ক্রিকেটের কালো রাজনীতির অসহায় শিকার সাকিব!
সাকিব আল হাসান - ছবি : সংগৃহীত
কালো মেঘ, ভারী বর্ষণ, ঝড় এরপর টর্নেডো। গত কয়েক দিন বাংলাদেশের ক্রিকেটের ওপর দিয়ে এগুলো সবই বয়ে গেছে। সর্বশেষ টর্নেডোর মধ্য দিয়ে ঘটেছে সমাপ্তি। কিন্তু যে ধ্বংসলীলা রেখে গেছে ওই টর্নেডো, তাতে এর রেশ কত বছর বয়ে বেড়াতে হবে সেটা সামনের পরিস্থিতিতে অনুধাবন করা যাবে। টর্নেডোর নাম ‘ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব না জানানো’। আর তাতে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ তথা বিশে^র অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেট।
বাংলাদেশের ক্রিকেট এ জন্য যে, এ দেশের ক্রিকেট যতটুকু সাফল্য পেয়েছে তা অর্জনে বেশি অবদান রেখেছে সাকিব আল হাসানের মাঠের পারফরম্যান্স। সাফল্যের এই কারিগরকে যখন ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে ফেলে নির্বাসনে বা মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন দেশের ক্রিকেট কিভাবে ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখবে? তার দুই বছরের শাস্তির মধ্যে এক বছর মাঠের বাইরে থেকে সব শর্ত ঠিকমতো পালন করলে দ্বিতীয় বছরে খেলতে পারবেন। কিন্তু এই একটি বছর বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের ক্রিকেট এ এক বছর খুবই ব্যস্ত সময় পার করবে। এ সময়টায় সাকিববিহীন বাংলাদেশ দল ‘জিম্বাবুয়ে’ হয়ে যায় কি না সেটাই বড় শঙ্কার ব্যাপার। কারণ সব ম্যাচেই সাকিব ও মাশরাফি ফ্রন্ট লাইনে থাকতেন। মাশরাফি অবসরের চিন্তা নিয়ে বসে আছেন। সাকিবের এ অবস্থা। তাহলে হাল ধরবে কে?
বিষয়গুলো দেশের ক্রিকেটাররাও অনুধাবন করেছেন। ফলে দলে সাকিবের অনুপস্থিতিতে জাতীয় দলের ও প্রথম শ্রেণীর লিগে খেলা ক্রিকেটররা সবাই মর্মাহত। দল সাফল্য পেলে সবাই অনুপ্রাণিত হন, ব্যর্থ হলে সবাই মনমরা হয়ে যান। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যেই ভারতের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করল বাংলাদেশ টি-২০ স্কোয়াড।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্থান ২০১৫ বিশ^কাপ থেকেই। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ওই আসরে বাংলাদেশ নজর কাড়ে সবার। এরপর দেশে ফিরে যেন অন্য এক বাংলাদেশ। অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তারা, যাতে অগ্রণী ভূমিকায় সাকিব মাশরাফিরা। মাশরাফি ইনজুরি ও বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়েছেন সত্য। তার সাথে যোগ হয়েছে তার জনপ্রতিনিধির (সংসদ সদস্য) দায়িত্ব। ক্রিকেট থেকে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা দূরে চলে যাচ্ছেন তিনি। এখনো ওয়ানডে ক্যাপ্টেন তিনি। কিন্তু সেটাও ছেড়ে দিতে চাইছেন। এর মধ্যেই হঠাৎ করে চলে এলো সাকিব ইস্যু। এরপর ফ্রন্ট লাইনে থেকে দলকে পথ দেখাবেন কে?
