কোন পথে হাঁটবেন মোদি?
মোদি - ছবি : সংগৃহীত
বহু-জোটের ধারা অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার ২০১৪ সালে প্রথম মেয়াদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বড় ও মধ্য শক্তিগুলোর সাথে নিরাপত্তা ও সেইসাথে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছে। এই নীতিগত কৌশল এই ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে কোনো বিশেষ শক্তির ওপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীল হওয়ার ফাঁদ এড়িয়েই নিজের ব্যবসায়িক ও সেইসাথে নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে, কৌশলগত স্বায়াত্তশাসন বজায় রাখতে পারবে। অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্র-চীন সঙ্ঘাত ও যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে এটি একটি জটিল ভারসাম্যমূলক কাজ।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ কৌশল উপস্থাপন করেছে এবং বিআরআইয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন তার অবস্থান জোরদার করায় ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মধ্যমে আমেরিকা তার নীতি এগিয়ে নেতি থাকায় নতুন একটি মহা খেলার দৃশ্যপটের আবির্ভাব ঘটেছে। ওবামা ও ট্রাম্প প্রশাসনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে আমেরিকান এশিয়া-প্যাসিফিক (পরে এর নাম হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক) স্ট্র্যাটেজির জন্য ভারতের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেইজিংয়ের বিআরআই ও সামুদ্রিক কৌশলের মাধ্যমে ভারতের কৌশলগত পরিমণ্ডলে চীনের হানা দেয়া নিয়েও নয়া দিল্লি উদ্বিগ্ন।
অবশ্য, কৌশলগত স্বায়াত্তশাসনের জন্য ভারতের আকাঙ্ক্ষার কথা ঘোষণা করে ২০১৮ সালের ১ জুন শাঙগ্রি-লা ডায়ালগে মোদির বক্তৃতায় স্পষ্ট করে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে কোয়াডের অন্যান্য সদস্যের (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার) উদ্দেশ্যের অংশীদার হওয়া ও প্রধানত চীনা প্রভাব দমনের জন্য চার জাতি ফরমেটকে শক্তিশালী করার ধারণায় নয়া দিল্লি অনীহ। বাণিজ্য ও নৌচলাচলের জন্য একটি উন্মুক্ত ও অবাধ ভারত মহাসাগর বজায় রাখার লক্ষ্যে ইন্দো-প্যাসিফিক পলিসিতে রাশিয়া, আসিয়ান সদস্যবর্গ ও চীনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে ভারত।
অন্যদিকে ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ২+২ বৈঠকের সময় দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যাধুনিক নিরাপত্তা যোগাযোগ সরঞ্জাম লাভ নিশ্চিত করা ও গোয়েন্দা তথ্যের ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্লাটফর্ম সুবিধা দিতে কমিউনিকেশন্স কম্পাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট (সিওএমসিএএসএ) নামে পরিচিত প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই করে। এই চুক্তির ফলে ভারত মহাসাগর ও হিমালয় অঞ্চলে চীনা গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে ভারত সক্ষম হবে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।
ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিবিষয়ক আলোচনা ও অভিন্ন দৃষ্টিকোণ নিয়ে বিপুল সময় প্রদান ছাড়াও দুই দেশ সংলাপকালে তিন বাহিনীর মধ্যে সামরিক মহড়া চালাতেও সম্মত হয়। এই পরিবর্তনশীল দৃশ্যপটে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির প্রতি ভারত দ্ব্যর্থহীন সমর্থন না দিলেও ভারতের মার্কিনমুখী অবস্থান নিয়ে চীনা সংশয়ের অবসান ঘটেনি।
ভারসাম্যপূর্ণ কৌশলের জন্য প্রয়োজন জটিল ব্যবস্থা। দোকলাম অচলাবস্থার পর ওহানে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সম্মেলনের ফাঁকে বৈঠক এবং সম্প্রতি চেন্নাইয়ের মামলাপুরমে বৈঠকে চীন ও ভারত সমঝোতার একটি মাত্রায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করলেও তাদের সম্পর্কে এখনো সংশয় বিরাজ করছে। কাশ্মির ও সন্ত্রাসবাদের মতো ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে চীনের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দুই দেশের মধ্যকার বিরোধ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া পরমাণু সরবরাহ গ্রুপে চীনের সদস্যপদ, জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদে বেইজিংয়ের দীর্ঘ দিন ধরে আপত্তিও তাদেরকে কাছাকাছি আনার পথে বাধা হয়ে আছে।
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের কৌশলগত অংশীদারিত্বের কারণে ইন্দো-রাশিয়া সম্পর্কও শীতল হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ার পাকিস্তান ও চীনের প্রতি ঘনিষ্ঠ হওয়ার রেশ ধরে পাকিস্তানের সাথে কয়েকটি কৌশলগত সহযোগিতার কারণে ভারত উদ্বিগ্ন হয়েছে। আবার ভারতের ইন্দো-রুশ সম্পর্কে গতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ও এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র চুক্তির কারণে ভারতের মাথার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার খড়গ ঝুলে আছে। ভারত এখনো সরঞ্জাম ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। কারণ দেশটির বেশির ভাগ প্রতিরক্ষা ক্রয় হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ও অস্ত্র সংগ্রহের নয়া দিল্লির বর্তমান উদ্যোগের মধ্যেও রাশিয়ার সাথেও একই ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি ভোলেনি ভারত। গত সপ্তাহে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংলাপে ভারতের কোণঠাসা ও নিঃসঙ্গ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে স্পুটনিক খবর দিয়েছে যে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ বলেছেন যে আফগান আলোচনার জন্য রাশিয়া-চীন-যুক্তরাষ্ট্র ফরম্যাটে ইরানের যোগদানের ব্যাপারে মস্কোর আগ্রহ রয়েছে। তিনি বলেন, আফগানিস্তান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের আলোচনা হয়েছে। রাশিয়া-চীন-যুক্তরাষ্ট্র ফরম্যাটে পাকিস্তান যোগ দিয়েছে। এই ফরম্যাটে ইরানের যোগদানের আগ্রহ রয়েছে। এটা সম্ভাবনাময়।
ভারতের কৌশলগত স্বায়াত্তশাসন তার বাণিজ্যে সুবিধা দেবে এবং চীন-ভারত সহযোগিতা চলমান যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। অবশ্য একে টেকসই ভারত-চীন সম্পর্ক হিসেবে অভিহিত করা যায় না। কারণ ভারতের ভারসাম্যপূর্ণ কাজটিতে সঙ্ঘাতের সময় উভয়কেই সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে পরিচালিত। ভারতের ব্যবসায়িক স্বার্থের দিক থেকে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো এই যে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বাণিজ্য ও অভিবাসনের মতো ক্ষেত্রে নয়া দিল্লির ওপর কঠোরতা আরোপ করতে দ্বিধা করছে না। এটা হয়তো চীন ও রাশিয়া প্রশ্নে মার্কিন কৌশলের প্রতি ভারতের দোলাচলের পরিণাম।
আবার জাপানের মতো মধ্যম শক্তির সাথে ভারতের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়ে থাকে তার নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রশমন ও চীনকে তার পরিমণ্ডলে সংযত রাখার প্রয়োজন হিসেবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি কতটা ফলপ্রসূ হয়, তার ওপর নির্ভর করছে ভারত-জাপানের ঘনিষ্ঠতা।
এদিক আসিয়ানের ১০ সদস্য এবং জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয় ও নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে গঠিত বাণিজ্য চুক্তি রিওজিন্যাল কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের (আরসিইপি) অংশ না হওয়ার নয়া দিল্লির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি ও আঞ্চলিক ও পররাষ্ট্রনীতিতে তার শক্তি। এই পদক্ষেপ ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতির অপরিণত সম্ভাবনার ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
এশিয়া টাইমস