উইঘুরদের দুঃসময়
উইঘুরদের দুঃসময় - ছবি : সংগ্রহ
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের এক দিনে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের গুলশেরা হোজার পরিবারের ২৫ জনের কাছে একটি সমন আসে, যাতে তাদের ৫০০ কিলোমিটার দূরে প্রাদেশিক রাজধানী উরুমকির থানায় হাজির হতে বলা হয়। হোজার পরিবারে সমন পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তার ৭০ বছর বয়সী মা-বাবাও ছিলেন। যখন তারা থানায় হাজির হলেন তখন তাদের বলা হলো- মার্কিন সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত রেডিও ফ্রি এশিয়ার (আরএফএ) গুলশেরা হোজার সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে তাদের গ্রেফতার করা হলো। আরএফএর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, চীন সরকার উইঘুর জনগোষ্ঠীর লোকজনকে গণহারে গ্রেফতার করে আটক রেখেছে। জিনজিয়াংয়ের দুই কোটি ২০ লাখ লোকের প্রায় অর্ধেকই উইঘুর। হোজার বৃদ্ধ বাবা অসুস্থতাজনিত কারণে হাসপাতালে থাকায় ওই থানায় উপস্থিত হতে পারেননি। এরপর ওই হাসপাতালে পুলিশ পাঠানো হয়, যাতে ৭০ বছরের বেশি বয়সী ওই বৃদ্ধ পালিয়ে যেতে না পারেন।
আরএফএর প্রতি চীন কর্তৃপক্ষের বার্তাটি ছিল একেবারে পরিষ্কার। আর এটিই প্রথম নয়। এর আগেও আরএফএর কর্মীদের প্রতি এ ধরনের বার্তা পাঠানো হয়েছিল। এক বছর আগে যখন জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের গ্রেফতার করা শুরু হচ্ছে তখন হোজার সহকর্মী কুরবান নিয়াজ তার ছোট বোনের কাছ থেকে চীনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উইচ্যাটের মাধ্যমে একটি ছবি পান। ওই ছবিতে দেখা যায়, তার বাসার সোফায় দুই চীনা পুলিশ বসে আছে। একজন আবার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে পোজ দিচ্ছেন। জানা যায়, ওই দুই পুলিশই এ ছবি তুলে নিয়াজের কাছে পাঠাতে বলে। মূলত তারা এর মাধ্যমে বার্তা দিতে চায়, তোমরা আসলে পুলিশের নজরদারির বাইরে নও।
উইঘুর মুসলিমদের চাপ দিতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রচেষ্টা এখন চীনের সীমান্তের বাইরেও অনেক বেশি প্রসারিত হয়েছে।
ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব উইঘুর নির্বাসিত অবস্থায় আছেন বা যারা পূর্বে চীনা কর্তৃপক্ষের হাতে বন্দী ছিলেন তাদের বারবারই চাপ দেয়া হচ্ছে, তারা যেন জিনজিয়াংয়ের নতুন গুলাগ নিয়ে কোনোভাবেই মুখ না খোলেন। কখনো তাদের সরাসরি হুমকি দেয়া হচ্ছে, আবার কখনো বা আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে। যারা মুখ খুলেছেন, তাদের পড়তে হচ্ছে নানা ধরনের সমস্যার মুখে। গত ১৩ অক্টোবর চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়। যাতে দেখা যায়, এক উইঘুর ব্যক্তি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর বক্তব্যকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করছেন। পম্পেওর বক্তব্যে বলা হয়েছিল, জুমরাত দাউত নামের এক নারীকে আটক করে প্রহার করা হয়েছে এবং তাকে জোরপূর্বক বন্ধ্যা করে দেয়া হয়েছে। জুমরাতের ভাই দাবি করে ওই ব্যক্তি লিখিত বক্তব্যে বলছিলেন, আমি এ ভিডিও ক্লিপটি বানিয়েছি বিশ্বকে সত্য বিষয়টি জানানোর জন্য। মূলত উইঘুরদের চাপ দিয়েই এ ধরনের স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়ে থাকে।
ওই আরএফএর উইঘুর ভাষার শাখায় যারা কাজ করছে, তাদের অনেক বেশি হুমকির মুখে থাকতে হচ্ছে। কেননা এ রেডিওটি জিনজিয়াংয়ের মারাত্মক অবনতিশীল মানবাধিকারের কথা তুলে ধরছে অব্যাহতভাবে। চীনা কর্তৃপক্ষ এ রেডিও স্টেশনকে ‘শত্রু রেডিও স্টেশন’ বলে আখ্যা দিয়েছে। সংস্থাটির উইঘুর কর্মীরা জানিয়েছেন, তারা এখানে কাজ করার কারণে উইঘুরে তাদের আত্মীয়স্বজনদের ওপর মারাত্মক ধরনের নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদের অপরাধ একটাই, তাদের আত্মীয় বা বন্ধু এ রেডিওতে কাজ করছেন। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আরএফএতে কর্মরত ছয় উইঘুর কর্মীর কমপক্ষে ৪০ জন স্বজন হয়তো তাদের বন্দিশিবিরে (চীন কর্তৃপক্ষ এটিকে প্রশিক্ষণাগার বলে থাকে) বা তাদের কারাগারে রয়েছে অথবা গুমের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে হোজার পরিবারের ২০ সদস্যও রয়েছেন, যাদের ২১ মাস আগে বন্দী করার পর এখন পর্যন্ত মুক্তি দেয়া হয়নি।