সাকিবের অবর্তমানে টি-২০ ক্রিকেটের অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহ ও টেস্টে মুমিনুল হক। কিন্তু তারা কী সত্যিকারার্থে সাকিবের বিকল্প? সাকিব একের মধ্যে দুই শুধু না, তিন। ব্যাটসম্যান, বোলার ও দক্ষ অধিনায়ক। তার বিকল্প কোথায় মিলবে? কষ্টটা এখানেই। অন্যসব দেশে সব খেলোয়াড়ই প্রায় সমসাময়িক। কিন্তু বাংলাদেশে এমনটা নেই। মাশরাফির বিকল্প সবাই সাইফউদ্দিনকে ভেবেছিলেন। কিন্তু ইনজুরিতে তিনি মাঠের বাইরে। মাশরাফির ক্যাপ্টেন্সির গুণটা তো গোটা বিশে^ই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাকিব তো সাকিবই। সাকিববিহীন বাংলাদেশ খেলতে হবে ভারতে পূর্ণাঙ্গ সফর, সম্ভাব্য পাকিস্তান সফর, ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে সিরিজ যা পরিবর্তিত হয়ে জুনে হওয়ার কথা), জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ, আয়ারল্যান্ড সফর, শ্রীলঙ্কা সফর, নিউজিল্যান্ডের সাথে দুই দফা সিরিজ এবং টি-২০ বিশ^কাপ।
এখানে কোন সিরিজটা গুরুত্বহীন? কোন সিরিজে সাকিব ছাড়া সহজেই বের হয়ে আসা সম্ভবপর হবে আগামী এক বছরে? এরপর ফিরে তিনি নিজের ফর্ম কতটা ভালো করবেন সেটাও দেখার বিষয়। মোহাম্মদ আশরাফুলের বেলায়ও এমন হয়েছে। আশরাফুল কি আর পেরেছেন জাতীয় দলে ফিরতে? ভারতের এক টুর্নামেন্টে জাতীয় দল থেকে তৎকালীন হাবিবুল বাশার সুমন, অলক কাপালী, শাহরিয়ার নাফিসসহ বিশাল একটা গ্রুপ যোগ দিয়েছিল বিসিবি থেকে পদত্যাগ করে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ধ্বংসের সে পাঁয়তারা থেকে মুক্ত হতে সময় লেগেছিল। এবার সাকিব। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কত সময়ের প্রয়োজন হবে তা সময়ই বলবে।
সাকিব অন্যায় করেছেন, সেটা তিনি শুরু থেকেই মেনে নিয়েছেন। সহযোগিতাও করেছেন তদন্তে। কিন্তু সে তদন্তটা দু’বছর কী কারণে চলার প্রয়োজন হলো? সাকিব মেনে নিলে তো প্রমাণেরও প্রয়োজন পড়ে না। সাকিবকে অনেক আগেই এ শাস্তিটা দিতে পারত আইসিসি। সেটা যদি আরো এক বছর আগে হতো, তাহলে সাকিব এত দিন আগামী ওই সিরিজগুলোর জন্য তৈরি হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু আইসিসি সেটা এমন এক মুহূর্তে দিয়েছে যাতে বাংলাদেশ অনেক খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে বাধ্য হয়। এটাও একটা বিশাল ক্রিকেট পলিটিকস। আইসিসি কারা চালায় সেটা সবার জানা। তিন মোড়ল ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। এদের প্রভাবমুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। তাহলে তারা যা বলবেন, বা চাইবেন সেটাই তো হবে।
এটা ঠিক, আইসিসিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের গলার স্বরটা বড় করার সুযোগ নেই। সেটা তারা পারেন না। ক্রিকেট সংগঠক হতে হয়। বহির্বিশে^ বিভিন্ন বোর্ডের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে হয়। যে পলিটিকসে বাংলাদেশের অবস্থান শূন্যতে। ফলে এমন বহু কিছুতেই ভোগান্তিতে পড়তে হবেÑ বাংলাদেশের মতো উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা দলগুলোকে। এটা আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। যে আগারওয়াল জুয়ার প্রস্তাব দিতে চাইছিলেন, তিনি যে মোড়লদের সাজানো নাটক ‘মঞ্চস্থ’ করতে আসেননি তার প্রমাণটা কে দেবে? সাকিব তো সামান্যই। তার চেয়েও অনেক বড় মাপের ও উদীয়মান অনেক দেশের বড় বড় ক্রিকেটারের লাইফ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে ভারতের একজনের নামও কখনো কেউ শোনেনি, শুনবেও না! আগারওয়ালরা শুধু জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশসহ তিন মোড়লের বাইরে যারা তাদের ক্রিকেটারদের দমন করার জন্য?
