কাশ্মির ইতিহাসের অজানা এক অধ্যায়
কাশ্মির ইতিহাসের অজানা এক অধ্যায় - ছবি : সংগৃহীত
গত ২ অক্টোবর ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর প্রকাশিত দুটি মানচিত্রে সাবেক রাজন্য-শাসিত জম্মু ও কাশ্মিরের পুরো রাজ্যটি (বিরোধপূর্ণ) দুটি সত্ত্বা হিসেবে দেখানো হয়েছে : একটি জম্মু ও কাশ্মির কেন্দ্র-শাসিত ভূখণ্ড এবং অপরটি লাদাখ কেন্দ্র-শাসিত ভূখণ্ড। উভয়টিই ভারতের মালিকানাধীন। সব লোকজন ভারতীয়। একতরফাভাবে ভারত কাশ্মির বিরোধের অবসান করে ফেলেছে!
প্রত্যাশা অনুযায়ী ভারতীয় মানচিত্রগুলোতে পাকিস্তান-শাসিত আজাদ কাশ্মির ও গিলগিট-বাল্টিস্তান এবং চীনা-নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিন ও শাকসগাম দেখানো হয়নি। এই চারটি অঞ্চলের কোনোটিই কার্যত ভারতের নিয়ন্ত্রণে নেই। ভারতের কাছে সেগুলোর স্রেফ অস্তিত্বই নেই। কেন্দ্র-শাসিত জম্মু ও কাশ্মির ভূখণ্ড পাকিস্তান সীমান্ত পর্যন্ত গেছে আজাদ কাশ্মিরকে অন্তর্ভুক্ত করে; লাদাখ সম্প্রসারিত হয়ে অপর তিনটি এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। ‘পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মির,’ ‘চীন-অধিকৃত কাশ্মির’ বা ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা’ও ভারতীয় মানচিত্রগুলোতে দেখা যায় না।
নতুন দুটি ভারতীয় ভূখণ্ড সৃষ্টির কথা বাদ দিলে এসব মানচিত্র বিস্ময়কর নয় : ভারত সবসময়ই সাবেক রাজন্য-শাসিত রাজ্যটির পুরো অংশ নিজের বলে দেখিয়েছে। অধিকৃত হোক বা না হোক, সবটুকুই ভারতের অখণ্ড অংশ, এমনকি যদিও ভারতীয়রা কখনো পাকিস্তান বা চীনা-নিয়ন্ত্রিত অংশে কখনো পা পর্যন্ত ফেলেনি।
তিনটি কারণে এসব নতুন মানচিত্র কৌতুহল সৃষ্টি করছে।
প্রথমত, জম্মু ও কাশ্মির মানচিত্রে জম্মু নগরীর চেয়ে শ্রীনগর নগরী অনেক ছোট অক্ষরে দেখা যাচ্ছে। এতে মনে হতে পারে যে কাশ্মির এখন জম্মুর চেয়ে কাশ্মির এখন কম গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মিরের এই মর্যাদা হ্রাস অনেক জম্মুবাসী ও ভারতীয়ের পছন্দের বিষয়। তবে এতে করে অনেক কাশ্মিরের মনে ভয় ঢুকে যেতে পারে এবং তারা প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারে।
লাদাখের মানচিত্রে চীন প্রজাতন্ত্র শব্দটি একবার দেখা যায়, কিন্তু একইসাথে প্রকাশিত ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে তা দেখা যাচ্ছে দুবার। লাদাখের মানচিত্রে চীন প্রজাতন্ত্র যেখানে লেখা হয়েছে, সেখানে থাকার কথা জিনজিয়ান শব্দটি। এই অঞ্চলটি বিশেষভাবে লেখা না হলেও জিজাংকে ‘তিব্বত স্বায়াত্তশাসিত অঞ্চল’ বলা হয়েছে। তবে এটি যে নিশ্চিতভাবেই ‘চীন প্রজাতন্ত্রের অংশ’ তা বলা হয়নি। ভারতীয়রা কি চীনকে সূক্ষ্মভাবে বলার চেষ্টা করছে যে তিব্বতের মর্যাদা অনিনিশ্চিত?