আরএফএ রেডিও স্টেশনটিতে প্রতিদিনই নির্যাতিত উইঘুরদের সাথে ফোনে কথা বলে সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে খবর পরিবেশন করা হয়। কখনো কখনো দিনে এই ফোনের পরিমাণ বেড়ে ১০০ তে গিয়ে পৌঁছে। উইঘুরদের নিয়ে এ বিশেষ অনুষ্ঠান প্রতিদিন দুই ঘণ্টা শর্টওয়েভ রেডিও ও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। চীন সরকার এটি প্রচারের সময় আরএফএর ফ্রিকোয়েন্সি জ্যাম করে ফেলে, যাতে কেউ এ অনুষ্ঠান শুনতে না পারে। কিন্তু উইঘুর থেকে চলে যাওয়া উইঘুরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, যখন তারা চীনে ছিলেন তখন তাদের প্রতি পাঁচজনের একজন সপ্তাহে অন্তত একবার আরএফএর সংবাদ পড়ত বা রেডিও শুনত।
কিন্তু চীন সরকারের ব্যবহৃত প্রযুক্তির ভয়ে অনেকেই আরএফএর সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখতেও শঙ্কা অনুভব করেন। অনেক সাংবাদিকই জিনজিয়াংয়ের বিষয়ে কিছু বলতে চান। কিন্তু তারা সরকারের ভয়ে ফোনেও কথা বলতে সাহস পান না। কারণ কর্তৃপক্ষ ভয়েস-রিকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত তাদের পরিচয় বের করে ফেলে এবং ফোনালাপ বন্ধ করে দেয়।
তবে আরএফএর এ অনুষ্ঠান প্রচারের ফলে চীনের জিনজিয়াংয়ে নির্যাতিত মুসলমানদের দিকে বিশ্বের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে। কারণ সেখানকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তা খবরে তুলে নিয়ে আসা সাংবাদিকদের জন্য প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।
চীনা সরকার আরএফএর এসব অনুষ্ঠান বন্ধ করতে না পারে পুরো সংস্থাটির ওপরই বেশ কিছু অভিযোগ করছে। তবে নিজেরা সরাসরি না করে অন্যদের মাধ্যমে তারা যেসব অভিযোগ উত্থাপন করছে সেগুলো হচ্ছে বা উইঘুরদের যেসব নির্যাতনের কথা বলা হচ্ছে সেগুলোর অনেকটুকুই ভিত্তিহীন ও নাটকীয়। এছাড়া মার্কিন কর্তৃপক্ষ মূলত প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্যই এ সংস্থায় বিনিয়োগ করছে। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ রেডিওতে স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতিমালা থাকার কথা বলা হলেও মূলত তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের নীতিমালাই প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে এসব সমালোচনা-হুমকিকে পেছনে ফেলেই উইঘুরদের অবস্থা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে যাচ্ছে আরএফএ।
২০১৮ সালে যখন চীন সরকার প্রথমবারের মতো এ ধরনের বন্দিশিবিরের (চীন কর্তৃপক্ষের ভাষায় প্রশিক্ষণ শিবির) কথা স্বীকার করে, তখন আরএফএ সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে আটকে রাখা উইঘুর মুসলমানদের সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস ধরে কমিউনিস্ট পার্টির নীতিকথা শেখানো হতো। বিচ্ছিন্নতাবাদের (চীন কর্তৃপক্ষের ভাষায় ইসলামী পোশাক পরিধানকারীরাই বিচ্ছিন্নতাবাদী) ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধান করা হতো। জিনজিয়াং কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য কিছু বিদেশী গণমাধ্যম ও কূটনীতিকদের সেখানে পর্যবেক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তাদের সে সাজানো আয়োজনের পরও ওই সফরে অংশ নেয়া আলবেনিয়ার ওলসি জাজেশি বা জার্মান পণ্ডিত আদ্রিয়ান জেঞ্জের মতো অনেকেই বলেন, ওইসব প্রশিক্ষণ শিবির মূলত মগজ ধোলাইয়ের কারখানা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিষয়টি নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেও সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। এ মাসের শুরুর দিকে উইঘুরদের নির্যাতনের সহযোগী চীনের সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন।
রেডিও সার্ভিসটির সহপরিচালক মমতজান জুমা বলেন, আমাদের প্রতি চীনের এ হুমকি অব্যাহত রয়েছে, বরং দিন দিন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি জানান, তার তিন ভাইয়ের সবাই এখন চীনের কারাগারে রয়েছে। তাদের মধ্যে দুইজন বন্দি আছেন ২০১৭ সালের মে মাস থেকে। কখনো কখনো সরকারি এই চাপ এত বেড়ে যায় যে, তখন তিনি একটি গান শুনতে থাকেন, যা তারা সবভাই মিলে শুনতেন। এ সময় তার চোখে অশ্রুর বন্যা বয়ে যায়। তিনি বলেন, যদি আমরা উইঘুরদের বিষয়ে কিছু না বলি, তাহলে আমরা নিরাপদ থাকতে পারব। কিন্তু আমরা যদি না বলি বা না লিখি তাহলে আর কেউ এ বিষয়ে জানবে না। তাই আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। তখন জুমার চোখে অশ্রু টলমল করতে থাকে।