সাকিবের বিষয়গুলো নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে ঝড়। কিন্তু এটাও ঠিক, এগুলোতে কোনো লাভ নেই। আইসিসিতে বাংলাদেশের অবস্থান নড়বড়ে। কথা, প্রতিবাদ, হুমকি ওখানেই দিতে হবে। নতুবা এমন বহু নাটকীয় ঘটনা একের পর এক মেনে নিয়ে পথ চলতে হবে বাংলাদেশকে।
নিজের আইন ভঙ্গ করে সাজা দিলো আইসিসি : আইসিসির এন্টি করাপশন কোড বা দুর্নীতি দমন বিধি অনুযায়ী সাকিব আল হাসানকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আইসিসি। কিন্তু আইসিসির পক্ষ থেকে এ শাস্তি দেয়া হয়েছে নিজের এন্টি করাপশন কোড লঙ্ঘন করে। এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডক্টর তুহিন মালিক।
তিনি বলেছেন, সাকিবকে সাজা দেয়ার সিদ্ধান্তের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে অপরাধ সংঘটনের চারটি ঘটনা ও তিনটি তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছেÑ ১. ২০১৭ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি আগারওয়ালের সাথে সাকিবের বেশ কিছু হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ চালাচালি হয়। ২. ২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি আগারওয়াল সাকিবকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠায়। ৩. ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি আগারওয়াল আবার সাকিবকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পাঠায়। ৪. ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল সাকিব আইপিএল ম্যাচ খেলার দিন আগারওয়াল হোয়াটসঅ্যাপে সাকিবকে মেসেজ করে। এ ব্যাপারে আইসিসি সাকিবের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তদন্ত কমিটি ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ও ২৭ আগস্ট সাকিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আইসিসি সাকিবের বিরুদ্ধে আইসিসির এন্টি করাপশন কোডের অনুচ্ছেদ ২.৪.৪ অনুযায়ী ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর তিনটি ঘটনায় চার্জ আনে।
আইসিসির সিদ্ধান্তের ১৮ দফায় এ তিনটি অপরাধ সংঘটনের সময় ও তারিখ উল্লেখ করা হয়েছেÑ ১৯ জানুয়ারি ২০১৮, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ এবং ২৬ এপ্রিল ২০১৮। আইসিসি যে এন্টি করাপশন কোডের বিধান লঙ্ঘনের জন্য সাকিবকে সাজা দিয়েছে, তা কার্যকর হয়েছে ২০১৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে। আর আইসিসির এন্টি করাপশন কোডের ১১.৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছেÑ দুর্নীতি দমন বিধি ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে বলবৎ হবে এবং এর কার্যকারিতা শুরু হবে সে দিন থেকে। এটি জাতীয় ক্রিকেট ফেডারেশনগুলোর দুর্নীতি দমন বিধি (আচরণবিধিসহ) বা দুর্নীতিবিরোধী বিধিমালার পূর্ববর্তী সংস্করণগুলির অধীনে যে কোনও সিদ্ধান্ত এবং/বা নিষেধাজ্ঞাগুলিকে বিঘিœত করবে না। একইভাবে এখানকার উল্লিখিত বিধানগুলি কার্যকর তারিখের আগে মুলতুবি থাকা বিষয়গুলিতে পূর্ববর্তী সময় থেকে প্রয়োগ করা যাবে না।
এর পরিবর্তে এ বিধির কার্যকর তারিখের আগে বিচারাধীন কোনও মামলা, বা কার্যকর তারিখের পরে আনা হয়েছে কিন্তু কার্যকর তারিখের আগে ঘটে যাওয়া কাজ বা ভুলের ওপর ভিত্তি করে দুর্নীতি দমন সংস্থার আনীত অভিযুক্তের অপরাধের সময় বলবৎ ছিল এমন বিধিবিধানে বিচার হতে হবে। অর্থাৎ এ কোড কার্যকরের তারিখের পূর্বের কোন ঘটনার ক্ষেত্রে ‘পেছনের সময় থেকে কার্যকর’ করা যাবে না। তাই এ কোড কার্যকরের তারিখের পূর্বের ঘটনার জন্য বর্তমান কোডের অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাকিবকে সাজা দেয়া যাবে না। সাকিবের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ঘটনার তারিখগুলো হলোÑ ১৯ জানুয়ারি ২০১৮, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ এবং ২৬ এপ্রিল ২০১৮। দু’টি ঘটনা আইসিসির এন্টি করাপশন কোডের কার্যকরের অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির আগের। ফলে উক্ত দু’টি ঘটনার ক্ষেত্রে এই কোড অনুযায়ী শাস্তি প্রদান সম্পূর্ণ বেআইনি। কারণ ১৯ জানুয়ারি ও ২৩ জানুয়ারির ঘটনার সময় ২০১৮ সালের আইসিসি দুর্নীতি দমন বিধির অনুচ্ছেদ ২.৪.৪ এবং ৬.২ এর কোন অস্তিত্বই ছিল না।
ফলে উক্ত দু’টি ঘটনার ক্ষেত্রে বিধির অনুচ্ছেদ ২.৪.৪ লঙ্ঘনের অপরাধে ৬.২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাকিবকে সাজা প্রদান সম্পূর্ণ বেআইনি। যদিও আইসিসির ২০১৪ সালের একটি এন্টি করাপশন কোড ছিল। তবে ওই কোডের অধীনেও কিন্তু সাকিবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যেহেতু বর্তমান কোড অনুযায়ী কেবল ২৬ এপ্রিলের ঘটনা প্রযোজ্য তাই এই কোডের ৬.২ অনুযায়ী খুব বেশি হলে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা হতে পারত। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আইসিসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সাকিব আপিল কিংবা রিভিউ কোনোটাই করতে পারবেন না।