ন্যায়-অন্যায়ের দোলাচলে সাকিব
সাকিব আল হাসান - ছবি : সংগৃহীত
সেলেব্রেটিদের নামের সীমাহীন তালিকা ভেসে ওঠতে থাকায় বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্রটি পরাবাস্তব হয়ে পড়ছে। এর ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ যে নামটি শিরোনামে এসেছে, তিনি হলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুপার-হিরো সাকিব আল হাসান। ক্রিকেট বুকিদের তার কাছে দেয়া প্রস্তাবের বিষয়টি প্রকাশ না করার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের যোগাযোগ যখনই করা হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতেই হবে। এ ধরনের তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে আইসিসি তাকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। সাকিব শাস্তি মেনে নেয়ায় এক বছরের নিষেধাজ্ঞা হ্রাস করে এক বছরের জন্য তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছৈ। খবরটি বাংলাদেশে অবিশ্বাস আর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিবিদেরা দুর্নীতিগ্রস্ত বলে ধারণা করা হয়ে থাকে, তাই বলে ক্রীড়া নায়কেরা?
সত্যি যে ম্যাচ গড়াপেটার সাথে জড়িত ছিলেন না সাকিব। তবে কথা হলো, বুকিরা বিমূর্ত কিছু নিয়ে আলোচনা করে না। ফলে তাদের সাথে যেকোনো আলোচনার কথাই জানাতে হবে। এ কারণেই সাকিবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
খেলোয়াড়দের ধর্মঘটের পর নিষেধাজ্ঞা
খেলোয়াড়দের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে সপ্তাহখানেক ধরে সাকিব ছিলেন বিশাল শিরোনামে। তারা বেতন, ম্যাচ ফি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলেন। এটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ ধর্মঘট। দাবিগুলো পূরণ না হলে খেলতে অস্বীকৃতি জানান খেলোয়াড়রা। ধর্মঘটের জন্য খেলোয়াড়দের সমালোচনা করার কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান পাপন খলনায়কে পরিণত হয়েছিলেন। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। শেষ পর্যন্ত খেলোয়াড়দের দাবি পূরণ করা হয়।
কিন্তু, তখনো ঝামেলা বাড়ছিলই। খেলোয়াড়দের যখন চুক্তি সইয়ের জন্য উল্লসিত থাকার কথা, তখন সাকিব ছিলেন অবিশ্বাস্যরকম বিষণ্ন। এ নিয়ে নানা গুঞ্জন ছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, এমনটা হয়েছিল সাকিবের প্রতি পাপন ও বিসিবির বৈরিতাকেন্দ্রিক।
পর দিনই বিসিবির অনুমতি চাড়াই একটি এনডোর্সমেন্ট চুক্তিতে সই করার জন্য সাকিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন পাপন। বিষয়টি খুব মারাত্মক ছিল না। তবে এতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে বিসিবি ও খেলোয়াড়দের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে।
এবং এরপর আইসিসি দৃশ্যপটে প্রবেশ করে বড় আঘাতটি হানে। কেউ ভাবেনি যে আঘাতটি সাকিবের ওপর আসবে। কারণ অনেকের দৃষ্টিতে তিনি রয়েছেন সম্ভাব্য দায়মুক্তি সুবিধায়। কিন্তু বুকিদের সাথে কথোপকথনের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করে আইসিসি। ফলে প্রমাণ ছিল পরিষ্কার। বিসিবি ও প্রধানমন্ত্রী সমর্থন প্রদান করার কথা ঘোষণা করলেও উল্লেখ করেন যে আইসিসির নিয়মের ক্ষেত্রে কোনো কিছুই করার নেই।
বাংলাদেশে ক্রিকেট দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। আরেক ‘নায়ক’ আশরাফুল ম্যাচ গড়াপেটার জন্য কয়েক বছর নিষিদ্ধ ছিলেন। খেলোয়াড় ধর্মঘটের সময় মিডিয়াসহ অনেকেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের অনেক ম্যাচ নিয়মিতভাবেই পাতানো হয়।
কে জানে এবং কে নয়?
ঢাকায় প্রাণবন্ত ক্রিকেটে জুয়া চলে, তবে নিষিদ্ধভাবে। কিন্তু কেউ এ নিয়ে কিছুই করেনি। কেন যারা জানে তারা বিষয়টিকে নজরে আনার কাজটি করেনি? প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে মিডিয়ার সামনে এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন। উল্লেখ্য, এই অভিযানে ক্ষমতাসীন দলের অনেক রাঘব বোয়াল ধরা পড়েছেন। মিডিয়া যদি জানতই, তবে কেন হইচই করেনি? তিনি তারপর সম্পাদকসহ মিডিয়া নেতাদের দিকে ইঙ্গিত করেন ‘অর্থের জন্য খবর’ পরিবেশনসহ বিভিন্ন দুর্বৃত্ত চক্রের অংশে পরিণত হওয়ার জন্য।
আসল কথা হলো, বাংলাদেশের মতো অতি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে এগুলো বড় কোনো গোপন খবর নয়। দুর্নীতির খবর সাধারণ বিষয়। কিন্তু বিষয়টি যদি এতই পরিচিত হবে, তবে কেন এ নিয়ে কিছু করা হয় না?
ক্যাসিনো জুয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই বিষয়টি দৃশ্যত জানত। কিন্তু তা ক্ষমতাসীন দলের রাঘব বোয়ালেরা জানার কারণে এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়নি। এটিকে শক্তিমানদের স্বাভাবিক ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। এ ধরনের কার্যক্রম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা ভয়াবহ বিষয় হওয়ায় তা ছিল বিবেচনার বাইরের ব্যাপার।
এদিকে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির সাথে মিডিয়ার অনেক লোকের নাম ভাসছে। ফলে আঙুল যদি তুলতেই হয়, অনেক আঙুলই তোলার প্রয়োজন পড়ে।
সাকিব নিষেধাজ্ঞা বিচ্ছিন্ন ঘটনা
এদিকে সাকিবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ফ্যানদের মধ্যে তর্কবিতর্ক চলছে। অনেক বলছে, খেলোয়াড়দের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রতিশোধ নিতে পাপন তাকে ডুবিয়ে দিয়েছেন। অনেক বলছেন, আইসিসি নিজেই আইন লঙ্ঘন করেছে। অনেকে সময়টিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে। কেলেঙ্কারিটি ঘটেছে ভারত সফরের ঠিক আগ দিয়ে। ফলে অজনপ্রিয় প্রতিবেশীকে এজন্য দায়ী করাটা সহজ হয়েছে।
যে দেশে নিয়ম মানার বালাই নেই, সেই দেশে সাকিব একটি বড় নাম। তিনি যে বাংলাদেশে থাকেন, সেই দেশে ক্ষমতাশালী হওয়া মানে আইনের ঊর্ধ্বে থাকার বিষয়টি মেনে নেয়া হয়। এই দেশে দুর্নীতির ধারণাটি এতই সাধারণ যে কোনটা হারাম আর কোনটা হালাল তার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা লোকজনের জন্য কঠিন বিষয়।