মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে যা বলেছেন অমুসলিম মনীষীরা
মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে যা বলেছেন অমুসলিম মনীষীরা - ছবি : সংগ্রহ
হজরত মুহাম্মদ সা: বিশ্ব মানবতার অনুপম আদর্শ। ক্ষমা, দয়া, ধৈর্য, সহনশীলতা, মহানুভবতা ইত্যাদি গুণাবলি তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। শৈশব থেকে ওফাত পর্যন্ত তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য ছিল অনন্য। বিশ্ব ইতিহাসে তিনি এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ও আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ। তিনি বিশ্ববাসীর জন্য আশীর্বাদ, মহান আল্লাহর ভাষায় ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’। তিনি আরবের জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগের অবসানকারী ও মানবতার মুক্তির প্রকৃত দিশারি। ঐতিহাসিক মুইরের ভাষায়, ‘মুহাম্মদ যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাকে শুধু সে যুগের একজন মনীষী বলা যাবে না বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী।’
মহানবী সা: ছিলেন উত্তম আদর্শ-চরিত্রের অধিকারী। সততা-ন্যায়পরায়নতা, ধৈর্য-সাহসিকতা, ক্ষমা-সহনশীলতা, দয়া-উদারতা, সংযম-মহানুভবতা ইত্যাদি তাঁর চরিত্রের বিশেষ গুণাবলি। বাল্যকাল থেকেই মহানবী সা: ছিলেন সততায় উদ্ভাসিত। এ জন্য শৈশবে তাঁকে ‘আল আমিন’ বা বিশ্বস্ত বলে ডাকা হতো। কৈশোরেও তিনি ছিলেন সবার প্রিয়। ধর্ম প্রচারে তাঁর ত্যাগ ও নিষ্ঠা অতুলনীয়। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে সন্ধি-চুক্তি করে শান্তি স্থাপনে তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয়।
একান্ত বাধ্য বা আক্রান্ত না হলে যুদ্ধ না করা এবং শত্রুপক্ষের নারী-শিশু ও বেসামরিক লোকজনকে হত্যা না করা তাঁর প্রচলিত অসাধারণ যুদ্ধনীতি অনুকরণীয়। রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিনে কাফির কুরাইশদের তাঁর সাধারণ ক্ষমা বিশ্ব ইতিহাসে অতুলনীয়। মহানবী সা:-এর ক্ষমায় বিস্মিত হয়ে ঐতিহাসিক স্টেনলি লেনপুল লিখেছেন, ‘যে নগরীতে দীর্ঘ ১৫টি বছর তিনি ছিলেন অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার, তিনি এবং তার সঙ্গী-সাথীরা নির্মমভাবে বহিষ্কৃত, সেই শহরে যখন তিনি বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করছিলেন, সেটা ছিল যেমন চমকপ্রদ, তেমনি অকল্পনীয়’ (স্টেনলি লেনপুল, স্টাডিজ ইন মক্কা)। ইতিহাসবিদ লক্ষ্মণ প্রাসাদ মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী সা:-এর অসাধারণ ক্ষমা ও উদারতা প্রসঙ্গে লিখেন, ‘মক্কার পরাজিত শত্রুদের সাথে মুহাম্মদ অচিন্তনীয় দয়া-দাক্ষিণ্য এবং উদারতার সাথে আধুনিককালের মানবাধিকার দাবিদারদের আচরণ মিলিয়ে দেখা যেতে পারে’ (স্বামী লক্ষ্মণ প্রসাদ, আরব কা চান্দ, লাহোর সংস্করণ)।
হজরত মুহাম্মদ সা: আদর্শ স্বামী ছিলেন। তিনি স্ত্রীদের অধিকার যথাযথভাবে পালন করেছেন। ২৫ বছর বয়সে ৪০ বছর বয়সী বিধবা হজরত খাদিজাকে বিয়ে করে নারী মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তৎকালীন অবহেলিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত নারী জাতির বৈবাহিক মর্যাদা দান, দেনমোহর নির্ধারণ, স্ত্রীর ভরণ-পোষণ, সম্পদ-সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী অংশ নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে নারীদের অধিকার প্রদান এবং নারী জাগরণ-উন্নয়নে হজরতের আদর্শ প্রশংসিত হয়েছে। মনীষী পিকরে ক্রাবাইটের ভাষায়, ‘মুহাম্মদ সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে নারী অধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন।’
শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে তাঁর আদর্শ অনুকরণীয়। সামাজিক দায়িত্ব পালন, অতিথি আপ্যায়ন ও আর্ত-পীড়িতের সেবা, প্রতিবেশী-আত্মীয় স্বজনদের সাথে সদাচারণ ইত্যাদি তাঁর সামাজিক কর্মকাণ্ড সবার জন্য অনুসরণীয়। সবার অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন আন্তরিক ও যত্নশীল। দাস-কৌলিন্য প্রথার উচ্ছেদ, বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ, বিত্তশালী ও বিত্তহীনদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টনব্যবস্থা প্রবর্তন করে সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হজরত মুহাম্মদ সা: অনুকরণীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ও ইসলামী আদর্শের ভূয়সী প্রশংসা করে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, ‘মুহাম্মদের ধর্মই আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয়’। তিনি আরও বলেন, ‘আমি আশা করি, সে সময় খুব দূরে নয়, যখন সব দেশের বিজ্ঞ ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের একতাবদ্ধ করতে এবং কুরআনের যে নীতিগুলো একমাত্র সত্য ও যে নীতিগুলো মানুষকে স্বস্তির পথে পরিচালিত করতে পারে সেসব নীতির ওপর ভিত্তি করে সাম্যভিত্তিক এক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।’
রাষ্ট্রব্যবস্থায় হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন উদারনৈতিক। রাষ্ট্রে বসবাসকারী সব নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান তাঁর নীতি। এ কারণে মদিনায় প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থায় ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিকসহ সব ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। ধর্ম-বর্ণের ভিত্তিতে নয় বরং আইনের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার করাই ছিল তাঁর বিচার পদ্ধতি। এ জন্য তিনি সম্ভ্রান্ত কিংবা নিকৃষ্ট হিসেবে জাতিকে বিভাজিত করেননি। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
মহানবী সা:-এর বিচারব্যবস্থার ভূয়সী প্রসংসা করে মনীষী বার্ক লিখেছেন, ‘মুসলিম আইন মুকুটধারী সম্রাট হতে সামান্যতম প্রজা পর্যন্ত সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এটা এমন একটি আইন যা জগতের সর্বোত্তম জ্ঞানানুমোদিত, পাণ্ডিত্যপূর্ণ এবং সর্বোৎকৃষ্ট আইনশাস্ত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’
ধর্মীয় সহনশীলতা-উদারতায় হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন অনন্য। মদিনায় ইহুদি, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকদের সাথে সন্ধিপত্র সম্পাদন করে অসাধারণ ধর্মীয় সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। অধিকন্তু নাজরান থেকে আগত খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মদিনা মসজিদে আশ্রয় ও ধর্ম পালনের অনুমতি দিয়ে যে ধর্মীয় উদারতা দেখিয়েছেন, বিশ্বের ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। ‘সমগ্র মানব জাতি এক আদমের সন্তান’ ঘোষণা দিয়ে তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সব মানুষকে বিশ্ব ভাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। তাঁর অনুপম চারিত্রিক মাধুর্যে আকৃষ্ট হয়ে অনেক কাফির তাঁকে হত্যা করতে এসে মুসলিম হয়েছেন, অনেক চরম শত্রু পরম বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। অনেক অমুসলিম মনীষী হজরতের চরিত্র-আদর্শে মুগ্ধ হয়ে উচ্ছ্বসিত প্রসংশা করেছেন।
