আগুনে পুড়ে গেলে কী কী করবেন, কী কী করবেন না
আগুনে পুড়ে গেলে কী কী করবেন, কী কী করবেন না - ছবি : সংগ্রহ
আমাদের প্রত্যাহিক জীবনের কাজকর্ম করতে গিয়ে অসাবধানতার কারণে ছোট-বড় নানা দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে আগুনে পুড়া অন্যতম। আমরা যদি দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতন হই, সতর্ক হই, প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার মতো কিছু জানি, তাহলে নানান দুর্ঘটনার পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারব। অনেক সময় মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে।
কারণ
বেশি ভাগ ক্ষেত্রে সংসারে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ শরীরে নানা স্থান পুড়ে যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো- রান্না করা গরম তেল, গরম পানি, গ্রামে বাড়িতে চুলার গরম ছাই, গরম ধাতব্য লোহার ছ্যাকা লাগা, কয়েলের আগুন বিছিনা থেকে শরীরে লাগা, তা ছাড়া দাহ্য পদার্থ দ্বারা আগুন যেমন- কেরোসিন, পেট্রল, এসিড, গ্যাস, ইত্যাদি দিয়ে শরীর পুড়ে যেতে পারে। যেকোনো পুড়াই হোক না কেন, প্রথমে ভালো করে খেয়াল করতে হবে। পোড়া কোন ধরনের এবং পরিমাণ কত ও শরীরের কোন স্থান। চিকিৎসকদের মতে, প্রাথমিকভাবে পোড়া তিন প্রকার।
প্রাথমিক মাত্রার পোড়া
আমাদের শরীরের চামড়া দুইটি স্তর থাকে। প্রথমটি স্তরটি এপিডার্মিস, অপরটি হলো ডার্মিস। শুধু চামড়ার উপরিভাগ পুড়ে গেলে থাকে প্রাথমিক মাত্রা পুড়া বলে। এতে চামড়া লাল হয়ে আক্রান্ত স্থান ফুলে উঠে এবং যন্ত্রণা করে। এ পুড়া প্রাথমিক চিকিৎসায় কমে যায় কিন্তু সাবধান থাকবেন, এই সামান্য মাত্রার পুড়া যদি মুখে যৌনাঙ্গে, নিতম্বে এবং অস্থিসন্ধি স্থলে হয়, তাহলে দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
দ্বিতীয় মাত্রার পোড়া
শরীরের চামড়ার দুইটি স্তরই পুড়ে যায়। তাহলে এ অবস্থাকে বলা হয় দ্বিতীয় মাত্রা পুড়া। এ অবস্থায় চামড়ার লাল হয়ে ফোসকা পড়ে এবং ফুলে ওঠে। অতিরিক্ত জ্বালা-যন্ত্রণা করে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, এ পুড়া মাত্রা যদি তিন ইঞ্চির বেশি বিস্তৃত না হয়, তাহলে সামান্য পুড়া বলে ধরা হয়। পুড়া যদি অধিক ছড়ানো হয় আর স্থানটি যদি মুখে, যৌনাঙ্গ, হাত, পায়ে, গিরায়, শ্বাসনালীতে, নিতম্বে হয়, তাহলে অতি তাড়াতাড়ি রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা করানো খুবই প্রয়োজন।
তৃতীয় মাত্রার পোড়া
এ মাত্রার পুড়া অত্যন্ত বিপজ্জনক ও গুরুতর। এ ক্ষেত্রে শরীরের চামড়ার উভয় স্তর, চর্বি, মাংস পুড়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেহের হাড়ও পুড়ে যায়। এ অবস্থায় পুড়া অংশ কালো হয়ে যায়। আবার সাদা বর্ণ হয়ে শুষ্ক হয়ে যায়। এ ধরনের পুড়ায় ব্যথা থাকে না। কারণ দেহের স্নায়ুগুলো পুড়ে যায়। তাই ব্যথা করে না, এটি ভালো লক্ষণ নয়। রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কার্বন মনোঅক্সাইড নামক বাতাসের বিষাক্ত পদার্থ ফুসফুসে ঢুকে যায়। এ ধরনের পুড়াতে অতি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে এবং বার্ন ইউনিটে ভর্তি করতে হবে। এসব রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা বা দেরি করা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
প্রাথমিক চিকিৎসায় করণীয়
উপরে আলোচনায় প্রথম ও দ্বিতীয় মাত্রার পুড়া হলে আক্রান্তর স্থানটি স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানির ধারার নিচে ধরে রাখুন। যেমন- টেপের পানির নিচে ১০-১৫ ধরে রাখতে হবে। শরীর পুড়ে গেলে গোসলের ঝরনার পানির নিচে বা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
* এ ব্যবস্থা যদি করা না যায়, তাহলে আক্রান্ত স্থানটি বালতি পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে।
