ইসকন নিয়ে যা বললেন ফরহাদ মজহার

অন্য দিগন্ত ডেস্ক | Oct 30, 2019 06:24 pm
ইসকন নিয়ে যা বললেন ফরহাদ মজহার

ইসকন নিয়ে যা বললেন ফরহাদ মজহার - ছবি : সংগ্রহ

 

‘আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ’ বা ইসকন (International Society for Krishna Consciousness) এবং বাংলাদেশে তাদের তৎপরতা সম্পর্কে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান যে ধর্মই হোক, সচেতন নাগরিক মাত্রই বাংলাদেশে কোনো ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বিরোধ চান না। তাদের অনেকের ধারণা, ইসকনের তৎপরতা এক ধরনের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি করছে। উৎকণ্ঠা সে কারণেই।

জানা যায়, ইসকন এই দেশের সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি নয়, তাদের প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠানও নয়। বিশেষত তাদের আন্তর্জাতিক ‘করপোরেট অপারেশান’কে মহামতি শ্রী চৈতন্যের জাতপাতবিরোধী সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন এবং প্রেমধর্মের প্রতিনিধি রূপে গণ্য করা এক প্রকার বিভ্রান্তি ও ভুল। একালে ‘প্রেমধর্ম’ কায়েম করার অর্থ- সবার আগে প্রেমশূন্য পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং ভোগবাদকে চ্যালেঞ্জ করা। ইসকন তাদের ভক্তদের নিরামিষাশী ও মিতাচারী হওয়ার উপদেশ দিলেও বিশাল বিশাল মন্দির স্থাপনের মধ্য দিয়ে যে বার্তা দিয়ে থাকে, সেটা দৃশ্যমান ভোগবাদী সংস্কৃতির বার্তা। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় প্রভুপাদের স্বর্ণ প্রাসাদ বা ‘নব বৃন্দাবন’ এর একটি দৃষ্টিকটু নজির। ‘নব বৃন্দাবন’ বা স্বর্ণ প্রাসাদের প্রতিযোগিতা রাজরাজড়াদের সামন্তক্ষমতা প্রদর্শনের সাথে তুলনীয়। ভার্জিনিয়ায় ইসকনের ‘নব বৃন্দাবন’কে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের তাজমহলের সাথে তুলনা করা হয়। চৈতন্যের ধর্মভাবে হৃদয়ের বৃন্দাবনকে বৃহৎ ও বিশাল করাই ছিল লক্ষ্য। বাইরের লোক দেখানো, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া ধর্মমন্দির দিয়ে মানুষ তৈরি হয় না, আর্কিটেকচার বা স্থাপত্য হয়।

ইসকনের সমালোচনা, পর্যালোচনা এবং তাদের কার্যক্রমের বিরোধিতা সনাতন হিন্দুধর্মের বিরোধিতা নয়; বরং বাংলার ঐতিহ্যবাহী ধর্ম ও ভাবের বিকৃতি রোধের জন্যই তা দরকারি।

ইসকন একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। ষাট থেকে সত্তর দশকব্যাপী পাশ্চাত্যের তরুণদের গভীর আধ্যাত্মিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে ‘হরে কৃষ্ণ মুভমেন্ট’ হিসেবে এর শুরু। ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে গড়ে উঠলেও পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের মধ্য দিয়ে পৃথিবীব্যাপী একটি ‘কাল্ট’ হিসাবেই ইসকন পরিচিতি লাভ করেছে। অর্থ, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই আন্তর্জাতিক ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রতিযোগিতায় ইসকন নির্ধারক ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যেন আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত না হয়, সে জন্যই ইসকনের পর্যালোচনা জরুরি। সাম্প্রতিককালে দিনাজপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম ভোলায় স্থানীয় জনগণের সাথে ইসকনের বিরোধ ও সংঘর্ষ প্রমাণ করে, বাংলাদেশে তারা মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাথে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সম্প্রদায়গত বিরোধ, সংঘাত ও দাঙ্গা তৈরির জন্য তৎপর।