জর্জ বার্নার্ড শ’ বলেছেন, ‘আমি সবসময় মুহাম্মদের ধর্মকে উচ্চ মর্যাদা দিয়েছি এর আশ্চর্য জীবনীশক্তির জন্য। এটিই একমাত্র ধর্ম, পরিবর্তনশীল দুনিয়ার সাথে যার খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা আছে বলে আমার মনে হয়। আর এ ধর্ম সর্বযুগেই সমাদৃত হতে পারে। আমি এ বিস্ময়কর লোকটিকে বুঝতে চেষ্টা করেছি এবং আমার মতে, তিনি অ্যান্টি-ক্রাইস্ট তো ননই বরং তাঁকে মানবজাতির ত্রাণকর্তা বলা উচিত। আমার বিশ্বাস, তাঁর মতো একজন মানুষ যদি বর্তমান বিশ্বের একনায়ক হতেন, তাহলে তিনি এ সমস্যাগুলোর এমন সমাধান দিতে সক্ষম হতেন, যা পৃথিবীতে শান্তি ও সুখ এনে দিত।
মুহাম্মদের ধর্মের ব্যাপারে আমি এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, এটি যেমন বর্তমান ইউরোপে গ্রহণযোগ্য হতে শুরু করেছে, তেমনি আগামী দিনের ইউরোপেও তা গ্রহণযোগ্য হবে’ (জর্জ বার্নার্ড শ’, দ্য জেনুইন ইসলাম, সিঙ্গাপুর, ভলিউম-১, ১৯৩৬)। মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল এইচ হার্ট তার দ্য হান্ড্রেড অ্যা র্যাংকিং অব দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েনসিয়াল পারসন ইন হিস্টোরি গ্রন্থে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘মুহাম্মদ তাঁর ২৩ বছরের আন্দোলনে আরবের একটি অসভ্য ও বর্বর জাতিকে একটি সভ্য ও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেছিলেন। ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ উভয়পর্যায়ে চরমভাবে সফলকাম ছিলেন। ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার এই অভূতপূর্ব ও নজিরবিহীন সংমিশ্রণই তাঁকে ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ব্যক্তিরূপে পরিচিত করে।’ এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকা গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘জগতের মধ্যে সর্ব ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনিই (মুহাম্মদ সা:) হলেন সর্বাপেক্ষা সফলকাম।’
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:কে সব নবী-রাসূলদের নায়ক আখ্যা দিয়ে মহামতি কার্লাইল ১৮৪০ সালে এডিনবার্গে এক সভায় ঘোষণা করেন, “শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, ঈশ্বর প্রেরিত দূত বা নবীদের মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মধ্যেও ‘নায়ক’-এর স্থান অধিকার করে রয়েছে সুদূর আরবের উটচালক নবী মুহাম্মদ।” অধিকন্তু তিনি মহানবীর দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণাবলিতে আকৃষ্ট হয়ে On Heroes, Hero-worship and Heroic, in History: The Hero as Prophet’ শিরোনামে প্রদত্ত ভাষণে তিনি মহানবী সা:কেই সব নবী ও রাসূলদের মধ্যে (Prophets and Apostles) মধ্যে Hero হিসেবে অভিহিত করেন। তার অনুপম ভাষায়, ‘জগতের আদিকাল থেকে এ আরবজাতি মরুভূমির মধ্যে বিচরণ করে বেড়াত এক অজ্ঞাত, অখ্যাত মেষপালকের জাতি হিসেবে। তারপর তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে এমন একটি বার্তাসহ সেখানে এক ধর্মবীর পয়গম্বর প্রেরিত হলেন, আর অমনি ম্যাজিকের মতো সেই অখ্যাত জাতি হয়ে উঠল জগদ্বিখ্যত, দ্বীনহীন জাতি হয়ে উঠল জগতের শ্রেষ্ঠ। তারপর এক শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিমে গ্রানাডা থেকে পূর্বে দিল্লি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হলো আরবের আধিপত্য।
সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে পৃথিবীর এক সুবৃহৎ অংশের উপর আরবদেশ মহাসমারোহ ও বিক্রমের সাথে তার দ্যুতি ছড়িয়েছে।’ মনীষী আলফ্রেড দ্য লা মার্টিনের অমর উক্তি, ‘দার্শনিক, বাগ্মী, ধর্মপ্রবর্তক, আইন প্রণেতা, মতবাদ বিজয় এবং প্রতিমাবিহীন উপাসনা পদ্ধতির পুনঃস্থাপক, ২০টি পার্থিব সাম্রাজ্যের এবং ধর্ম-সাম্র্রাজ্যের সংস্থাপক কর্তা মুহাম্মদ।’ এ ছাড়া অনেক মনীষী মহানবীর চারিত্রিক মাধুর্যের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন এবং তাঁর অনুপম চরিত্র বিশ্লেষণ করে ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
dmasobur09@gmail.com