সম্রাট আকবরের শ্রেষ্ঠত্ব এখনো স্বীকার করেন অমর্ত্য সেন
অমর্ত্য সেন - ছবি : সংগৃহীত
দি টাইমসের ভাষায় ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনা হলেন, ‘আমাদের যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ।‘ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্ব্রিজের কাছে হার্ভার্ড স্কয়ারে তার ইতিহাসবিদ স্ত্রী এমা রথচাইল্ডের সাথে থাকেন। তাদের বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছবি। বাংলার সংস্কৃতিতে অমর্ত্য সেন ও রবীন্দ্রনাথ উভয়ে অবিচ্ছেদ্য ব্যক্তিত্ব।
অমর্ত্য সেন ১৯৩৩ সালে এক শিক্ষাবিদ হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অর্থনীতিতে পড়ার জন্য ক্যাম্ব্রিজে যান। পরে যান দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিক্স, দি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এবং তার পর অক্সফোর্ডে। তিনি ছিলেন ট্রিনিটি কলেজ, ক্যাম্ব্রিজের মাস্টাস। আর ১৫ বছর ধরে তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। ছয় দশকের ব্যাপ্তিতে তিনি দুর্ভিক্ষ ও কল্যাণমুখী অর্থনীতি গবেষণায় পৃথিবীকে সমৃদ্ধি করেছেন। তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৮ সালে তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।
তার ‘ক্যাপাবিলিটিস অ্যাপ্রোচ’ তত্ত্বটিতে বলা হয়েছে যে সব দেশের উচিত ‘মানব বিকাশের’ ব্যাপকভিত্তিক পদক্ষেপের ওপর জোর দেয়া এবং দারিদ্র্য নির্মূলের মাধ্যমেই কেবল তা অর্জন করা সম্ভব। আর কাজটি করার জন্য সম্পদের সুযোগ ও বণ্টনের ওপর নজর দেয়া উচিত। তিনি এসব উপাদানকে এই তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত করেন যে ভারত জেন্ডার সমতা ও কল্যাণমূলক ব্যয়ের অভাবে ভুগছে।
তিনি বলেন যে ভারতের আগের ও বর্তমান সরকারগুলো দারিদ্র্য ও স্বাস্থ্যপরিচর্যা প্রশ্নে ভুল দিকে এলোপাথারি লম্ফ-ঝম্ফ করেছে। অনেক পল্লী এলাকায় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী লোকজন আশপাশে রাষ্ট্র-পরিচালিত কোনো ওষুধের দোকান দেখতে পায় না। ফলে তাদেরকে বেসরকারিভাবে পরিচালিত ব্যয়বহুল হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়।
অমর্ত্য সেন ঐতিহাসিক নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলর হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য মনোনীত হওয়ার পর তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন। কারণ সরকার এতে ‘অসন্তুষ্টি’ প্রকাশ করেছিল বলে নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত হয়েছিল।
অমর্ত্যের বয়স এখন ৮৫ বছর। তাকে ‘কোলাহলপূর্ণ হাসি’ ও আশ্চর্য স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন লোক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি এখনো লিখেন, বর্তমানে স্মৃতিকথা লিখছেন। তিনি বলেছেন, এই লেখালেখি তার মধ্যে ‘প্রাচীন’ অনুভূতির সৃষ্টি করে। তিনি ট্রিনিটি কলেজকে ‘মহান গণিত কলেজ’ হিসেবে অভিহিত করেন। এই কলেজে আইজ্যাক নিউটনের মতো মহামানবের আগমন ঘটেছিল।
