বঙ্গোপসাগর নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র-মিয়ানমার-ভারত সমীকরণ
বঙ্গোপসাগর নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র-মিয়ানমার-ভারত সমীকরণ - ছবি : সংগ্রহ
চীন মিয়ানমার ও বঙ্গোপসাগর
চীন বা গণচীন নামক বিশাল রাষ্ট্রটি যদি বাংলাদেশ থেকে বেশি সুবিধা আদায় করতে না পারে, অথবা বাংলাদেশ থেকেও বেশি সুবিধা যেই দেশটি থেকে আদায় করতে পারবে, সেই দেশের সাথেই তার বন্ধুত্বকে গভীর ও নিবিড় করবে। এরকম একটি দেশের নাম মিয়ানমার। মিয়ানমারের সর্ব পশ্চিমের প্রদেশটির নাম রাখাইন প্রদেশ। এই রাখাইন প্রদেশের আগের নাম ছিল আরাকান। এই রাখাইন প্রদেশে দুই প্রকারের জনগোষ্ঠী ছিল এবং আছে। একপ্রকারের জনগোষ্ঠী হলো রোহিঙ্গা যারা দেখতে বাঙালিদের মতো এবং যাদের ভাষা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের চট্টগ্রামের ভাষার মতো। সাবেক আরাকান ও বর্তমানের রাখাইন প্রদেশের পশ্চিম সীমান্তের একটি অংশ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের বান্দরবান জেলার সাথে মিলে যায়। এই অঞ্চলটি পার্বত্য ও গভীর জঙ্গলে ভরা। অতএব পার্বত্য চট্টগ্রামের তথা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের নিরাপত্তার জন্য, বাংলাদেশকে অবশ্যই রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশের দিকে নজর রাখা উচিত; যদিও যথেষ্ট নজর রাখা সম্ভব হয়নি। রাখাইন প্রদেশের সাথেই হলো বঙ্গোপসাগর। অতএব চীন যদি এই বঙ্গোপসাগরের পানি, সামরিক বা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করতে চায়, তাহলে অবশ্যই একটি বন্ধুপ্রতীম রাখাইন প্রদেশ লাগবে। বন্ধুপ্রতীম রাখাইন মানে, বন্ধুপ্রতীম মানুষ ও বন্ধুপ্রতীম ভূমি। এবং রাখাইন প্রদেশ যেহেতু মিয়ানমারের ভূখণ্ড, অতএব এই বন্ধুত্ব প্রদানের দায়িত্ব মিয়ানমারের ঘাড়েই পড়ে। রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশ থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বিতাড়ন করে দেয়ার প্রেক্ষাপট কিছুটা হলেও এই প্রয়োজনীয়তার সাথে জড়িত।
আমেরিকা-চীন-ভারত-বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর
পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আমেরিকা। আমেরিকা ও চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে আমেরিকা ও চীন উভয়েই যুগপৎ পাকিস্তানের ও বাংলাদেশের বন্ধু। বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতায় আমেরিকা একটু পিছিয়ে আছে; ভারত ও চীন একটু এগিয়ে আছে। আমেরিকা ও চীন আন্তর্জাতিক প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতিযোগী ও পরস্পরের প্রতি বৈরী। আমেরিকা ও ভারত কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতিযোগী এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি সম্পূরক।
প্রতিযোগী হলেও সেটা লোপ্রোফাইল। আর সম্পূরকতার প্রসঙ্গে প্রধান ক্ষেত্র হলো চীনকে কেন্দ্র করে। চীন ও ভারত যেহেতু বৈরী এবং চীন ও আমেরিকা যেহেতু বৈরী, তাহলে আমেরিকা ও ভারত বন্ধু হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা কী? বাংলাদেশের ভূমিকা হলো, আমেরিকার জন্য একটি অবস্থান সৃষ্টি করা, কারণ বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী। বাংলাদেশের ভূমিকার আরো কারণ আছে। হাজার হাজার বললে ভুল, লাখ লাখ বাঙালি আমেরিকায় থাকে, লেখাপড়া করে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে।
ওই সব বাঙালি আমেরিকার ভূখণ্ডে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। আমি নিজেও এক বছর মেয়াদি সামরিক উচ্চশিক্ষা নিয়েছি আমেরিকায়। জাতিসঙ্ঘের সদর দফতর আমেরিকাতে অবস্থিত। জাতিসঙ্ঘের অধীনে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ প্রচণ্ড অবদান রাখে এবং জাতিসঙ্ঘের এইরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য পরিমাণে অনেক বড়।
বাংলাদেশ ও আমেরিকার সম্পর্কের সাথে কিছুটা সম্পৃক্ত হলো বাংলাদেশ ও ইউরোপের সম্পর্ক কারণ, ইউরোপের প্রধান দেশগুলো যথা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ও জার্মানি আমেরিকার ঘনিষ্ঠ। মুসলিম বিশ্বের ভৌগোলিক ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্রভূমি হলো সৌদি আরব এবং সৌদি আরব হলো আমেরিকার ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে আমেরিকার ভূমিকা যেমন আছে তেমনই, বাংলাদেশ-আমেরিকা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সৌদি আরবের ভূমিকা আছে। অতএব আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯১ সালের এপ্রিল-মে মাসের কথা। ২৯ এপ্রিল ১৯৯১ তারিখে, বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশে মারাত্মক রকমের একটি ঘূর্ণিঝড় আক্রমণ করেছিল। সেই সময় বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মহল থেকে সাহায্য আহ্বান করেছিল। ৯১-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে আমেরিকা, কুয়েত মুক্ত করার জন্য ও সাদ্দাম পতনের জন্য, ইরাক আক্রমণ করেছিল।
সেই সময় পারস্য উপসাগরে ও আরব সাগরে আমেরিকার নৌবাহিনীর ও মেরিন কোরের জনশক্তি ও জাহাজ মোতায়েন করা হয়েছিল। যুদ্ধের পর মেরিন কোরের জনশক্তি ও জাহাজ, আরব সাগর থেকে তাদের স্থায়ী ঠিকানা জাপান উপকূলে ফেরত যাচ্ছিল। তারা যখন শ্রীলঙ্কার কাছাকাছি ছিল, তখন বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় হয়। বাংলাদেশের আহ্বানে ওই মেরিন কোরের একটা অংশকে বাংলাদেশের ত্রাণ তৎপরতায় মোতায়েন করা হয়েছিল।
এটা বন্ধুত্বের লক্ষণ ছিল। আবার এটাও উদ্ভাসিত হয়েছিল যে, বঙ্গোপসাগর যদি সামরিক দৃষ্টিতে নিরাপদ না হয়, তাহলে আমেরিকার চলাচল অসুবিধা হবে। অতএব বঙ্গোপসাগরকে বন্ধুপ্রতীম রাখতে হলে আমেরিকা ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব প্রয়োজন। উপরের অনেক অনুচ্ছেদে আমি বাংলাদেশ-ভারত ও বাংলাদেশ-চীন প্রসঙ্গে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব তুলে ধরেছি। সর্বশেষে তুলে ধরেছি আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব। কিন্তু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির সামনে চ্যালেঞ্জ হলো, তিনটি বিরাট রাষ্ট্রের সাথে বা তিনটি মাঝারি শক্তির সাথে বন্ধুত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা।
অর্থাৎ ভারত-বাংলাদেশ, চীন-বাংলাদেশ ও আমেরিকা-বাংলাদেশ এই তিনটি সমীকরণ সূচারুরূপে পরিচালনা করা। আমার মূল্যায়নে, বাংলাদেশ-আমেরিকা বন্ধুত্বের সমীকরণটি অন্য দুইটির তুলনায় দুর্বল। অতএব আমেরিকা উদ্বিগ্ন হতেই পারে। বলে রাখা ভালো যে, আমেরিকাও তার অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য সচেষ্ট হবে, এটাই স্বাভাবিক।
যা আলোচনা করলাম না
আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আরো আছে নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। এই দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে, এই কলামে ইচ্ছাকৃতভাবেই আজ লিখলাম না। দুইটি কারণ- কলামের আকৃতি সীমিত রাখা এবং দ্বিতীয় হলো মিয়ানমার-ভারত-চীন-আমেরিকার তুলনায় তাদের গুরুত্ব কম।
(লেখাটি লেখকের সাম্প্রতিক ভূরাজনীতি ও বাংলাদেশ শীর্ষক প্রবন্ধের অংশবিশেষ)
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
mgsmibrahim@gmail.com