ভোলায় সম্প্রতি পুলিশের গুলিতে চারজন শহিদ ও কয়েক শ’ মানুষ আহত হওয়ার আগে ইসকন সংগঠনটিকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের সাথে সংঘর্ষ হয়েছিল। এলাকায় আগে থেকেই ক্ষোভ জারি ছিল জনমনে। ইসকনের সাথে স্থানীয় বাসিন্দাদের দ্বন্দ্বের সাথে ভোলায় পুলিশের গুলি চালানোর সম্পর্ক আছে কি না তার নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি। ইসকন মন্দিরকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাংলাদেশে নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই তা ঘটছে। ভোলার ঘটনার আগে দিনাজপুরে এবং সিলেটে ইসকন ও স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে হানাহানি ঘটেছে। চট্টগ্রামে স্কুলের ছাত্রদের প্রসাদ বিতরণ করে ‘হরে কৃষ্ণ’ বলানোর ভিডিও ভাইরাল হবার পর ইসকন বাংলাদেশে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ইসকনের তৎপরতা নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের অভিযোগ ও আপত্তিকে গ্রাহ্য করা হয়নি। বরং সব সময়ই এটাকে দেখা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের অসহনশীলতা এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া হিসেবে। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ বেড়েছে। তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে প্রশাসনের অদক্ষতা প্রকট। তদুপরি, সঙ্কটের গভীরতা না বোঝার কারণে বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ইসকনের বিরুদ্ধে স্থানীয় অধিবাসীদের প্রধান অভিযোগ কী, এবং বিরোধ সৃষ্টির দৃশ্যমান প্রধান কারণই বা কী? সেটা হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ‘মন্দির দখল’ এবং স্থানীয় অধিবাসীদের ‘জমি দখলে’র অভিযোগ। কিন্তু সরকারিভাবে এর তদন্ত হচ্ছে না। এতে মনে করা যায়, ইসকন বাংলাদেশের সরকার ও প্রশাসনিক পর্যায়ে শক্তিশালী। সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ পুলিশ ও প্রশাসনের অনেকেই ইসকনের সক্রিয় সদস্য বলে জানা যায়। আবরার ফাহাদকে হত্যায় অভিযুক্ত এক ছাত্র এবং তাদের পরিবারও ইসকনের সদস্য বলে গণমাধ্যম জানিয়েছে। বাংলাদেশে যে বিপুল সংখ্যক ইসকন মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিম্বা ইসকনের বলে দাবি করা হচ্ছে, সেখানে জমি বা মন্দিরগুলো কিভাবে তাদের মন্দিরে রূপান্তরিত হলো, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। অনেক মন্দিরেরই স্থানীয় ইতিহাস আছে। আমাদের অনুমান, প্রশাসনের কাছে এ ব্যাপারে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই।

১৯৬৬ সালে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ মার্কিন দেশে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ‘ইসকন’। একটি বিদেশি ধর্ম সংগঠন বাংলাদেশে এতগুলো মন্দির প্রতিষ্ঠা করে ফেলল, যা তারা ভারতের পশ্চিম বাংলা, বিহার কিম্বা উড়িষ্যাতেও পারেনি। ইসকনের প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে যতটা না, তার চেয়ে অনেক বেশি বাংলাদেশে। এটা খুবই বিস্ময়ের বৈকি! বাংলাদেশ নিয়ে তাদের পরিকল্পনা কী আসলে সেটা তদন্ত করা সরকার ও প্রশাসনের উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রে এই সংগঠনটি ‘ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান’ হিসাবে নিজেকে দাবি করলেও সব সময়ই ‘কাল্ট’ হিসাবে পরিচিত হয়েছে। এ ছাড়া ইসকনের বিরুদ্ধে ‘ব্রেইনওয়াশিং’এবং ‘শিশু ও নারী নির্যাতনে’র অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে হয়েছে মামলাও। এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইসকনের আদর্শিক দিক। এই বিশেষ আন্তর্জাতিক ‘হরে কৃষ্ণ মুভমেন্ট’ গৌড়ীয় বৈষ্ণব চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করে কি না, সে সম্পর্কে বাংলাভাষী ও বাঙালিদের পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। বিস্ময়কর হচ্ছে, সাধারণ ভাবে ধর্মের প্রতি অনীহা ও বিদ্বেষের কারণে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় এই বিষয়ে আলোচনা একদম অনুপস্থিত বলা যায়। কিন্তু ‘অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না’। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ইসকন ‘হরে কৃষ্ণ’ কীর্তনের জায়গায় ‘জয় শ্রীরাম’ কীর্তনও তাদের কীর্তনাঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করছে।

ধর্ম ব্যাখ্যা, ধর্মচর্চা ও আধ্যাত্মিক সাধনার অধিকার সবারই আছে, ইসকনেরও রয়েছে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব বাংলাভাষী ও বাঙালিদের জন্যই, পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে আন্তর্জাতিক নব্য ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে ‘ইসকন’ কেন ও কিভাবে গড়ে উঠল, সেটা সঠিকভাবে বোঝা এবং তার বিচার জরুরি। বিশেষত বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের পারস্পরিক বোঝাবুঝির জায়গা উপেক্ষা করা অনুচিত। এটা এড়িয়ে যাওয়া উভয়ের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।