অমর্ত্য সেন স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে উল্লেখ করেছেন যে একসময় ভারতে এক শিখ নেতা ছিলেন, তিনি ছিলেন অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রপতি ছিলেন মুসলিম। কিন্তু এখন তিনি লোকজনকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে বর্তমান সরকার মনে হচ্ছে কেবল হিন্দুত্ববাদে পরিচালিত। বিশ্বাসের বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ ভারতের প্রয়োজন সতর্ক হওয়া এবং অমর্ত্য সেন সব সম্প্রদায়ের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির দিকে এগুনোর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ, গরিবদের সামনে থাকা সমস্যাবলী, জেন্ডার সাম্যতার অভাব, লোকজনের সাম্যতাবিষয়ক জটিলতা ইত্যাদির মতো বিভিন্ন কারণে অমর্ত্যকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ন্যায়বিচার নিয়ে বই লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে।
তার আইডিয়া অব জাস্টিস শুরু হয়েছে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ লডউইগ উইজেনস্টেনের (তিনি লিখেছেন ১৯২১ সালে) ভাষ্য দিয়ে। ওই ভাষ্যে বলা হয়েছে, যদি কিছু বলতে হয়, তবে তা বলা উচিত স্পষ্টভাবে। আর যে লোক বলতে পারে না তার অবশ্যই নীরব থাকা উচিত। অমর্ত্য সেন ব্যাখ্যা করে জানিয়েছেন যে উইজেনস্টেনও ‘অপেক্ষাকৃত স্মার্ট’ নেতা ও জনগণের কথা বলেছেন। কারণ অপেক্ষাকৃত স্মার্ট লোকজনই স্পষ্টভাবে তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধ অনেক স্পষ্টভাবে বলতে পারেন। এটা যুক্তির শক্তির ওপর জোর দেয়। তিনি আত্মস্বার্থ ও সামাজিকভাবে কল্যাণমূলক উদ্রোগের মধ্যে পার্থক্য পরীক্ষা করেছেন।
বৈচিত্র্যময় জাতির সম্প্রীতির প্রেক্ষাপটে মোগল সম্রাট আকবরের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অমর্ত্য সেন। এই সম্রাট সাংস্কৃতিকব্যবস্থাসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলোর সুদূরপ্রসারী নিরীক্ষা করেছেন। তিনি ১৬তম শতকে আন্তঃসম্প্রদায় সম্পর্কের চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর নজর দিয়েছিলেন। এটিই ওই সময়ে আকবরের অস্বাভাবিক নীতি নির্ধারণে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। রাজধানী আগ্রায় আকবর হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সংলাপের সূচনা করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে ভারতের গৃহীত সেক্যুলার সংবিধানে ১৫৯০-এর দশকে আকবরের নেয়া অনেক বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করা হয়েছিল। এটিই উইজেনস্টেনের এই পরামর্শ প্রতিফলিত করেছে যে সমালোচনা যখন নির্মূল করা হয় তখন নীরবতাই হয় চিন্তার স্বচ্ছতার ফসল।
অমর্ত্য সেন অনন্য বিজ্ঞতা দিয়ে স্পষ্ট করেছেন যে সরকার, লোকজনও মূল্যবোধের অভিন্ন বন্ধন গড়ে তুলতে পারে যা উপলব্ধি করা, সহানুভূতি অর্জন করা, যুক্তি দেয়ার মৌলিক মানবীয় সামর্থ্যের সারবত্তা। অন্য কথায় বলা যায়, লোকজনের অনিবার্যভাবে নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের কোনো প্রয়োজন নেই।
তিনি একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন : বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্য ও শিক্ষার অভাবের মতো পর্যাপ্ত বঞ্চনা কি নেই?
ভারতের সাক্ষরতার হার ৭৪.০৪ ভাগ, বিহার হলো সবচেয়ে কম সাক্ষরতাসম্পন্ন এলাকা, ৬৩.৮২ ভাগ। বিপরীতে চীনের সাক্ষরতার হার ৯৬.৪০ ভাগ।
ন্যায়বিচারের তত্ত্বগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সব শ্রেণির লোকজনের পক্ষে সম্ভব আরো তৃপ্তিময় জীবনযাপন করা। অমর্ত্য সেনা শিক্ষার শক্তির ওপর আলোকপাত করেছেন, যা পরিতৃপ্ত জীবনের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করে বলে একে কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা উচিত নয়। তিনি বলেন, শিক্ষা মানুষকে বদলে দেয়। এটি নাটকীয় পার্থক্য রচনা করে। এটা আমাদের প্রয়োজনীয় সামাজিক সাম্যতা সৃষ্টি করে।
দি স্টেটসম্যান