বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের বিশেষ গুরুত্ব

মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | Nov 03, 2019 02:37 pm
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের বিশেষ গুরুত্ব

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের বিশেষ গুরুত্ব - ছবি : সংগ্রহ

 

এই কলামটি ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের জন্য নয়

ইংরেজি শব্দ জিও-পলিটিক্সের বাংলা করা হয়েছে ভূরাজনীতি। জিও মানে জিওগ্রাফি, মানে ভূগোল এবং পলিটিক্স মানে রাজনীতি। একটি দেশের অভ্যন্তরে, বিভিন্ন উপাত্ত রাজনীতিকে প্রভাবান্বিত করে। অনুরূপভাবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়, সে ক্ষেত্রে দেশগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান, তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে প্রভাবান্বিত করে।

আজকের সংক্ষিপ্ত কলামটির বিষয়বস্তু হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশের প্রভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পৃথিবীর বহু দেশ নিয়ে, কিন্তু আমরা মোটামুটি বাংলাদেশের সাথে ভারত, চীন, আমেরিকা ও মিয়ানমারের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকব। তবে এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মানচিত্রের সাথে নিবিড় সম্পর্ক না থাকলে, কলামটি পড়ে সম্মানিত পাঠকরা মজা না-ও পেতে পারেন। তবে আমি বিনয়ের সাথে নিবেদন করে রাখছি যে, এই কলামটি ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের জন্য নয়, এই কলামটি ওই সব পাঠক ভাইবোনের জন্য যারা দেশ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন এবং খুঁটিনাটি জটিল বিষয় বোঝার জন্য সময় পাবেন না। অতএব বিষয়টিকে যতটুকু সম্ভব সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করব কিন্তু কলামটি একটু দীর্ঘ হয়েই যাবে।

পূর্ব পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান
বাংলাদেশ ও ভারত যে পরস্পরের প্রতিবেশী, এ কথাটিকে অতি সুস্পষ্ট। আজকের বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের আগে ছিল পাকিস্তানের অংশ তথা পূর্ব পাকিস্তান নামক প্রদেশ। পাকিস্তান নামক দেশটির দু’টি প্রদেশ ছিল এবং অপর প্রদেশটির নাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। উভয় প্রদেশের মাঝখানে দূরত্ব ছিল বারো শত থেকে পনেরো শত মাইল; অর্থাৎ মাঝখানে ছিল ভারত নামক একটি দেশের বিশাল ভূখণ্ড। তখন পূর্ব পাকিস্তান নামের প্রদেশটি তার আলাদা পররাষ্ট্রনীতি গঠন করতে পারত না, গঠন করার কথা নয়। পররাষ্ট্রনীতি গঠিত হতো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজধানী থেকে। যারা পররাষ্ট্রনীতি গঠন করতেন, তারা উভয় প্রদেশের স্বার্থকে সমানভাবে গুরুত্ব দিতেন না; তারা পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিতেন।

পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা
১৯৪৭ সাল থেকে নিয়ে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ও ভারত নামক উভয় রাষ্ট্র কোনো দিনই পরস্পরের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয়নি; উভয় দেশ বৈরিতায় নিমজ্জিত ছিল। উভয় দেশ ১৯৪৭-৪৮ সালে একবার এবং ১৯৬৫ সালে আরেকবার পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, ওই দু’টি যুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোনো জায়গায় পাকিস্তান ও ভারতের সামরিক বাহিনীগুলোর মধ্যে কোনো যুদ্ধ হয়নি।

অর্থাৎ যুদ্ধ যদিও দু’টি দেশের মধ্যে হয়েছিল, কিন্তু সশরীরে বা সরেজমিনে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তের এপার-ওপার। ১৯৪৭-৪৮ সালের যুদ্ধের সময় আমার জন্ম হয়নি। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের সময় আমি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। যুদ্ধের কারণে আমাদের কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কারণ কলেজটি ছিল আবাসিক এবং চট্টগ্রাম মহানগরের কেন্দ্র থেকে মাত্র ১০ মাইল উত্তরে, বঙ্গোপসাগরের পানি থেকে এক কিলোমিটার পূর্বে, নিচু পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। বর্তমানে যেমন, সেই ১৯৬৫ সালেও চট্টগ্রাম ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।

অতএব পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য, ভারত চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর আকাশ পথের আক্রমণ চালানোটা স্বাভাবিক ছিল। যদি আকাশ পথে আক্রমণ চালাত, তাহলে বড় বড় স্থাপনাগুলো অবশ্যই আক্রমণের শিকার হতে পারে, তাই কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বিশেষত ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন জনগোষ্ঠী, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা ও মূল্যায়ন করার সুযোগ পায়।

সেই চিন্তা ও মূল্যায়নের উপসংহার ছিল এই যে, পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত তথা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার প্রতি চরম অবহেলা করেছে তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভারতীয় সম্ভাব্য আক্রমণের দুশ্চিন্তায় সন্ত্রস্ত ছিল। কিন্তু ভারত তৎকালীন (১৯৬৫) পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক তৎপরতা না চালানোর ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন জনগোষ্ঠী এবং সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল এবং কিছুটা হলেও ভারতের প্রতি অপ্রকাশ্যে ধন্যবাদ জানিয়েছিল।

ভারত কেন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু করেনি
পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ না করার পেছনে, নিশ্চয়ই ভারতীয় সমরবিদ এবং রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের মনের ভেতরে যথেষ্ট যুক্তি ছিল। একটা যুক্তি হলো, ভারতীয় সামরিক শক্তিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা। এক ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরেক ভাগ পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। এশিয়ার মানচিত্রটি যাদের কাছে সুপরিচিত, তারা ভালোমতো জানেন যে, ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশের উত্তর সীমান্তটি, চীন বা মহাচীন নামক বিশাল দেশের দক্ষিণ সীমান্তের বিশাল অংশের সাথে লাগোয়া এবং ১৯৬২ সালে এ অঞ্চলেই চীন ও ভারতের মধ্যে প্রকাশ্য ও সশস্ত্র যুদ্ধ হয়েছিল, যেই যুদ্ধে ভারত পরাজিত হয়েছিল।

১৯৬২ সালের তিন বছর পর ১৯৬৫ সালে এসে, ভারত কোনোমতেই, পাকিস্তানের সাথে চলমান যুদ্ধের একই সময়টাতে চীনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায়নি। না চাওয়াটাই স্বাভাবিক। উত্তর-পূর্ব ভারতের চীন সীমান্তে, চীনের বিরুদ্ধে, ভারত যুদ্ধে লিপ্ত হতে না চাইলেও, চীন তো একই অঞ্চলে বা অন্যত্র, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতেই পারত যেকোনো বাহানা সৃষ্টি করে। আমরা ১৯৬৫ সালের কথা বলছি। ওই সময়টিতে বর্তমানের মতোই, চীন ও পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। যদি পাকিস্তানের একটি অংশ (অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান) বিপদে পড়ে, তাহলে সেই বিপদের দিনে তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চীন, পূর্ব পাকিস্তানের ওপর থেকে ভারতীয় আগ্রাসনের চাপ কমানোর জন্য, চীন-ভারত সীমান্তে একটা ঝামেলা লাগাতেই পারত। এটাকে এভয়েড করার জন্য, ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেনি। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের যুদ্ধে, ভারত কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করার অনেক কারণের মধ্যে এটি মাত্র একটি কারণ।

(লেখাটি লেখকের সাম্প্রতিক ভূরাজনীতি ও বাংলাদেশ শীর্ষক প্রবন্ধের অংশবিশেষ)
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
mgsmibrahim@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us