শ্রীল প্রভুপাদ ১৯৭৭ সালে মারা গেছেন। এরপরে ইসকন যে রূপে বিবর্তিত হয়েছে, এর সাথে তার আদি কল্পের মিল আছে কি না, তা নিয়ে ভক্তদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষত দুটো বিতর্ক গুরুত্বপূর্ণ। একটি অভিযোগ, সংগঠনটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের চেয়েও বিশ্বব্যাপী গোয়েন্দা তৎপরতা এবং সাম্প্রতিককালে ইসরায়েল ও ভারতীয় গোয়েন্দা তৎপরতার আদর্শ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদের উত্থান এবং ভারত ও ইসরায়েলের গভীর সামরিক, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সম্বন্ধ ও সহযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে ইসকন বাংলাদেশে তাদের এহেন তৎপরতার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম কি না, সেই তর্ক উঠেছে।

ইসকন-এ ‘প্রভু’দের নাম পরিবর্তন করবার রীতির ফলে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড বা আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখা সহজ। যেমন, ইসকনের প্রভাবশালী নেতা জয়াদ্বৈত স্বামীর আসল নাম ‘জে ইসরায়েল’ (Jay Israel), তার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি রাজ্যে একটি ইহুদি পরিবারে। ইসকনের নীতিনির্ধারণে ও পরিচালনার ক্ষেত্রে আরেকজন অতিশয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হচ্ছেন রাধানাথ স্বামী। তার আসল নাম রিচার্ড স্লাভিন (Richard Slavin)। তিনিও পারিবারিক সূত্রে ইহুদি। তার মা ইডেল ও জেরাল্ড স্লাভিন। তারা রাশিয়া, রুমানিয়া, পোলান্ড ও লিথুয়ানিয়া থেকে যেসব ইহুদি পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে রিফিউজি হিসেবে এসেছেন, তাদেরই সন্তান। ভারতে ও বাংলাদেশে স্কুলের বাচ্চাদের দুপুরের খাবার পরিবেশনার কর্মসূচি রিচার্ড স্লাভিনের পরিকল্পনা। স্লাভিন ইসকনের কার্যকলাপ বোম্বাইয়ে বসে পরিচালনা করেন। চট্টগ্রামে স্কুলের বাচ্চাদের ‘প্রসাদ’ খাইয়ে ‘হরে কৃষ্ণ’ বলিয়ে নেয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ফলে ইসকন বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে।

জে ইসরায়েল ও রিচার্ড স্লাভিন দুইজনই ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে ইসকনের নীতিনির্ধারণী কাজে জড়িত। স্লাভিন ইসকনের গভর্নিং বডি সদস্য এবং একজন দীক্ষাগুরু। অন্যদের আসল পরিচয় জানলে ইসকনের পরিচালনা কমিশন আসলে কারা চালায়, তা বোঝা যাবে। এই তথ্য জোগাড় করা সরকারেরই দায়িত্ব।

সংগঠন হিসেবে ইসকনের বিবর্তনটা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর দ্রুত ঘটেছে। ভক্তদের মধ্যে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয় হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে সংগঠনটিতে ‘ইথনিক’, বিশেষভাবে ইহুদি প্রভাব বেড়েছে কি বাড়েনি- সে প্রসঙ্গ। এ অবস্থায় শ্রীল প্রভুপাদের ধর্মচিন্তার ধারণা থেকে ইসকন ‘বিচ্যুত’ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভক্তদের মধ্যে ইহুদি প্রভাবের একটা নামও আছে : ‘জেবিডি’ (Jewish Background Devotee)। বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা যখন ইসকনকে একটি ‘ইহুদি’ সংগঠন বলে দাবি করেন ও জায়নিস্ট তৎপরতা প্রতিরোধের কথা বলেন, তখন তারা আসলে ইসকনের বিপুলসংখ্যক কৃষ্ণভক্তের অভিযোগেরই প্রতিধ্বনি করেন। একে নিছক ইহুদিবিদ্বেষ হিসেবে গণ্য করার কারণ নেই।

ইসকনের সাথে যুক্ত আন্তরিক রাধাকৃষ্ণভক্তকুল আমাদের আপত্তির বিষয় নন। তাদের সঙ্গে সম্প্রীতি চর্চা করা জরুরি। আশা করি, তারাও আমাদের এই উৎকণ্ঠাকে আন্তরিকভাবেই বিবেচনা করবেন।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us