দ্বিতীয়ত, নতুন মানচিত্র প্রকাশের সময় প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে ১৯৪৭ সালের জম্মু ও কাশ্মিরে ১৪টি জেলা ছিল : কাঠুয়া, জম্মু, উধামপুর, রেইসি, অনন্তবাগ, বারামুল্লা, পুঞ্চ, মিরপুর, মোজাফফরাবাদ, লেহ ও লাদাখ, গিলগিট, গিলগিট ওজারাত, চিলহাস ও তিব্বত ভূখণ্ড। কিন্তু ১৯৪১ সালের আদমশুমারি ও ১৯৪৪ সালের জম্মু ও কাশ্মির রাজ্য প্রশাসন প্রতিবেদনে এই দাবি সমর্থিত নয়।
১৯৪৭ সালে ছোট চেনানি জাগির ছিল জম্মু প্রদেশের আলাদা সত্ত্বা। ১৯৪৭ সালে চিলাস (চিলহাস নয়) ছিল বৃহত্তর ফ্রন্টিয়ার ডিস্ট্রিক্ট প্রভিন্সের গিলটিগ এজেন্সির অংশ। আর তিব্বত ভূখণ্ড বলে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। অস্তোর জেলা্ ছিল এই বৃহৎ, কৌশলগত তাৎপর্যপূর্ণ প্রদেশের ন্যূনতম অংশ।
এগুলো বড় ধরনের ভুল বা বাদ নয়। তবে এতে এই বাস্তবতা ফুটে ওঠেছে যে ভারতীয়রা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা ‘অখণ্ড’ অংশগুলো সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞ। উদাহরণ হিসেবে সাবেক ফ্রন্টিয়ার ডিস্টিক্টের কথা বলা যেতে পারে। এর বেশির ভাগ অংশ এখন গিলগিট-বাল্টিস্তানের অংশ। খুব কম ভারতীয়ই এই এলাকা বা আজাদ কাশ্মির সম্পর্কে সামান্যই লিখে।
সবশেষে আসে জম্মু ও কাশ্মিরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা (পরে মহারাজা) গুলাপ সিংয়ের কথা। জাতিগতভাবে ডোগরা এই ব্যক্তিটি অবশ্যই খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ছেন। (হিন্দু হওয়ায় তাকে অবশ্যই পোড়ানো হয়েছিল, কবর দেয়া হয়নি)। ১৮৪৬ সালে তিনি অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে এই পদবিটি চিরকালের জন্য নিশ্চিত করেছিলেন। তার আওতায় থাকা এলাকর মধ্যে ছিল জম্মু, বালিটিস্তান ও লাদাখ (পরে এতে আকসাই চিন অন্তর্ভু্ক্ত হয়)।
ব্রিটিশরা ১৮৪৬ সালে শিখ সাম্রাজ্য থেকে জয় করা কাশ্মিরকে বিক্রি করেছিলেন উদ্দীপ্ত গুলাপ সিংয়ের কাছে। ফলে তিনি ও তার ছেলে আধুনিক জম্মু ও কাশ্মিরে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজন্য-শাসিত রাজ্যের মালিক হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অন্যতম মর্যাদাবান ও ধনী রাজা।
১৮৪৪ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত গুলাপ ও তার তিন বংশধর জম্মু ও কাশ্মির শাসন করেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ১৯৪৭ সালে এই রাজন্য-শাসিত রাজ্যের ৭৭ ভাগ ছিল মুসলিম। ফলে অনেকে বিশ্বাস করত যে এই রাজ্যের শেষ শাসক মহারাজা হরি সিংয়ের উচিত হবে পাকিস্তানে যোগ দেয়া। এর বদলে তিনি ভারতকে বেছে নিয়েছিলেন। তার প্রয়াসের ফলে ভারতীয় জম্মু ও কাশ্মির সরকার আনুষ্ঠানিকভঅবে ১৯৫২ সালের নভেম্বরে ডোগরা শাসনের অবসান ঘটায়। অবশ্য রাজ্যটি অব্যাহতভাবে অস্তিত্বশীল থাকে।
এখন ১৭৩ বছর পর মহারাজা গুলাপ সিংয়ের রাজ্যটির অস্তিত্ব নেই। তার কৃতিত্ব শেষ হয়ে গেছে। বিস্ময়ের ব্যাপর হলো, আর তা হয়েছে এই হিন্দু ব্যক্তির অর্জন ও ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল এক সরকারের মাধ্যমেই। মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মির সৃষ্টি ও প্রাধান্য বিস্তার করার মাধ্যমে গুলাপ সিং ১৮৪২ সালে চীনাদের কাছ থেকে আকসাই চিন দখল করেছিলেন। এর ফলেই বর্তমানে চীনা-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ভারতের দাবির ভিত্তি সৃষ্টির পাশাপাশি ডোগরাকে ভারতের সীমানা সম্প্রসারণকারী গুটিকতেক ভারতীয়ের একজনে পরিণত করেছে।
মনে হচ্ছে, ভারত এখন একই কাজ করছে মানচিত্র নতুন করে আঁকার ম্যামে। আর পাকিস্তান ও চীনের কাছ থেকে প্রতিবাদ প্রত্যাশা করছে।
দি ইন্টারপ্রিটার