* শরীর কাপড়ে আগুন লাগলে মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি দিতে হবে। দৌড়াদোড়ি করা যাবে না। এতে আগুন আরো বেড়ে যেতে পারে। পোড়া শরীরে কাপড় থাকলে বা কোনো প্রকার অলঙ্কার থাকলে তা খুলে ফেলতে হবে। কোনো প্রকার রাসায়নিক পদার্থ বা গরম তেল দিয়ে পুড়লে প্রথমে দেখতে হবে, তা শরীরে যেন লেগে না থাকে। অগ্নিদগ্ধ হলে ব্যক্তির শরীর থেকে পোশাক খুলে প্রথমে ১০ মিনিট বিশ্রাম দিয়ে আধা ঘণ্টা অনবরত ঠাণ্ডা পানি ঢালতে হবে। এতে যন্ত্রণা কমে যাবে।
* ত্বকের চামড়া ফোসকা পড়া ভালো লক্ষণ। আসলে ফোসকা পড়লে মনে করবেন দেহের কোষগুলো জীবিত আছে। তবে এ ফোসকাগুলো সাথে সাথে গলানো যাবে না। * পোড়া গভীর হলে সাধারণত ফোসকা পড়ে না। এতে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
* শরীরে আগুন লাগলে কাঁথা বা কম্বল দিয়ে গা জড়িয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করবেন না। এগুলো শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখে বা দেহের মধ্যে আটকে যায়। এতে চামড়ার পুড়ার বিস্তৃতি বেড়ে যেতে পাড়ে। এমনকি মৃত্যু ডেকে আনতে পাড়ে।
* পোড়া স্থানটি জীবাণুমুক্ত গজ বা ব্যান্ডেজ (তবে তুলা নয়) দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। যাতে জীবাণু সংক্রমণ না হয়। ব্যথানাশক ওষুধ প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।
যা করা যাবে না :
চামড়া পোড়া জায়গায় বরফের পানি, ফ্রিজের পানি বা ফ্রিজের বরফ, কিংবা বরফ দেয়া যাবে না। আবার গরম পানি ঢালা যাবে না।
* আক্রান্ত স্থানে ডিম, টুথপেস্ট, মাখন, মলম লাগানো যাবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো প্রকার মলম ব্যবহার করা যাবে না।
* তুলা দিয়ে ড্রেসিং করা বা পোড়া অংশে ঢেকে রাখা যাবে না। শুকনো গজ বা ব্যান্ডেজ ব্যবহার করতে হবে।
* পোড়া স্থানে ভেসলিন বা পেট্রোলিয়াম মেলি ব্যবহার করবেন না।
* পোড়া স্থানে কোনোভাবে ডলাডলি করা যাবে না এবং ফুসকা ফাটানো বা তুলে ফেলা যাবে না।
এসিডদগ্ধ হলে :
এসিড নিক্ষেপ একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এর ফল মৃত্যুদণ্ড। তার পরও দেশে এসিড সন্ত্রাস থেমে নেই। চিন্তা করো যে ব্যক্তি এসিডে দ্বগ্ধ হয় তার শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক যে ক্ষতি হয় তার তুলনা নেই। এসিড পানির মতো তরল পদার্থ কিন্তু শরীরে স্পর্শ করা মাত্রই চামড়া পুড়ে যায়, জ্বলতে থাকে। এসিড এত দাহ্য পদার্থ যে, মাংশ পুড়ে গিয়ে হাড়েরও মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। তাই এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে আক্রান্ত স্থানে প্রচুর পানি ঢালুন। এতে যত বেশি পানি ঢালা যাবে, এসিডের শক্তি তত কমে যাবে। শরীরে ক্ষতির পরিমাণ তত কম হবে। তবে সাথে সাথে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন, এসিডের পোড়া ব্যক্তির দ্রুত সেরে ওঠার জন্য পরিষ্কা-পরিচ্ছন্ন ও আলো-বাতাস সম্পন্ন পরিবেশ খুবই প্রয়োজন।
রক্ষা করার উপায় :
যেকোনো চুলা সর্বক্ষণ জ্বালিয়ে না রেখে প্রয়োজন শেষে নিভিয়ে রাখুন।
* আগুনের ওপর ভেজা কাপড় বা ভেজা কম্বল দিয়ে চাপা দিন।
* বাড়িতে আগুন লাগার উপকরণ গ্যাসের চুলা, সিলিন্ডার, ম্যাচ বক্স, ইলেকট্রিক সুইচ সাবধানে ব্যবহার করুন।
* চারদিকে আগুন থাকলে মাথা নিচু করে নাক চেপে দরে দ্রুত স্থান ত্যাগ করুন।
* রান্নার চুলা মেঝেতে না বসিয়ে কোনো উঁচু স্থানে বসান এবং দাঁড়িয়ে রান্না করুন।
* শিশুরা ও অসাবধানতাবশত গরম পানি, ডাল, চা বা চুলায় হাত ঢুকিয়ে দেয়। এতে তারা পুড়ে যায়। এগুলো শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন।
* মহিলার রান্নার সময় পোশাক পরিধানে সর্তক থাকুন। ঢিলেঢালা জামা আগুনের কাছে গেলে অসাবধানতায় আগুন লেগে যেতে পারে। তাই আগ জামা থেকে বেধে নিন। এসিডের সহজলভ্যতা ও যত্রতত্র ব্যবহার কঠোর হাতে দমন করতে হবে।
* পোড়া রোগীকে প্রচুর তরল জাতীয় খাবার খাওয়ান। সতর্ক হোন, সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন।