ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাত : স্বর্গের অধিবাসীদের নরকবাস
ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাত : স্বর্গের অধিবাসীদের নরকবাস - ছবি : সংগৃহীত
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরের নিলাম উপত্যকার মনোরম জুরা শহর গিজগিজ করার কথা পর্যটক আর প্রকৃতিপ্রেমীতে।
অথচ এর ২০ হাজার অধিবাসী বাস করছে ভয় আর হতাশায়। কারণ জম্মু ও কাশ্মিরকে বিভক্তকারী নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পাকিস্তানি ও ভারতীয় সৈন্যরা অব্যাহতভাবে গুলি বিনিময় করছে।
আগে উত্তেজনার সময় সৈন্যরা ছোট অস্ত্র ব্যবহার করত। কিন্তু ৫ আগস্ট ভারতের এই অঞ্চলের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর উভয় পক্ষ তাদের অবস্থান এগিয়ে এনে মর্টার, শেলসহ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে। আর এসব গোলা প্রায়ই বিভক্তকারী রেখার উভয় পাড়ের গ্রামগুলোতে বসবাসকারীদের ওপর পড়ছে।
আনাদুলু এজেন্সি নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছাকাছি থাকা জুরা, শাহকোট ও নৌসেরি গ্রামগুলো সফর করে। নিলাম নদীর (কিশানগঙ্গা নামেও পরিচিত) পাড়ে থাকা লোকজনের জীবনযাত্রা অনিশ্চয়তায় ভাসছে। খেতের পাকা ফসল তোলার বদলে লোকজন জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত বাংকার আর ট্রেঞ্চ বানাতে। দোকানপাটগুলোও ফাঁকা।
তাদের কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামে ফেলা খেলনা বোমা। এগুলো সেখানকার শিশুদের ওপর বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। নয়া দিল্লি খেলনা বোমা ফেলার কথা অস্বীকার করলেও স্থানীয়রা বলছে, তারা ভারতীয় অবস্থানের সামনে রাস্তার পাশে এ ধরনের বিস্ফোরক দেখতে পেয়েছে।
গত মাসে চিলান এলাকায় রাস্তার পাশে পড়ে থাকা এ ধরনের একটি খেলনা বোমা ধরতে গিয়ে এক শিশু নিহত ও তিনজন আহত হয়েছে। স্থানীয়রা বলছে, খেলনাটি শিশুটির হাতে সাথে সাথে বিস্ফোরিত হয়।
নিলাম জেলার নির্বাহী প্রধান রাজা মাহমুদ শহিদ আনাদুলু এজেন্সিকে বলেন, আমরা লোকজনকে বলেছি, রাস্তার পাশে যখনই তারা খেলনা বোমা দেখতে পাবে, সাথে সাথে তারা যেন পুলিশকে জানায়। তাদেরকে ওই খেলনা স্পর্শ করতেও বারণ করা হয়েছে।
ভারতীয় গোলার ভগ্নাবশেষ সেখানের সব জায়গায় দেখা যায়। দূর থেকে অত্যন্ত সুরক্ষিত ভারতীয় চৌকিগুলোও দেখা যায। আর সীমান্তের উভয় পাশের গ্রামগুলো ফাঁকাই মনে হবে।
স্কুলে বোমা
ব্যবসায়ী ও স্থানীয় রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট রশিদ (৫৮) আনাদুলু এজেন্সিকে বলেন, গোলাবর্ষণ শুরু হলে আমরা আমাদের বাড়ির অস্থায়ী বেসমেন্টে চলে যাই।
তার নিজের বাড়িও পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। তিনি জঞ্জালের স্তুপ দেখিয়ে বলেন, এটা ছিল আমাদের পারিবারিক বাড়ি। আমরা দুই ভাই থাকতাম এখানে।
তিনি বলেন, গোলায় স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ও পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।
স্থানীয় শিক্ষা অফিসার খাজা মানশা বলেন, রাতে বোমা নিক্ষেপের সময় স্কুলে কোনো শিক্ষার্থী ছিল না। তবে তবে রেকর্ডপত্র ও আসবাবপত্র পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এখানে কোনো যুদ্ধ নেই, তবে আমরা যুদ্ধের মতো অবস্থায় বাস করছি।
মর্টারের আঘাতেও অনেক দোকান ও একটি ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আসবাবপত্র ব্যবসায়ী পিরজাদা কাসিম শাহ বলেন, আমার ৫০ লাখ রুপির ব্যবসা ছিল। এখন কর্পদশূন্য।
মির ইমতিয়াজের (৫২) বাড়িটিও বিধ্বস্ত হয়েছে। এই দিনমজুর বলেন, আমি খুবই গরিব মানুষ। অনেক কষ্টে স্থানীয় বাজারে কাজ করে স্ত্রী আর ৫ সন্তানের ভরণপোষণ করছি।
স্থানীয় প্রশাসনের মতে, ২০ অক্টোবর ভারতীয় গোলাবর্ষণে ১৬৫টি বাড়ি, ৩৮টি দোকান, তিনটি স্কুল ও ১৫টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাজা শহিদ বলেন, নিহত পরিবারগুলোতে মাথাপিছু ১০ লাখ রুপি ও আহতদের ৫ লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সরকার।
বেশির ভাগ লোক তাদের বাড়িতে ছোট বাংকার তৈরী করেছে। এর মাধ্যমেই তারা জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করে।
শহিদ বলেন, সরকার এলাকাভিত্তিক বাংকারও নির্মাণ করছে, যাতে তারা ভারতীয় গোলাবর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে পারে। আমরা প্রায় ২০টি বাংকার নির্মাণ করেছি।
যুদ্ধবিরতি তদারকির কোনো ব্যবস্থা নেই
প্রায় দেড় বছর অচলাবস্থার পর ২০০৩ সালের নভেম্বরে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু তা তদারকির কোনো ব্যবস্থা নেই।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত ২,২২৯ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। তাদের গোলায় ৪২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ১৬৯ জন আহত হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, পাকিস্তান ২০১৯ সালে ২,০৫২ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। এতে ২১ বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৪৮ সালে ভারত ও পাকিস্তানে সামরিক পর্যবেক্ষক গ্রুপ (ইউএনএমওজিআইপি) মোতায়েন করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান এলাকায় এই গ্রুপের কেউ নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ রেখায় যেতে পারে না।
আর ভারত মনে করে, ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তির পর এর ম্যান্ডেট শেষ ঞয়ে গেছে। শ্রীনগর, মোজাফফরাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি ও নয়া দিল্লিতে এই গ্রুপের অফিস রয়েছে।
আনাদুলু এজেন্সি