রাজাপাকসাদের নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র টানাটানি
রাজাপাকসাদের নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র টানাটানি - ছবি : সংগৃহীত
প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা ২০১৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে শ্রীলঙ্কার ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি ছিল লক্ষ্ণণীয়। সাবেক নেতা মহিন্দা রাজাপাকসার চীনপন্থী নীতি থেকে সরে এসে তিনি এই নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু মহিন্দা (তিনি প্রায় এক দশক ক্ষমতায় থাকার সময় প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করেছিলেন চীনের কাছ থেকে) আবারো নির্বাচনী প্রচারণায় হাজির হয়েছেন, ১৬ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসাকে সমর্থন করছেন।
গোতাবায়ার (তিনি ২০০৫-২০১৫ পর্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন) মুখপাত্র গত মাসে বলেন, তিনি নির্বাচিত হলে চীনের সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন।
রাজাপাকসা আমলের কূটনীতিক পালিতা কোহোনা বলেন, আমরা মনে করিছিলাম যে চীনের কাছ থেকে সরে এলে পাশ্চাত্য আমাদের কাছে আসবে সোনা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে। কিন্তু সোনা ভর্তি ব্যাগ কখনোই আসেনি।
আসন্ন নির্বাচনে গোতাবায়া প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে তার দল শ্রীলঙ্কা পদুজনা পেরামুনা ২০১৮ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর প্রেসিডেন্ট পদে এই দলের প্রার্থীর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
মহিন্দার নেতৃত্বাধীন সদ্য সৃষ্ট দলটি প্রায় ৪৫ ভাগ ভোট পায়। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক থাকার প্রেক্ষাপটে এই জয় অপ্রত্যাশিত ছিল না। ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির অকার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিপরীতে অনেকে নতুন দলকেই ভোট দেয়।
গোতাবায়া বলেছেন, জয়ী হলে তিনি জোট নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করবেন। তবে উল্লেখ করার বিষয় হলো, নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ইউএনপির প্রার্থী সজিথ প্রেমাদাসা ঠিক চীনা অনুসারী নন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিঙ্গে (তিনিও ইউএনপির) যুক্তরাষ্ট্রপন্থী হিসেবে বিবেচিত। তিনি ওয়াশিংটনের সাথে সোফা নিরাপত্তা চুক্তি সই করার কাছাকাছি উপনীত হয়েছিলেন। ওই চুক্তি করা হলে মার্কিন সৈন্যরা শ্রীলঙ্কায় অবস্থান করতে পারতেন। তবে তার প্রশাসন স্থানীয় প্রকল্পগুলোতে চীনা সহায়তার ওপর জোর দেয়। এর জের ধরেই ২০১৭ সালে চীনা নির্মিত হাম্বানতোতা বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য বেইজিংয়ের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সরকারের প্রতি মার্কিন সমর্থন নামমাত্র থাকলেও এই অতি ডানপন্থী ইউএনপি সরকারের প্রতি মার্কিন হিসাব ব্যাপকভাবে বদলে যায় হাম্বানতোতা বন্দর চুক্তি সই করার পর। ২০১৫ সালে এই সরকারকে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেছিল, এবার তারা তা করেনি। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের নির্বাচনের সময় রাজাপাকসাদের প্রতি প্রকাশ্যেই বৈরিতা প্রদর্শন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আলাইনা তেপলিজট ও অন্যান্য মার্কিন কর্মকর্তা নির্বাচনী প্রচারণার বিভিন্ন পর্যায়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ও তার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত করেছেন। তাদের ছবি মার্কিন সরকারের বিভিন্ন সামাজিক মিডিয়ায় বেশ ভালোভাবেই প্রদর্শিত হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসারা এখনো খুবই জনপ্রিয়। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ কারণেই একাধিকবার বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার যেকোনো সরকারের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত।
কাকতালীয়ভাবে রাজাপাকসাদের ছোট ভাই বাসিলও মার্কিন নাগরিক। তিনি খুবই রাজনৈতিক লোক। সাবেক এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রী এখনো মার্কিন নাগরিক হিসেবেই রয়েছেন। আর গোতাবায়া নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগ দিয়ে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কায় তার নিজস্ব নাগরিক বা সাবেক নাগরিকদের ক্ষমতায় রাখা রমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র রাজাপাকসাদের সাথেই সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করতে পারবে।
চীন এখন তার তহবিলপুষ্ট বড় বড় প্রকল্প এবং শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপেরমতো দেশের সাথে সার্বিক সম্পর্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন। হাম্বানতোতা বন্দর বেইজিংয়ের জন্য বেশ কল্যাণকর হলেও কৌশলগত স্থানগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছে বলে জনসাধারণের মধ্যে যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে চীন বেশ সমস্যায় পড়ে গেছে।
বন্দরটি ও এর ইজারার ঘটনাটি সারা দুনিয়ায় তথাকথিত চীনা ঋণ ফাঁদ হিসেবে সমালোচিত হয়। বেইজিংয়ের জন্য আরেকটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। এর জের ধরে দেশটির বিরোধী দল গত বছর ভারতীয় সৈন্যদের সরাসরি হস্তক্ষেপের আহ্বান পর্যন্ত জানিয়েছিল।
ইয়ামিনের আমলে মালদ্বীপের বড় বড় প্রকল্পে চীনাদের সম্পৃক্ততা ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ভারতপন্থী সরকার চীনা নিয়ন্ত্রণ থেকে সরে যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনে পরাজয়ের পর চীন সমীকরণে কঠিন অবস্থায় পড়েছেন।
শ্রীলঙ্কায় চলতি বছরের নির্বাচনে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলের নেতাদের কেউ এতে অংশ নিচ্ছেন না। এটি একটি নতুন ঘটনা। নতুন নেতারা নতুন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবেন।
শ্রীলঙ্কায় ভারতের বিপুল কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতিবেশী প্রথম নীতির আলোকে চলতি বছর পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম দিকে যেসব দেশ সফর করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্গায় গিয়ে তিনি ইস্টার সানডেতে ইসলামি চরমপন্থীদের বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত একটি চার্চ পরিদর্শন করেন। এ ধরনের চরমপন্থীদের কোণঠাসা করতে কোন প্রার্থী সফল হবেন, সে ভাবনা মোদির রয়েছে।
শ্রীলঙ্কা রিজিওন্যাল কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের যোগদান করা নিয়েও দ্বিধায় রয়েছে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্লকে পরিণত হতে যাচ্ছে। চীন এর সদস্য। আর ভারতের তাতে যোগদানের বিষয়টি ঝুলে আছে। ভারত চায় শ্রীলঙ্কা যেন বেইজিংয়ের স্পর্শকাতরতার মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি না করেই চীনের দিকে না গিয়ে তার দিকে থাকে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট