উত্তাল জাবি : কী হবে ভিসির?
উত্তাল জাবি : কী হবে ভিসির? - ছবি : সংগৃহীত
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণার পর হল ত্যাগের যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা মানতে রাজি নয় ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, হঠাৎ করে হল বন্ধের ঘোষনায় রাজশাহী, খুলনা, বরিশালের মতো দূরবর্তী অঞ্চলগুলোর শিক্ষার্থীরা চাইলেও এতো অল্প সময়ের মধ্যে হল ত্যাগ করতে পারবে না। এজন্য তারা বিক্ষোভ মিছিল করে প্রশাসনকে হঠাৎ বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবি জানিছেন। মেয়েদের খালেদা জিয় হল ও নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের মেয়েরা ভ্যাকান্ডকে (হল বন্ধের সিদ্ধান্ত) প্রত্যাখ্যান করে হলে থাকার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
এর আগে দুর্নীতির অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অপসারণ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১২ টা থেকে সোয়া বারোটা পর্যন্ত ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থানরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটে। প্রথমে ছাত্রলীগ ট্রান্সপোর্ট থেকে একটি মিছিল নিয়ে আন্দোলনরতদের ওপর অতর্কিত হামলা করে। এতে ৮ শিক্ষকসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হয়েছে। এছাড়া দায়িত্ব পালন করার সময় চার সাংবাদিককেও মারধর করে আহত করেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। আহতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
গুরুতর আটজনকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে বলে জানান জাবির চিকিৎসক ডা. রেজওয়ানুর রহমান। আহত শিক্ষকরা হলেন- অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস, মীর্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্যাপক রায়হান রাইন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদ, অধ্যাপক শামীমা সুলতানাসহ আরো কযেকজন।
মারধরে আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে-৪৪ তম আবর্তনের দর্শন বিভাগের মারুফ মোজাম্মেল, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাহাথির মুহাম্মদ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাইমুম ইসলাম, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের রাকিবুর রনি,ইংরেজি বিভাগের আলিফ মাহমুদ,অর্থনীতি বিভাগের উল্লাস, দর্শন বিভাগের রুদ্রনীল, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সৌমিক বাগচীসহ আরো কয়েকজন শিক্ষার্থী। এছাড়া ৪৪তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ছাত্রী ছন্দা ও ৪৭ ব্যাচের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাউদা নামের দুই নারী শিক্ষার্থীকেও মারধর করতে দেখা গেছে।
হামলায় আহত সাংবাদিকরা হলেন- প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মাইদুল ইসলাম, বার্তা টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি আজাদ, বার্তাবাজারের প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন হিমু, বাংলা লাইভ টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি আরিফুজ্জামান উজ্জল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভিসি অপসারণ দাবিতে সোমবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে ভিসির বাসভবন ঘেরাও করেছে রেখেছিলেন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর। বেলা সোয়া ১১টায় ভিসিপন্থী শিক্ষক-কর্মকর্তারা ভিসিকে বাসা থেকে বের করে তার কার্যালয়ে নিয়ে যেতে আসেন। এসম ভিসি সমর্থক শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের সাথে উত্তপ্ত বাক-বিতন্ডা চলতে থাকে। এর মধ্যেই পৌনে ১২টার দিকে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানার নেতৃত্বে একটি মিছিল নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে আন্দোলনকারীদের এলোপাথারি মারধর করতে শুরু করে। ছাত্রলীগ কর্মীরা এলোপাথারি শিক্ষার্থীদের লাথি-কিল-ঘুষি দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসময় ছাত্রলীগ কর্মীদের একাধিক শিক্ষকসহ কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে কোলে নিয়ে দূরে ফেলতে দেখা যায়। এসময় ছাত্রলীগ কর্মীদের কিছু দেশীয় অস্ত্র বহন করতে দেখা যায়।
মারধরের সময় ভিসি সমর্থক শিক্ষক সোহেল আহমেদ, নাসির উদ্দিন, আতিকুর রহমান, আব্দুল মান্নান চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, মাহমুদুর রহমান জনি সহ কয়েকজনকে ‘ধর ধর’, ‘জবাই কর’ ও ‘মার মার’ বলে চিৎকার করতে দেখা গেছে। এসময় বাসভবনের সামনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ছাত্রলীগের মারধরের বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষক পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খবির উদ্দিন বলেন,‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এরকম ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। ভিসিপন্থী শিক্ষকদের উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ উস্কানিতে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ছাত্রলীগ যখন আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে তখন ভিসিপন্থী শিক্ষকরা তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে হাততালি দিয়েছে।’
হামলার বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন,‘আমরা শিবিরমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ আছে। আমরা কোউকে মারিনি। আমরা শুধু অবস্থান করেছি।
হামলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ.স.ম. ফিরোজ-উল-হাসান বলেন,‘ঘটনাস্থলে মব তৈরি হয়েছিল। চেষ্টা করেও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। বড় ঘটনা এড়াতে আমরা তৎপর আছি।’
মারধরের ঘটনার আধাঘন্টা পর বাসভবনের গেইট ফাঁকা হলে ভিসি ফারজানা ইসলাম তার সমর্থক শিক্ষকদের সাথে নিয়ে তার কার্যালয়ে যান। কার্যালয়ের সামনে ভিসি সংবাদ সম্মেলনে বলেন,‘আমার সহকর্মী ও ছাত্রলীগ কর্মীদের এ গণঅভ্যুত্থানের জন্য ধন্যবাদ। ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে প্রশ্ন করলে ভিসি বলেন,‘ছাত্রলীগ এতদিনে ছাত্রত্বের পরিচয় দিয়েছে। আমরা ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ জানাই।’
এরপর দুপুরে এক সিন্ডিকেট সভা ডেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন এবং হলগুলোকে ভ্যাকান্ড(খালি) করতে বলা হয়। বিকাল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে সকলকে হল ছাড়তে বলা হয়।এই ঘোষণার পরে আবারও উত্তাল হয়ে পড়ে জাবি ক্যাম্পাস। আন্দোলনকারীরা এই বন্ধ ঘোষণাকে দুর্বলতার পরিচয় দাবি করে সমগ্র ক্যাম্পাসে মিছিল করে। পরে ক্যাম্পাসের বাস আটকানোর চেষ্টা করে।
এদিকে হল ভ্যাকান্ড হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বন্ধের বিষয়ে মেয়েদের হলগুলো বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। তারা বিক্ষোভ মিছিল করে এবং প্রশাসনকে হঠাৎ বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বলে। মেয়েদের খালেদা জিয় হল ও নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের মেয়েরা ভ্যাকান্ডকে প্রত্যাখ্যান করে হলে থাকার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এদিকে জাবিতে আন্দোলনে হামলার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ বিক্ষোভের তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে জাবিতে আন্দোলনে হামলার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ বিক্ষোভের তথ্য পাওয়া গেছে।