ্জা দেবে। আমরা যেন এই ভুলটি না করি। তবে হ্যাঁ, আমরা এই অনুমান করতে পারি যে পাকিস্তানি কূটনীতিতে নতুন এক যুগের সূচনা ঘটল। এর মাধ্যমে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি করে যাবে পাকিস্তান।
আসলে গান্ধীবাদী পদ্ধতিতেই মোদি সরকারের বৈরিতার জবাব দেয়ার পথ তৈরী করে ফেলল পাকিস্তান।
সিপিইসি পর্যটন খাতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে কিনা তাই ভাবছি আমি। কল্পনা করে দেখুন তো, চীনা অর্থ ও উদ্ভাবনপটুতা পাকিস্তানি অর্থনীতি ও চীনা ব্যবসায়ীদের জন্য ধর্মীয় পর্যটনকে আকর্ষণীয় প্রকল্পে পরিণত করছে না তো? চীন-পাকিস্তান কূটনৈতিক উদ্যোগ কি ভারতের বার্লিন প্রাচীর ভাঙার চেষ্টা? এটা হতে পারে ‘কোয়াডের’ যথার্থ প্রতিষেধক।
অদ্ভূত একটি কাকতালীয় ঘটনা ঘটেছে। মনে হয়, ভারতীয়রা বিষয়টি বুঝতেই পারেনি। কর্তারপুর করিডোরটি খুলে দেয়া হয়েছে বার্লিনের ব্রান্ডেনবার্গ গেট খুলে দেয়ার ৩০তম বার্ষিকীর দিন। ওই গেট খুলে দেয়ার জের ধরেই বার্লিন প্রাচীরের পতন ঘটে।
ইতিহাসে ‘দুর্ঘটনার’ শেষ নেই। গত সপ্তাহেই বার্লিন প্রাচীর নিয়ে এক জার্মান বিশেষজ্ঞ লিখেছেন :
৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই পলিটব্যুরো সদস্য গুন্টার স্কবাস্কি সংবাদ সম্মেলনে দৃশ্যত তাকে দেয়া এক বিবৃতির ভুল ব্যাখ্যা করে বলে বসলেন যে পূর্ব জার্মানদেরকে ঠিক এখনই বিদে যেতে দেযার অনুমতি দেয়া হবে। তার কথা ঠিক কিনা দেখতে চাইলেন পশ্চিম বার্লিনের রাজনীতিবিদ ও পূর্ব বার্লিনের নাগরিকেরা। বোনহোলমার স্ট্রেসে ক্রসিংয়ে এক সিনিয়র স্ট্যাসি অফিসার বিপুল জনতার মুখোমুখি হয়ে দুই সেন্ট্রিকে প্রধান ফটক খুলে দিতে বললেন। উৎফুল্ল জনতা কেঁদে ফেলল। প্রাচীরটির ঠিক পতন ঘটেনি। তবে ওই রাতেই হাজার হাজার লোক হাতকুঠার আর হাতুরি নিয়ে আসে। এটা ছিল এই ভৌত উপস্থিতির সমাপ্তির সূচনা।
তবে এমন চিন্তা করা ঠিক হবে না যে ব্যান্ডেনবার্গ গেট তথা দেরা বাবা নানকে বিএসএফের কোনো কমান্ডার বা সাদা পোশাকে থাকা কোনো আইবি অফিসার তার হাতে ইতিহাস তুলে নিয়ে সেটাকে কাগজের দলায় পরিণত করবেন কিংবা মোদি কোনো গুন্টারকে কোনো কিছু ভুল করারসুযোগ দেবেন কিংবা ধর্মীয় চিন্তায় উদ্বুদ্ধু হয়ে হাজার হাজার পাগড়িধারী শিখ ঝড়ের বেগে প্রহরীদের ডিঙিয়ে কর্তারপুর করিডোরে ছুটে যাবেন।
কিন্তু তারপরও এই চিন্তা করতে আমার মতো লোকজনের ভালো লাগে। সত্যিই এমন দিন আসতে পারে যেদিন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভাবতে বসবে।
লেখক : ক্যারিয়ার ডিপ্লোমেট, ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস, তিনি উজবেকিস্তান ও তুরস্কে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস