আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত
মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক - ছবি : সংগ্রহ
মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব কথা
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ তারিখে লাহোর মহানগরীতে উপস্থাপিত পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের বঙ্গপ্রদেশ (অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) একটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কংগ্রেসের কিছু সংখ্যক জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও মুসলিম লীগের কিছু জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদের কূটিলতায় সেই পাকিস্তান প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৪৬ সালে নতুন প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়েছিল। এখানে বিস্তারিত আলোচনার জায়গা নেই। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই, ভারত নামক দেশটি চাচ্ছিল, পাকিস্তান যেন ভেঙে যায়। শুধু চাওয়া নয়, তার জন্য কিছু ‘দাওয়া’ বা ‘দাওয়াই’ অবশ্যই প্রয়োগ করা হচ্ছিল।
তার থেকেও বড় কথা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নেতাগণ বা শাসকগোষ্ঠী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি তথা বাঙালি জনগণের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক, বঞ্চনামূলক, প্রতারণামূলক আচরণ করেই যাচ্ছিলেন। যার ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের মনে ধীরে ধীরে তিলে তিলে পাকিস্তানের প্রতি বৈরী মনোভাব সৃষ্টি হতেই থাকে। শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত সব প্রচেষ্টা বিফল হওয়ার কারণে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই উপসংহারে আসেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশই মাত্র এর সমাধান।
এইরূপ প্রেক্ষাপটেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের সূচনালগ্নে এসে দাঁড়িয়েছিল। যদি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আন্তরিক ও সৎ হতো, তাহলে পরিস্থিতি কিরকম হতো সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। ভারত সরকারের কাজ ভারতের স্বার্থ রক্ষা করা ও প্রমোট করা, ভারত সরকার তাই করেছে, কিন্তু পাকিস্তান সরকারের কাজ পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করা, কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা করেনি, এটাই হলো মোদ্দা কথা। অতএব যখন বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধ শুরু করল, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও বঙ্গবন্ধুর নামে মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণায়, তখন ভারত দেখল তার ২৩ বছরের অপেক্ষার স্বর্ণদ্বার খুলে গিয়েছে!
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত আকুণ্ঠ সার্বিক ও সর্ব আঙ্গিকের সমর্থন দেয় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তথা বাংলাদেশকে। যার কারণে, ১৯৭১-এর পরবর্তী দীর্ঘদিন, ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের একটি আন্তরিক কৃতজ্ঞতাবোধ সুস্পষ্ট ছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের দৈর্ঘ্য ২৬৬ দিন বা ৯ মাস। সাত কোটি বাঙালি, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই বিজয়ী হতো কিন্তু, যদি ভারত আমাদের পাশে না দাঁড়াত, তাহলে ঠিক ৯ মাসে আমাদের যুদ্ধ শেষ হতো কি না বা আমরা কখন বিজয়ী হতাম, সে সম্বন্ধে এখানে আলোচনা করছি না।
আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস বা বাঙালি জনগণের সাহস বা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের সাহস ও দক্ষতা ইত্যাদির ওপর মন্তব্য করছি না, আমি শুধু মন্তব্য করছি, সময় ও যুদ্ধ সামগ্রীর প্রসঙ্গে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবস হলো ১৬ ডিসেম্বর। পুরো ৯ মাস বিভিন্ন প্রকারের সহযোগিতা দিলেও, ৭১-এর নভেম্বরের ২১ তারিখ থেকে ভারতীয় সামরিক বাহিনী প্রত্যক্ষভাবে জড়াতে শুরু করে এবং ডিসেম্বরের ৩ তারিখের পরপরই, ভারতীয় সামরিক বাহিনী প্রত্যক্ষভাবে সামরিক অভিযান শুরু করে। ভারতীয় সামরিক অভিযানের অন্যতম অংশীদার ছিল তৎকালীন মুক্তিবাহিনী তথা মুক্তিযোদ্ধারা।
আমি পাঠক সম্প্রদায়ের কাছে সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করছি যে, মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ ১৩ দিন ছিল দুই আঙ্গিকের যুদ্ধ। একটি আঙ্গিক হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায় এবং আরেকটি আঙ্গিক হলো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। ওই সর্বশেষ ১৩ দিন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শুধু পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মাটিতে নয়, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে ও মাটিতেও যুদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়, এবং অনিবার্যভাবেই এটা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়।
(লেখাটি লেখকের সাম্প্রতিক ভূরাজনীতি ও বাংলাদেশ শীর্ষক প্রবন্ধের অংশবিশেষ)
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
mgsmibrahim@gmail.com